প্রাচ্যের বাতিঘর খ্যাত দেশের সবচেয়ে প্রাচীন উচ্চ শিক্ষালয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সুদীর্ঘ ৯৪ বছর পেরিয়ে পা দিয়েছে গৌরবের ৯৫ বছরে। সময়ের আবর্তনে বেড়েছে এর শিক্ষার্থী সংখ্যাও। মাত্র ৮৭৭ জন শিক্ষার্থী নিয়ে যাত্রা শুরু করা দেশের সর্বশ্রেষ্ঠ এ বিদ্যাপীঠটির বর্তমান শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৩৭ হাজার ছাড়িয়ে। চালু হয়েছে নতুন নতুন বিভাগও। কিন্তু আনুপাতিক হারে বাড়েনি এর আবাসন ব্যবস্থা। যার দরুণ শতবর্ষে পা রাখতে যাওয়া এ বিদ্যাপীঠটি এখনো জর্জরিত তীব্র আবাসন সংকটে।অন্যদিকে হলগুলোতে বহিরাগত ও মেয়াদোত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের দাপটের সঙ্গে অবস্থান আবাসন সংকটকে আরো তীব্র থেকে তীব্রতর করছে। সরকারি দলের ছাত্র সংগঠনের নেতাদের ছত্র-ছায়ায় এরা হলে থাকছে বলে অভিযোগ রয়েছে।বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবন, জনসংযোগ দফতর ও হল অফিসগুলোর সূত্রে জানা গেছে, সর্বশেষ রেকর্ড অনুযায়ী (জুলাই ২০১৫) বিশ্ববিদ্যালয়ের ১১টি ইনস্টিটিউট ও ১৩টি অনুষদের অধীনে বর্তমানে এর নিয়মিত ছাত্র-ছাত্রীর শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৩৭ হাজার ৬৪ জন। ভর্তি প্রক্রিয়া সমাপ্ত না হওয়ায় উল্লেখিত রেকর্ডে ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি ছয় হাজার ৬৮৫ জন শিক্ষার্থীর হিসাব দেয়া সম্ভব হয়নি। ২০টি আবাসিক হল ও তিনটি হোস্টেল অফিস থেকে পাওয়া তথ্য মতে, বর্তমানে এগুলোতে আবাসন ব্যবস্থা রয়েছে ১৫ হাজার ২৫৯ জনের। সে হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে বর্তমানে ৪১ দশমিক ১৭ শতাংশ শিক্ষার্থীর আবাসন ব্যবস্থা রয়েছে। বাকি ৫৮ দশমিক ৮৩ শতাংশ শিক্ষার্থীর আবাসন ব্যবস্থা নেই।২০টি হলের দেয়া তথ্য মতে, সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে ৪০৫টি, শহীদুল্লাহ হলে দ্বৈতাবাসিকসহ এক হাজার ২৩০টি, জগন্নাথ হলে এক হাজার ২৬৫টি, ফজলুল হক মুসলিম হলে ৭৬৬টি, শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলে ৭২৫টি, রোকেয়া হলে এক হাজার ৫৪৭টি, মাস্টার’দা সূর্যসেন হলে ৫৭৭টি, হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলে ৫৪০টি, শামসুন নাহার হলে ৬৮৮টি, পল্লী কবি জসিম উদ্দীন হলে ৩৯৭টি, স্যার এ এফ রহমান হলে ৪৯৬টি (বর্ধিতাংশ শাহনেওয়াজ হলসহ), মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলে ৪৮৪টি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলে ৪৫০টি, বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী হলে ৬৭১টি, স্যার পি জে হার্টগ ইন্টারন্যাশনাল হলে ১২২টি (বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগ ও ইনস্টিটিউটে অধ্যয়নরত ১৩ জন, বাকি ১০৯ জন ছাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত), অমর একুশে হল ৬৯৩টি, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলে ৩৩০টি, কবি সুফিয়া কামাল হলে এক হাজার ৭০০টি, বিজয় একাত্তর হলে এক হাজার ৩৬১টি এবং কৃতি অ্যাথলেট সুলতানা কামাল হলে ১৫০টি আসন রয়েছে।বাকি তিনটি ছাত্রাবাসের মধ্যে নবাব ফয়জুন্নেসা চৌধুরাণী ছাত্রীনিবাস ১৬০টি, আইবিএ হোস্টেলে ১৩৬টি এবং ড. কুদরত-ই-খুদা হোস্টেলে ৩৩৬টি আসন রয়েছে।অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি হলে বর্তমানে ধারণ ক্ষমতার দ্বিগুণ থেকে তিনগুণ শিক্ষার্থী হলে অবস্থান করছে। এছাড়াও ছাত্রলীগের ছত্রছায়ায় হলগুলোতে বহিরাগত ও মেয়াদোত্তীর্ণ শিক্ষার্থীরা হলে দাপটের সঙ্গে অবস্থান করছেন। বিভিন্ন সময় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বহিরাগতদের হল থেকে বের করে দিলেও পরবর্তীতে তারা আবারও হলে ওঠে। আবার মেয়াদোত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের হল থেকে বের করে দিতে গেলে বিভিন্ন দিক থেকে চাপ দেয়া হয় হল প্রশাসনকে। যার কারণে এদের বের করা যায় না।