মতামত

করোনাকালের করুণা!

ডা. মোজাহার হোসেন

Advertisement

চিকিৎসা পেশার লোকজন মানুষের নাড়ির খবর রাখে। আক্ষরিক অর্থে একজন চিকিৎসক যখন রোগীর নাড়ির গতি (পালস্) দেখার জন্য হাতের কব্জির কিঞ্চিত উপরে স্পর্শ করেন তখনই বুঝেন নাড়ির গতি। আর এ গতি দেখেই রোগীর ভবিষ্যৎটা কোন দিকে যাবে তা তাঁরা আঁচ করতে পারেন। আগের যুগের ডাক্তার, বৈধ্য কবিরাজরা নাড়ীর গতি আর জিহ্বার শুষ্কতা বা আদ্রতা ও চোখের পাতা টেনে তার রং রেখেই চিকিৎসা কর্ম চালাতেন। এতে করে রোগী ও চিকিৎসক উভয়ের মধ্যে একধরনের নৈকট্য তৈরি হতো। পরস্পরের আস্তার জায়গা হতো মজবুত।

এখন অবস্থা একেবারে ভিন্ন। রোগ নির্ণয়ের অজস্র ‘ডিভাইস’, যান্ত্রিক কলা কৌশল প্রযুক্তির বিভিন্ন প্রয়োগ, চিকিৎসা যেমন সহজ করেছে তেমনি সংকুচিত হয়ে এসেছে রোগী-ডাক্তার পারস্পরিক আস্থার যায়গা। টেলিমেডিসিনিন, ভার্চুয়াল চিকিৎসা, হোয়াটসঅ্যাপ যাই বলিনা কেন কোথায় যেন একটি অতৃপ্তি থেকে যায় রোগী-চিকিৎসক দুই পক্ষেরই। ডাক্তার বাড়িতে বসে কম্পিউটার, ল্যাপটপ, মোবাইলে রোগীর কথা শুনে, চেহারা দেখে (তাও আবার একজন ডাক্তারের মধ্যস্ততায়) চিকিৎসা পত্র দেন। এতে করে রোগী-ডাক্তার সরাসরি কথা, স্পর্শ, আশ্বাস, বিশ্বাস সব কিছুতেই রয়ে যায় দোলাচল।

চিকিৎসার এই ধরন-ধারণ অতিমারি করোনার কারণে এখন অনেক ব্যাপকতা লাভ করেছে। প্রযুক্তির ব্যবহারে নিজেদের নিরাপদ রেখে চিকিৎসকরা যা করছেন তা সময়ের প্রয়োজনে ‘যথেষ্ট’। একদম হাত পা গুটিয়ে বসে না থেকে তাঁরা যে মুখের কথাটা রোগীকে শুনাতে পারছেন, ওষধ, পথ্যের নির্দেশনা দিচ্ছেন তা অবশ্যই প্রয়োজনীয় ও প্রশংসনীয়।

Advertisement

প্রথিতযশা, স্বনামধন্য একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক যিনি দেশের মিডিয়া জগতের নানা মাধ্যমে ডেঙ্গু ও সাম্প্রতিক করোনা দুর্যোগের সময় চিকিৎসা বিষয়ক জটিল বিষয় গুলোকে সহজ সরল কথা মালা দিয়ে উপস্থাপন করে আমজনতার মন জয় করেছেন। প্রাণান্তকর প্রয়াস চালাচ্ছেন মানুষকে স্বাস্থ্যের বিধিবিধান মানাতে। তিনি অতি সম্প্রতি একদিন হাসপাতালের করিডোরে আমার সামনেই সদ্য বিএসএমএমইউ থেকে সদ্য অবসর প্রাপ্ত একজন শিশু স্নায়ু রোগ বিশেষজ্ঞকে বলছিলেন, যে ভাবে ‘দূর চিকিৎসা’ পদ্ধতিতে কাজ করছেন এতে সত্যিকার ডাক্তারি হয় না। ফি-ও তো কম নেন না। অন্ততঃ ফি-টা কম নেন। মানুষের এই সংকটকালে যত মানবিক হওয়া যায় ততই মঙ্গল। যিনি এই কথা গুলো বলছিলেন, তিনি ফি নেন রোগী প্রতি মাত্র ৩০০ টাকা। তাঁর নাম প্রফেসর ডা. এ বি এম আব্দুলাহ্।

