এক ভদ্রলোক ছেলের বাবা হওয়ার পর প্রতিবেশী এক নিন্দুক বললো, এই ছেলে কথা বলতে পারবে না। একটু বড় হওয়ার পর দেখা গেল ছেলে ঠিকই কথা বলছে। তারপর বললেন, এই ছেলে ভালো স্কুলে চান্স পাবে না। কিন্তু ঠিকই চান্স পেয়ে গেল। এরপর বললেন, চান্স পেলেও পাশ করতে পারবে না। দেখা গেল ছেলেটি ভালো রেজাল্টও করলো। তারপরও প্রতিবেশীর রাগ যায় না। পাশ করলেও চাকরি পাবে না। কিন্তু ভালো চাকরিও পেয়ে গেল। তাও তার আফসোস যায় না, চাকরি পেলেও বেতন পাবে না। ঠিকই ভালো বেতনও পেলো। এরপর বললো, এই ছেলে ভালো বউ পাবে না। বউও পেয়ে গেল। তারপরও রাগ কমে না, বিয়ে করলেও বাচ্চা হবে না। বাচ্চাও হলো। তারপর আবার সেই চক্র।
Advertisement
বাংলাদেশের সরকারের হয়েছে সেই দশা। সরকার যাই করুক, আমরা কিছু নিন্দুক তৈরি, তার ভুল ধরার জন্য। প্রথম যখন করোনা এলো, আমরা সবাই ঝাঁপিয়ে পড়লাম, সরকার কেন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করছে না কেন। কিন্তু বন্ধ করার কিছুদিন পরই শুরু হলো, খুলে দেয় না কেন। গতবছর করোনায় মৃত্যুর খবর আসার পর শুরু হলো, সরকার কেন লকডাউন দেয় না। কিন্তু সাধারণ ছুটি দেয়ার কয়েকদিন পরই শুরু হলো, লকডাউন দিলে গরীব মানুষের কী হবে, তারা খাবে কীভাবে? সাধারণ ছুটি যখন একটু ঢিলেঢালা দিলো, তখন আমরা সবাই ঝাঁপিয়ে পড়লাম, এভাবে হবে না, কারফিউ দিতে হবে। আবার সরকার যখন মানুষকে ঘরে রাখতে কড়াকড়ি শুরু করলো, তখন আমরা বললাম, সরকার এত অমানবিক কেন? এবার করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময়ই একই কাহিনী। সরকার প্রথমে নির্দেশনা দিয়ে চেষ্টা করলো। কেউ মানলো না। তারপর প্রথমে ‘লকডাউন’, তারপর ‘কঠোর লকডাউন’ এলো, কিন্তু কোনোটাই কার্যকর করতে দেইনি আমরা।
এক নারী ডাক্তারের কাছে আইডি কার্ড চাওয়ার অপরাধে পুলিশ-ম্যাজিস্ট্রেটের চৌদ্দগোষ্ঠি উদ্ধার করে দিলাম আমরা। সেদিন থেকেই লকডাউনের বারোটা বেজে গেল। এখনও কাগজে-কলমে ‘কঠোর লকডাউন’ চলছে। কিন্তু কাজীর গরু কেতাবে আছে গোয়ালে নেই। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সরকারি অফিস আর দূরপাল্লার যান ছাড়া আর সবই চলছে। নিছক চলছে বললে ভুল হবে, পূর্ণ উদ্যমে, মহাসমারোহে চলছে।
ভয়াবহ এপ্রিলের পর মে এসেছিল অনেকটা স্বস্তি নিয়ে। কিন্তু শপিং মল আর ঈদে বাড়ি ফেরার তাড়া দেখে মনে হচ্ছে, সেই স্বস্তি উবে যেতে সময় লাগবে না। শপিং মলে বা বাড়ি ফেরার ফেরি দেখলে কেউ বলবে না, বাংলাদেশে করোনা বলে কিছু আছে। কিন্তু একটু ভাবুন সপ্তাহ দুয়েক আগেও কী হাহাকার ছিল চারপাশে। হাসপাতালে সিট নেই, আইসিইউ যেন সোনার হরিণ, প্রতিদিন মারা যাচ্ছেন একশোর বেশি মানুষ। কিন্তু কোনো পরিসংখ্যানই আমাদের মনে ভয় ধরাতে পারেনি। আর এখন তো সংক্রমণ এবং মৃত্যু হার কমে এসেছে। তাই ভয় যেটুকু ছিল সেটুকুও উবে গেছে। মার্কেটের ভিড় আর ফেরির অবস্থা দেখে করোনার বরং পালানোর দশা। গত সপ্তাহেও স্বস্তিটুকু ধরে রাখার কথা বলেছিলাম, কিন্তু এই এক সপ্তাহে পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। শপিং মলের দিকে চোখ দিলে মনে হতে পারে, এই ঈদ বুঝি জীবনের শেষ ঈদ। তাই এবারের ঈদে নতুন কাপড় না কিনতে পারলে বুঝি জীবন বৃথা হয়ে যাবে।
Advertisement
ব্যবসায়ীদের দাবির মুখে শপিং মল খুলে দেয়া হয়েছে, চলাচল করছে নগরে গণপরিবহনও। বলা হচ্ছিল, সবকিছু করতে হবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে। কিন্তু কোথাও স্বাস্থ্যবিধির কোনো বালাই নেই। নগর পরিবহন চললেও বন্ধ আছে আন্তঃজেলা গণপরিবহন। কিন্তু বন্ধ নেই মানুষের বাড়ি ফেরা। যে যেভাবে পারছেন, মরিয়া হয়ে বাড়ি ফিরছেন। মানুষের ফেরিতে ওঠার কসরত আর ফেরিতে উপচেপড়া ভিড় দেখে আমার সাংঘাতিক ভয় লেগেছে, যেমন ভয় লেগেছে ভারতের কুম্ভ মেলা দেখে। কুম্ভ মেলার খেসারত ভারত দিচ্ছে, শপিং আর বাড়ি ফেরার খেসারত কি বাংলাদেশকে দিতে হবে না?