আর তাই আবাসন সুবিধার চেয়ে শিক্ষার্থী সংখ্যা বেশি হওয়ায় নিয়মিত শিক্ষার্থীদের একটি অংশকে হলগুলোতে গাদাগাদি করে বাস করতে হচ্ছে। আবার কেউ কেউ দারিদ্রতা ও কষ্ট নিয়ে রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় থেকে পাঠকার্য চালিয়ে যাচ্ছে। সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক গোলাম মোহাম্মদ ভূঁইয়া জাগো নিউজকে বলেন, ‘বহিরাগতদের আমরা বিভিন্ন সময় হল থেকে বের করেছি। কিন্তু তিন-চার মাস পর তারা আবারও হলে ওঠে বড় ভাইদের (ছাত্রলীগ) ইশারায়। তাছাড়া মেয়াদোত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে কয়েকজন রয়েছে যাদের আমরা হল থেকে বের করতে গেলে বিভিন্ন জায়গা থেকে কল আসা শুরু হয়। যার কারণে একেবারে বহিরাগতমুক্ত করা সম্ভব হচ্ছে না। তবে আমাদের চেষ্টা অব্যহত রয়েছে।’আর এসব কারণে হলগুলোতে তৈরি হয়েছে গণরুম নামক ‘খাদা-কক্ষ’। জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের সূর্যসেন হলে অন্তত ১২টি, এ এফ রহমান হলে ৫টি, জহুরুল হক হলে ১০টি, মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলে ৮টি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলে ৯টি, কবি জসীমউদ্দীন হলে ১১টি, হাজী মুহাম্মদ মুহসীন হলে ১৩টি, রোকেয়া হলে ২টি, কুয়েত মৈত্রী হলে ৪টি এবং ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলে ৩টি গণরুম রয়েছে। যেখানে প্রতিটি রুমে ২০ থেকে ২৫ জন করে থাকতে হয় শিক্ষার্থীদের। সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে তৈরি হয়েছে হলের বারান্দায় থাকার বৈধ সংস্কৃতি। থার্ড ইয়ারে গিয়েও এরা হলে কোনো রুম না পেয়ে হলের বারান্দায় শীত, বর্ষা ও গ্রীষ্মে মানবেতর জীবন-যাপন করছেন।এছাড়াও সূর্যসেন, মুহসীন ও এফ রহমান হলের শিক্ষার্থীরা রাতের বেলায় হলের ছাদে মানবেতর জীবন-যাপন করছেন। সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের শিক্ষার্থীরা রাত কাটান হলের মসজিদে।এ সমস্ত অস্বস্তিকর পরিবেশে শিক্ষার্থীরা শিক্ষার উপযুক্ত পরিবেশ পাচ্ছেন না। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে হল প্রশাসনের দুর্বলতার সুযোগে সরকারি দলের ছাত্র সংগঠনের দৌরাত্ম। হলে ছাত্র উঠানো-নামানো সব তদারকিই তাদের। ছাত্রছাত্রীদের নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলে থাকতে হয় রাজনৈতিক মিছিল-মিটিংয়ে অংশগ্রহণ করার বিনিময়ে। অন্যদিকে বৈধ-অবৈধ সব শিক্ষার্থীর হলে থাকা-না থাকা সম্পূর্ণ নির্ভর করছে এসব নেতাদের হাতে। তাছাড়া কয়েকটি হলের ছাত্রলীগ নেতারা হলে চালিয়ে থাকেন সিট-বাণিজ্য। তাদেরই ছত্রছায়ায় থাকে বহিরাগতরা। বিনিময়ে মোটা অংকের টাকা নিয়ে থাকেন এসব নেতারা। যার দরুণ সিট বণ্টনে নানা ধরনের বৈষম্যের শিকার হলেও ভয়ে মুখ খুলতে পারেন না কোনো শিক্ষার্থী। আবার সরকারি দলের ছাত্র সংগঠনের এমন অসাধু কাজে কোনো ধরনের নাক গলাতে নারাজ হলগুলোর প্রাধ্যক্ষরা। কয়েকটি হলের প্রাধ্যক্ষরা এ নিয়ে একটু নাড়াচাড়া দিলেও সর্বশেষ টিকতে পারেন না।নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক প্রাধ্যক্ষ জাগো নিউজকে বলেন, ‘কেন তাদের (ছাত্রলীগ) কিছু করা যায় না এটা তোমাদেরও জানা আমাদের জানা। যদি আমি আজ তাদের এসব অপকর্মের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে থাকি তাহলে আগামীকাল থেকে আমাকে আর প্রাধ্যক্ষের চেয়ারে থাকা লাগবে না।’শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, হল প্রশাসনের তদারকির অভাবের কারণে হলের সিট বণ্টনে এ ধরনের বৈষম্যের শিকার হতে হয় তাদের। এর প্রভাব পড়ছে তাদের পড়াশোনা থেকে শুরু করে সামগ্রিক জীবনযাত্রায়। ফলে উচ্চশিক্ষা গ্রহণে বেগ পেতে হচ্ছে অনেক মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তানদের।জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক জাগো নিউজকে বলেন, ‘আবাসন সংকট নিরসনে আমরা বিভিন্ন সময় উদ্যোগ নিয়েছি। সে হিসেবে নতুন করে বিজয় একাত্তর ও সুফিয়া কামাল হল নির্মাণ করা হয়েছে। এসব হল নির্মাণে আগের তুলনায় এ সমস্যা কমিয়ে আনা সম্ভব হচ্ছে। আমরা সব শিক্ষার্থীর আবাসন সংকট নিরসন করতে পারবো না তবে আমাদের চেষ্টা অব্যহত আছে আবাসন সংকট কমিয়ে আনার।’এমএইচ/এসএইচএস/বিএ
Advertisement