জীবনের ভয় কার না আছে। সবাই বাচঁতে চায় এই সুন্দর ভুবনে মানুষের মাঝে। এই মানুষই যদি না থাকে, তাহলে কাদের নিয়ে বেঁচে থাকা। বৃক্ষ-লতা-গুল্ম-ফুল-পাতা, দীঘি-নদী-নালা, হ্রদ সমুদ্র পর্বতমালাÑ এসব কিছুই নিজ নিজ সৌন্দর্যে পেখম মেলে পৃথিবী আলোকিত করবে আর ‘মানুষ’ চলে যাবে অনন্তলোকে তা’কি হয়! আর হয় না বলেই মানুষ বাঁচানোর দায় কাঁধে নিয়ে এই ঘোর অন্ধাকার দুর্দিনে মাঠে নামতে হয়েছে চিকিৎসকদের। তাঁরা মাঠে আছেন, থাকবেনও। তাঁদের সাথে আরও আছেন স্বাস্থ্য সেবার অন্যান্য স্তরের কর্মী বাহিনী। এরা প্রত্যক্ষ করোনা যোদ্ধা। এদের স্যালুট, হাজারো অভিবাদন। এদের কাজে কর্মে উৎসাহিত করা অতি আবশ্যক। হায়-হুতাশ! কোথায় সে উদ্দ্যোগ। সরকারী-বেসরকারি সব তরফই নিরব।

ভারতে নরেন্দ্র মোদি সরকার করোনার প্রথম ঢেউয়ের সময় বেশ কিছুদিন সন্ধ্যা লগ্নে শঙ্ক বাজিয়ে, উলুধ্বনি দিয়ে, কাসা-পিতলের বাদ্য-বাজনায় করোনা চিকিৎসায় নিবেদিত ডাক্তার ও অন্যান্যদের উৎসাহিত করতে নাগরিকদের উদ্বুদ্ধ করেছেন। ইতালিতেও ঘর বন্দি লোকজন নেচে-গেয়ে, হাত তালি দিয়ে অভিনন্দিত করেছেন করোনাযোদ্ধা স্বাস্থ্যকর্মীদের।

এবারের করোনা দ্বিতীয় ঢেউয়ে ভারতের জেরবার অবস্থার মধ্যেও হেলিকপ্টার থেকে ফুল ছিটিয়ে করোনা যোদ্ধাদের সম্মানিত করা হয়েছে। আমাদের দেশে খোদ স্বাস্থ্যমন্ত্রী গত ২৭ এপ্রিল সংবাদ সম্মেলনে চিকিৎপেশার লোকজনদের কেউ তাদের কাজের জন্য অভিনন্দিত করেন না বলে আক্ষেপ করেছেন। করোনা মহামারির দেড়বছরে আক্রান্ত রোগীদের সেবা দিতে গিয়ে প্রাণ দিয়েছেন ১৫৫জন চিকিৎসক।

Advertisement

এছাড়া দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে মারা গেছেন ১২জন নার্সসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী। এ পরিসংখ্যান ডাক্তারদের জাতীয় সংগঠন বাংলাদেশ মেডিক্যাল এসোসিয়েশন (বিএমএ) দেওয়া। এই মুহূর্তে করোনার ভয় ভীতি উপেক্ষা করে পরিবার পরিজন থেকে বিছিন্ন হয়ে ডাক্তার নার্সসহ যেসব স্বাস্থ্যকর্মী করোনা চিকিৎসায় নিজেদের নিয়োজিত রেখেছেন তাঁদের এই কর্মে স্বতঃস্ফুর্ততা, উদ্দীপনা আনার তাগিদ অনুভব করছেন না কেউই। করোনাকালে এটি একটি করুণ বিষয়।

লেখক : উপ-পরিচালক ডাইরেক্টর, সেন্ট্রাল হসপিটাল লি. ধানমন্ডি, ঢাকা।

এইচআর/জিকেএস