শিক্ষা

পড়ালেখা ভুলতে বসেছে গ্রামের শিশুরা

করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) মহামারির কারণে প্রায় ১৪ মাস ধরে বন্ধ সারাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। অনাকাঙ্ক্ষিত এই দীর্ঘ ছুটিতে উচ্চতর শ্রেণির শিক্ষার্থীরা নানাভাবে ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারলেও প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীরা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অনেকের বাড়িতে পড়াশোনার তেমন সুযোগ না থাকায় আত্মস্থ বিদ্যা ভুলতে বসেছে শিশুরা। অনেক শিক্ষার্থী আবার পড়াশোনা ছেড়ে নানা ধরনের পেশায় নিযুক্ত হচ্ছে। এতে করে ঝরে পড়ার হার বৃদ্ধির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এ কারণে যেসব জায়গায় করোনার প্রাদুর্ভাব কম সেখানে অন্তত সপ্তাহে একদিন প্রাথমিক বিদ্যালয় খুলে শিক্ষার্থীদের ক্লাস নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন অভিভাবক-শিক্ষকরা।

Advertisement

এদিকে, করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আগামী ২৩ মে থেকে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে সরকার। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকাকালে শিক্ষার্থীদের জন্য সংসদ টিভি এবং রেডিওর পাশাপাশি স্থানীয়ভাবে শিক্ষকদের মাধ্যমে বিভিন্ন অনলাইন প্ল্যাটফর্মে পাঠদানের চেষ্টা দেখা গেছে। চলতি বছরেও টেলিভিশন এবং বেতারে পাঠদান অব্যাহত আছে।

তবে বাস্তবতা হচ্ছে ইন্টারনেটের ধীরগতি, বাড়িতে টেলিভিশন-রেডিও না থাকাসহ নানা প্রতিবন্ধকতায় এই উদ্যোগের সুফল সবার কাছে পৌঁছায়নি। বিশেষ করে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ এ সুবিধা থেকে বঞ্চিত। শুধু শহর পর্যায়ের কিছু বেসরকারি বিদ্যালয়ে কোনোরকমে এ কার্যক্রম অব্যাহত আছে।

বিভিন্ন জেলার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বেশ কয়েকজন শিক্ষকের সঙ্গে আলাপ করলে তারা জানান, দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অনেকে পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছে, অনেকে আবার যা পড়েছে তা ভুলে যাচ্ছে। করোনাভাইরাস সংক্রমণ এড়াতে বিদ্যালয় বন্ধ রাখা হলেও শিক্ষার্থীরা দিনভর বাইরে খেলাধুলা করেই সময় কাটাচ্ছে। ভার্চুয়াল ক্লাসের প্রতি তাদের আগ্রহ তৈরি করা সম্ভব হয়নি। অনেক শিক্ষার্থীর বাসায় টেলিভিশন না থাকায় তারা একেবারেই এর সঙ্গে যুক্ত হতে পারছে না। ভার্চুয়াল মাধ্যমে ক্লাসের সুবিধা কেবলই শহরভিত্তিক হয়ে পড়েছে।

Advertisement

শিক্ষকদের মতে, দেশের সব জেলায় সমানভাবে করোনাভাইরাস সংক্রমণ ছড়ায়নি। যেহেতু মফস্বল ও দুর্গম এলাকার শিশুরা বর্তমানে শিক্ষা থেকে একেবারে পিছিয়ে পড়েছে, তাই সেসব এলাকায় সপ্তাহে অন্তত একদিন বিদ্যালয় খুলে ক্লাস নেওয়া যেতে পারে। অভিভাবকরা বারবার ফোন করে কবে বিদ্যালয় খুলবে তা জানতে চান। দ্রুত ক্লাস শুরুরও অনুরোধ জানাচ্ছেন তারা।

বাংলাদেশ প্রাথমিক বিদ্যালয় সহকারী শিক্ষক অনলাইন সমিতির সাধারণ সম্পাদক ফরিদ আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, শিক্ষার্থীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে পড়ানোর চাইতে সপ্তাহে একদিন বিদ্যালয়ে ক্লাস নেওয়া অনেক ভালো। বাসায় বসে অনেক শিক্ষার্থীর পড়ালেখা করার সুযোগ নেই, অনেকে আবার বিদ্যালয় খোলা না থাকলে পড়ালেখা করতে চাচ্ছে না বলে স্কুল খুলে দিতে অভিভাবকরা অনুরোধ জানাচ্ছেন। অনেক শিক্ষকও দীর্ঘদিন অবসর সময় কাটানোর কারণে বিদ্যালয় খোলার দাবি তুলছেন।

