মতামত

শান্তিচুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন জরুরি

শুরু হলো বিজয়ের মাস ডিসেম্বর। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে এক বিশাল উত্তরাধিকার, ব্যাপ্ত দেশপ্রেম ও বিজয়ের মুকুট সঙ্গে নিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের পদচারণা শুরু হয়েছিল। সেসময় মুক্তিযুদ্ধের সাফল্যে পাকিস্তানি ও তাদের দোসর রাজাকার-আলবদরদের সকল ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন হয়ে যায়। এই ডিসেম্বর মাসেই (১৯৯৭ সালে) আরেক বিজয়বার্তা বহন করে আনে পার্বত্য শান্তি চুক্তি। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীকালে আমাদের সমাজে যেমন শান্তি ফিরে এসেছিল ঠিক তেমনি ১৯৯৭ সালের পর অশান্ত পার্বত্য জীবনে স্বস্তি ফিরে আসে। তবে প্রতি বছর ২রা ডিসেম্বর এলেই পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের জন্য ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর পক্ষ থেকে সরকারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ উত্থাপন করা হয়। চলতি বছর ২৮ নভেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তির ১৮তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে এক সংবাদ সম্মেলনে পাহাড়ের অবস্থা ‘নাজুক’ বলে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন জনসংহতি সমিতির সভাপতি সন্তু লারমা। শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন না করায় পার্বত্য অঞ্চলের সামগ্রিক পরিস্থিতি অত্যন্ত নাজুক হয়ে পড়েছে বলে দাবি তাঁর। জুম্ম জনগণের বঞ্চনা ও আশা-আকাক্ষার প্রতি কোনো তোয়াক্কা না করে এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের পরিবর্তে সরকার রাষ্ট্রযন্ত্র ও অস্ত্র শক্তি ব্যবহার করে স্থানীয়দের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে দমন পীড়ন করছে বলেও তিনি অভিযোগ করেন। সন্তু লারমার এই হুঁশিয়ারির কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই। তবে আমরা শান্তিচুক্তির পরিপূর্ণ বাস্তবায়নের পক্ষে।অন্যদিকে জুম্ম জনগণের মধ্যে ‘আদিবাসী বনাম উপজাতি’ বিতর্ক উস্কে দেয়া হয়েছে। যা একেবারে অবাঞ্চিত। কারণ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর উন্নয়নে অঙ্গীকারবদ্ধ হয়ে ১৯৭২ সালের ২২ জুন আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) প্রণীত ‘ইন্ডিজেনাস অ্যান্ড ট্রাইবাল পপুলেশনস কনভেনশন, ১৯৫৭’ (কনভেনশন নম্বর ১০৭)-এ অনুস্বাক্ষর করেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নৃতাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠী ও ট্রাইবাল জাতিগোষ্ঠীর আত্মপরিচয়সহ তাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার রক্ষার জন্য জাতিসংঘের এ সংস্থা আবার সংশোধিত ‘ইন্ডিজেনাস অ্যান্ড ট্রাইবাল পপুলেশনস কনভেনশন ১৯৮৯’ (কনভেনশন নম্বর ১৬৯) গ্রহণ করেছে। এ দুটি গুরুত্বপূর্ণ আইনি দলিল জাতীয় পর্যায়ে উপজাতিদের অধিকারকে প্রতিষ্ঠা ও কার্যকর করার জন্য প্রয়োজনীয়। এখানে ট্রাইবাল বা সেমিট্রাইবাল বলতে ওই গোষ্ঠী ও ব্যক্তিদের বোঝানো হয়েছে, যারা তাদের ট্রাইবাল বৈশিষ্ট্য হারানোর প্রক্রিয়ায় রয়েছে এবং এখনো জাতীয় জনসমষ্টির সঙ্গে একীভূত হয়নি। বঙ্গবন্ধুর অনুসৃত পথে অগ্রসর হয়ে বর্তমান সরকার পার্বত্য শান্তিচুক্তির মাধ্যমে পাহাড়ি অধিবাসীদের আর্থ সামাজিক অবস্থার উন্নয়নে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। অবশ্য কয়েকটি মৌলবাদ-সমর্থিত মিডিয়া পার্বত্য অঞ্চল নিয়ে বাঙালি জনগোষ্ঠীকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।