অনেকে বলছেন, সরকার শপিং মল খোলা রাখলে মানুষের যেতে বাধা কোথায়? মানুষ ফেরিঘাট পর্যন্ত যেতে পারলো কেন? যাওয়ার পথে কোথাও বাধা দেয়া হয়নি। সরকার সবকিছু খুলে রেখে মানুষকে ঘরে থাকতে বলার তো মানে নেই। বিমান এবং ব্যক্তিগত যান চালু রেখে শুধু গরীব মানুষের বাড়ি ফেরা ঠেকানোর চেষ্টা কেন? একশভাগ একমত। কিন্তু এটাও জানি, সরকার যদি কড়াকড়ি করে, যদি বাড়ি ফেরা মানুষকে আটকাতে চায়; তাহলে অসন্তোষ হবে, মারামারি হবে। আমরাই তখন সরকারের কঠোর অবস্থানের বিপক্ষে অবস্থান নেবো, মানবাধিকার ক্ষুণ্ণ করার অভিযোগ করবো, আইডি কার্ড চাইলে চৌদ্দগোষ্ঠি উদ্ধার করবো।
শপিং মল আর বাড়ি ফেরার উৎসবে করোনার স্বস্তিটুকু উবে যাবার শঙ্কা তো ছিলই, তার সাথে এখন যুক্ত হয়েছে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের ভয়। গত কয়েক সপ্তাহ ধরেই ভারতে যে সুনামি চলছে, তা আমাদের একটুও স্পর্শ করতে পারেনি। আমরা সীমান্ত বন্ধ করে দিয়ে নিশ্চিন্তে বসেছিলাম। কিন্তু এরই মধ্যে বাংলাদেশে ঢুকে গেছে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট। আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতফেরত দুজনের শরীরে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের সন্ধান পাওয়া গেছে। তাদেরকে কোয়ারেন্টিনে রাখা হয়েছে। কিন্তু আমার ভয়টা অন্যখানে। বাংলাদেশ-ভারতের সীমান্ত আনুষ্ঠানিকভাবে বন্ধ করা হলেও এতবড় সীমান্ত পুরোপুরি বন্ধ রাখা কখনোই সম্ভব নয়। আনুষ্ঠানিকভাবে বন্ধ রাখলেও অনানুষ্ঠানিক যোগাযোগ বন্ধ রাখা কঠিন নয় শুধু, অসম্ভবও। চোরাচালানীরা যদি ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট নিয়ে আসে, তাদের কীভাবে শনাক্ত করা সম্ভব হবে? তারা তো নতুন ধরনের এই ভয়ঙ্কর ভাইরাস ছড়িয়েই যাবে। আর ঈদে যেভাবে মানুষ বাড়ি যাচ্ছে, এক সপ্তাহ পরে সেভাবেই আবার ফিরবে। সব মিলে তাদের সাথে ভাইরাস ঢাকা থেকে বাড়ি যাবে, আবার বাড়ি থেকে নতুন ভ্যারিয়েন্ট নিয়ে ঢাকায় ফিরবে।
তার মানে দ্রুত করোনা আবার ছড়িয়ে পড়বে দেশজুড়ে। ভয়টা ডাবল হয়ে যায়, যখন শুনি ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট দ্রুত ছড়ায়, ভয়টা ট্রিপল হয় যখন শুনি টিকা দিলেও ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট থেকে পুরোপুরি সুরক্ষা পাওয়া সম্ভব নয়। একটা জিনিস বুঝে গেছি, সরকার করোনা নিয়ন্ত্রণে কার্যকর কিছু করতে পারবে না। করোনার তৃতীয় ঢেউ এলো বলে। তখন আমরা প্রাণখুলে সরকারকে গালাগাল করবো, চিকিৎসা ব্যবস্থার চৌদ্দগুষ্ঠি উদ্ধার করবো। এখন নিজের সুরক্ষা নিজেকেই করতে হবে। একটা পুরোনো কথা, সরকারের কাছে আপনি একটা পরিসংখ্যান মাত্র। কিন্তু পরিবারের কাছে আপনিই সবকিছু। তাই এই সবকিছুকে নিরাপদ রাখার দায়িত্বও আপনারই। যাদের জীবনের মায়া নেই, তারা শপিং মলে যান, বাড়ি যান, ঘোরাফেরা করুন। যাদের জীবনের মায়া আছে, তারা ঘরে থাকুন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন। বাইরে যেতে হলে মাস্ক পরুন, জনসমাগম এড়িয়ে চলুন।
Advertisement
যত যাই বলুন, ভয়টা কিন্তু আমার যাচ্ছে না। একবছরে করোনাকে যতটা চিনেছি, আরো ভয়ঙ্কর হয়ে ফিরে আসতে পারে করোনার তৃতীয় ঢেউ। এখন সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করা ছাড়া আর কিছু করার নেই। হে আল্লাহ, ঈদ যেন সবার ঘরে আনন্দ নিয়ে আসে। সবাই যেন ভালো থাকি।
এইচআর/জেআইএম