কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাচ্ছে টাঙ্গাইলের কাসা-পিতলের শিল্প। যুগ যুগ ধরে ব্যবহার্য ঐতিহ্যবাহী কাসা-পিতলের তৈরি তৈজসপত্র আজ প্রায় বিলুপ্তির পথে। প্রয়োজনীয় কাঁচামাল, বাজার ব্যবস্থাপনা এবং কারিগরের অভাবে এ শিল্প মুখ থুবড়ে পড়েছে। অধিক পরিশ্রম, কম মজুরি ও বিক্রি এবং লাভ না হওয়ায় অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত কারিগররা। এক সময় টাঙ্গাইলে ৩০/৪০টি মহাজনি দোকান ছিল। এখন এর সংখ্যা ৩টি। যেসব দোকানিরা অন্য পেশায় যেতে পারেনি তারা কোনো রকমে টিকে আছেন। টাঙ্গাইল সদরের কাগমারীর পাতুলীপাড়া, বাঘীল, চাড়াবাড়ী, দশকিয়া ও অয়নাপুর কাসা-পিতল শিল্পের জন্য ছিল বিখ্যাত। শত শত কর্মকার এ পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। এ অঞ্চলের কর্মকারদের তৈরি কাসা-পিতলের তৈরি জিনিসের কদর ছিল দেশব্যাপী।সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, কারিগর ও ব্যবসায়ীরা ক্রেতার অভাবে এ ব্যবসা থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেয়ার চিন্তা করছেন। টাঙ্গাইল মেইন রোডের কাসা-পিতল ব্যবসায়ী হারাধন রায় (৫৫) বলেন, আমার বাব-দাদার আমলের ব্যবসা আমি ধরে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছি। কিন্তু কোনো ক্রেতা যদি না আসে তাহলে আমি কিভাবে ব্যবসাটি টিকিয়ে রাখবো। তিনি আরো বলেন, আধুনিক যুগে প্লাস্টিক, স্টিল, মেলামাইনের তৈরি জিনিসের চাহিদা বেশি, দামও অনেক কম, মানুষ সস্তায় কিনতে পরে। অপরদিকে কাসা-পিতলের তৈরি জিনিসের দাম বেশি এবং ওজনও বেশি তাই ক্রেতাদের আগ্রহ কম। আমার যদি অন্য উপায় থাকতো তাহলে এ ব্যবসা অনেক আগেই ছেড়ে দিতাম।কাসাপল্লী খ্যাত টাঙ্গাইলের কাগমারী পাতুলী পাড়ায় এক সময় কারখানায় কারিগরদের কর্মব্যস্ততা ছিলো চোখে পড়ার মতো। সেখানে এক সময় দেড়শর অধিক কারখানা ছিল এবং হাজারের অধিক কর্মচারী জীবন নির্বাহ করতো। এখন সেখানে মাত্র দুইটি কারখানায় ছয়জন কারিগর কাজ করতে দেখা যায়। দুলাল চন্দ্র কর্মকার (৫৮) জাগো নিউজকে জানান, বাজারে বেচা বিক্রি নাই, মহাজনে অর্ডার না দিলে আমরা তৈরি করে কি করমু। বাব দাদার আমলের পেশা কোনো রকমে ধইরা আছি। এদিকে কাঁচামাল কিনতে গেলে পুলিশ ধরে, কয়লার গাড়ি দেখলে স্থানীয় বখাটেদের টাকা দিয়ে তারপর গাড়ি থেকে নামাতে হয়। আমি আমার ছেলেদের অন্য পেশায় দিছি। আমি যে কষ্ট করলাম আমার পোলাপাইন যেন কষ্ট না করে। রাম প্রশাদ কর্মকার বলেন, আমি এখন আর কাঁচামাল গালাইনা। আমি পুরাতন জিনিস মেরামত করি। মহাজনদের কাছ থেকে কিনে এনে তা মেরামত করে আবার তাদের কাছেই দেই। এতে করে যে লাভ হয় তা দিয়েই কোনো রকমে সংসার চলে।সদর উপজেলার বাঘিল এলাকার সুবল চন্দ্র কর্মকার (৭৫) বলেন, আমাদের এখানে দুই-শতাধিক কাজ করতো এখন ৪/৫ জন এ শিল্পের সঙ্গে যুক্ত আছেন। আমার বাব-দাদার পেশা ছিল এটি, আমিও এ পেশায় যুক্ত ছিলাম, কিন্তু বাদ দিচ্ছি, ছেলেদের অন্য পেশায় দিচ্ছি। তার ভাষায়, গতর খাটনের কাম কিন্তু পয়সা নাই। একদিন কাম করলে ৩/৪দিন বইসা থাকন লাগে। মহাজনরা অর্ডার দেয়না, বাজারে মানুষ না কিনলে বানিয়া কি করমু।প্রয়োজনীয় বাজার সৃষ্টি হলে এবং কাঁচামালের যোগান বাড়াতে পারলে এ শিল্পকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব। নয়তো হারিয়ে যাবে এ শিল্প এমনটাই মনে করছেন এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত ব্যবসায়ী ও কারিগররা।এআরএ/আরআইপি
Advertisement