গত কয়েক বছর ধরে অধিকাংশ জাতীয় দৈনিকে ইউপিডিএফের সদস্যদের অস্ত্রসহ আটকের সংবাদ ছাপানো হয়েছে। পার্বত্যচুক্তি বিরোধী ‘ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টে’র(ইউপিডিএফ) সদস্যদের এ ধরনের তৎপরতা এখনও বহাল রয়েছে রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে। প্রকাশ্যে তারা বর্তমান সরকারের চুক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায় ও নিন্দা প্রকাশ করে। এছাড়া জনসংহতি সমিতির সঙ্গে রয়েছে তাদের দ্বন্দ। পরস্পর পরস্পরের কর্মী হত্যাকান্ডের বিবাদেও জড়িত। অন্যদিকে প্রতি বছর নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে জনসংহতি সমিতির চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় (সন্তু) লারমা পার্বত্য শান্তিচুক্তি অনুসারে উপজাতিদের অধিকার সংরক্ষণের দাবি জানিয়ে আসছেন। শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নে বিভিন্ন মহলের দাবি থেকে স্পষ্ট যে চুক্তিটির গুরুত্ব এখন অপরিসীম। কিছুদিন আগে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. মিজানুর রহমান একটি সেমিনারে বলেছেন, ‘দেশের সব নাগরিক সমানভাবে নাগরিক অধিকার পাচ্ছে না- এটা বাস্তবতা।’ বাংলাদেশের মতো রাষ্ট্রে সবাইকে সমান সুবিধা দেওয়া সম্ভব নয়। সমতলের মানুষ যে সুযোগ পাচ্ছে, সেই সমান সুযোগ পাহাড়ের মানুষ পাবে না। সবাইকে সমান সুযোগ দেওয়ার সামর্থ্য বাংলাদেশের নেই। এসব সীমাবদ্ধতার মধ্যেও সরকারের পক্ষ থেকে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এই পদক্ষেপগুলো অবশ্যই শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের অংশ। বিশেষ অঞ্চল বলেই দেশের মধ্যে কেবল পার্বত্য চট্টগ্রামে পৃথক মন্ত্রণালয় গঠিত হয়েছে। একজন প্রতিমন্ত্রী সেখানকার সকল বিষয় দেখভাল করার জন্য নিয়োজিত রয়েছেন। ১৪৫টিরও বেশি এনজিও পুরো পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়নের জন্য নিরলসভাবে কাজ করছে। সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার উন্নয়নের ধারা অব্যাহত আছে কেবল শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন হচ্ছে বলেই।  রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানের উন্নয়নের জন্য বছর বছর মোটা অঙ্কের অর্থ বরাদ্দ হচ্ছে। তবে সরকারের গৃহীত প্রকল্পের শতকরা ৯০ ভাগ উপজাতীয়রা এবং ১০ ভাগ বাঙালিরা অংশগ্রহণ করেন। অর্থাৎ সিংহভাগ ব্যয় হয় উপজাতিদের উন্নয়নের জন্য। এক্ষেত্রে আমাদের অভিমত হলো, উপজাতীয় এবং অ-উপজাতীয়দের উন্নয়ন ভারসাম্য বজায় রাখা জরুরি। আর্থ-সামাজিক ভারসাম্য বজায় না থাকলে তা দেশের সার্বিক নিরাপত্তা পরিস্থিতির উপর চাপ সৃষ্টি করে থাকে। মূলধারার রাজনীতি চালু থাকলে সেখানকার সামগ্রিক উন্নয়নের বিষয় সর্বাগ্রে প্রাধান্য পেত। এজন্য পার্বত্য অঞ্চলে উন্নয়ন কার্যক্রমে সর্বদা একটা বৈষম্য দেখা যায় বলেই মাঝেমধ্যে পাহাড়ি-বাঙালি সংঘর্ষ লেগে যায়। উল্লেখ্য, পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে সকল নাগরিকের রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষা ও অর্থনৈতিক অধিকার সমুন্নত এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করা এবং বাংলাদেশের সকল নাগরিকের স্ব-স্ব অধিকার সংরক্ষণ ও উন্নয়নের লক্ষ্যে শান্তিচুক্তি সম্পাদিত হয়েছিল।  শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের পর পার্বত্য জেলায় এখন পর্যন্ত কোনো ধরনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। এর প্রধান কারণ হিসেবে চুক্তি অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রামে পৃথক নির্বাচন বিধি না থাকাকে দায়ী করা হয়েছে। পৃথক নির্বাচন বিধি থাকার প্রধান অসুবিধা হচ্ছে এর ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থায়ী বাসিন্দা ছাড়া কেউ ভোটার হতে পারবে না যা সংবিধানের ১২১ ধারা এবং ১২২ ধারার (ভোটার হবার যোগ্যতা) পরিপন্থী। যেখানে দেশের নারী অথবা শিশু অথবা অনগ্রসর শ্রেণির উন্নতির জন্য যে কোনো বিশেষ ধারা সংযোজন অথবা পরিবর্ধন বা পরিমার্জন করা যাবে যা অত্যন্ত স্বাভাবিক এবং প্রচলিত বিধানের আলোকেই বিধৃত হয়েছে। উল্লেখ্য, কেবলমাত্র পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসরত উপজাতিরাই বাংলাদেশে একমাত্র অনগ্রসর জাতি নয় ।উপরন্তু মনে রাখা দরকার, সংবিধানের আলোকে কোনোভাবেই একের অধিক নির্বাচন বিধি থাকার অবকাশ নেই। আমাদের নির্বাচন বিধি দেশে ও বিদেশে ব্যাপকভাবে সমাদৃত। এটা অত্যন্ত সুখের বিষয় যে আমাদের শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াকে সরকার ত্বরান্বিত করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। বর্তমানে সেখান থেকে সেনা প্রত্যাহার একটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি। শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের এ সন্ধিক্ষণে একটি জেলা পরিষদ নির্বাচনের আয়োজন করা খুবই গুরত্বপূর্ণ। কারণ নির্বাচিত পরিষদ এসে চুক্তির অনেক বিষয় নিয়ে আলোচনা ও পর্যালোচনার মাধ্যমে জটিলতা দূর করে তা বাস্তবায়নের পথ সুগম করতে পারে। নির্বাচনের আইন প্রণয়ন এবং এর প্রয়োগের দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। যেহেতু এই আইন এখনো  প্রণীত হয়নি সেহেতু সন্তু লারমার নির্বাচন নিয়ে আলোচনার সুযোগ রয়েছে। যা আলোচনার মাধ্যমে প্রচলিত রীতির আলোকে হতে পারে। জাতীয় সংসদ নির্বাচন-২০১৪ এবং উপজেলা নির্বাচন-২০১৪ বর্তমান ভোটার তালিকায় এবং নির্বাচন কমিশনের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়। অতএব পার্বত্য জেলা পরিষদ নির্বাচনও উক্ত ভোটার তালিকায় করা সম্ভব। যেহেতু বর্তমান পরিষদ সাময়িক সময়ের জন্য গঠিত সেহেতু তাদের বিভিন্ন কার্যবিভাগ নিয়ন্ত্রণে সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এ জন্য আমাদের সকলের জন্য অতিসত্ত্বর একটি নির্বাচন আয়োজন করা জরুরি। জেলা পরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে, নির্বাচিত প্রতিনিধি দায়িত্ব গ্রহণ করলে তখন সরকার উক্ত পরিষদের বিস্তৃতি এবং কর্মদক্ষতা মূল্যায়ন করে ধাপে ধাপে বাকী কার্যবিভাগ হস্তান্তরের বিষয়টি বিবেচনা করতে পারে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নে অতীতের মতো এখনও নিরলসভাবে কাজ করে চলেছে। সরকারের আন্তরিক প্রয়াসের কারণে তিন পার্বত্য জেলার উপজাতি-বাঙালিদের জীবনমান উন্নয়নে ব্যাপক কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। পাশাপাশি সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় দেশি-বিদেশি এনজিও কাজ করে যাচ্ছে সেখানকার জনগোষ্ঠীর ভাগ্যোন্নয়নে। এতে করে বাঙালি জনগোষ্ঠীর তুলনায় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাগ্যোন্নয়ন ঘটেছে অনেক বেশি। এমতাবস্থায়, পাহাড়ে শান্তি-শৃংখলা রক্ষার্থে সর্বোপরি শান্তিচুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করার লক্ষ্যে উপজাতি-বাঙালি ঐকমত্যের ভিত্তিতে সরকারকে সার্বিকভাবে সহযোগিতা প্রদান করা উচিত। সেখানকার বাঙালিদের নিয়ে একসঙ্গে কাজ করার বিষয়ে সন্তু লারমাকেও মনোযোগী হতে হবে। তাহলেই কেবলমাত্র দ্রুত শান্তিচুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন সম্ভব।লেখক :  অধ্যাপক  এবং পরিচালক, জনসংযোগ, তথ্য ও প্রকাশনা দপ্তর, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়এআরএস/এমএস

Advertisement