তবে করোনা পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসলে স্বাস্থ্যবিধি মেনে বিদ্যালয় খুলে দেওয়ার দাবি জানান তিনি।

এ বিষয়ে একাধিক অভিভাবকের সঙ্গে কথা হলে তারা জানান, বাসায় বসে ছেলেমেয়েরা পড়ালেখা করতে চায় না। অনেক পরিবারে অভিভাবকরা শিক্ষিত না হওয়ায় তাদের সন্তানকে পড়াতে পারছেন না। ফলে সেসব শিশুরা একেবারে পড়ালেখা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। আগে যা পড়েছে বর্তমানে তাও মনে করতে পারছে না। অনেকের সন্তানকে আবার বিভিন্ন কাজকর্মে যুক্ত করে দিচ্ছেন।

Advertisement

তাই সন্তানের পড়ালেখা নিয়মিত চালিয়ে নিতে দ্রুত বিদ্যালয় খুলে ক্লাস শুরুর দাবি জানান তারা।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সহকারী শিক্ষক সমিতির সভাপতি সামছুদ্দিন মাসুদ জাগো নিউজকে বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে বিদ্যালয় খুলে ক্লাস নেওয়া কঠিন হয়ে পড়বে। একদিন আর পুরো সপ্তাহে ক্লাস একই কথা, এতে করে কেউ করোনায় আক্রান্ত হলে বিদ্যালয় বন্ধ করে দিতে হবে। তখন মানুষের মধ্যে আতঙ্ক আরও বেশি ছড়িয়ে পড়বে। সে কারণে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেই বিদ্যালয় খোলা উচিত।

তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, অনাকাঙ্ক্ষিত এ ছুটির কারণে স্থগিত আছে আনুষ্ঠানিক লেখাপড়া। দীর্ঘ এই ছুটিতে শিক্ষার্থীরা এক প্রকার ঘরবন্দি জীবন কাটাচ্ছে। একদিকে শিক্ষাক্রম-পাঠ্যসূচির শিক্ষা থেকে বঞ্চিত আছে শিক্ষার্থীরা। অন্যদিকে ছাত্র-ছাত্রীদের মনো-সামাজিক ও শারীরিক বিকাশ বিঘ্নিত হচ্ছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হাজিরার মাধ্যমে দৈনন্দিন সমস্যা-সম্ভাবনা ও ইতিবাচক দিকগুলো মোকাবিলা থেকে জীবনমুখী শিক্ষণও থমকে আছে তাদের। সব মিলিয়ে সার্বিক শিক্ষায় অপরিমেয় ক্ষতি হয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মোহাম্মদ তারিক আহসান জাগো নিউজকে বলেন, করোনা পরিস্থিতিতে শহরের চেয়ে মফস্বলের শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে পড়ছে। দীর্ঘদিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শহরের স্কুলের শিক্ষকরা তাদের শিক্ষার্থীদের অনলাইন ক্লাসের আয়োজন করছেন। এর মাধ্যমে শতভাগ যুক্ত না হতে পারলেও অধিকাংশ শিক্ষার্থী এর সুবিধা পাচ্ছে। কিন্তু গ্রামের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সেটি সম্ভব হচ্ছে না। সে কারণে তারা পিছিয়ে পড়ছে।

তিনি বলেন, গ্রামের অনেক শিক্ষক আছেন যাদের কাছে একটি স্মার্টফোন কেনা অনেক কষ্টকর। সেখানে দরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থীর কাছে স্মার্টফোন কেনাটা স্বপ্নের মতো। অনেকের আবার সামর্থ্য থাকলেও নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেট সমস্যা, শিক্ষকদের অবহেলা, মনিটরিংয়ের অভাব, সামাজিক সমস্যাসহ নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে পড়ালেখা থেকে এ স্তরের শিক্ষার্থীরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। পড়ালেখার বদলে গ্রামের শিশুরা খেলাধুলা, পরিবারের কাজে ব্যস্ত থাকা, ঘোরাফেরাসহ নানাভাবে সময় পার করছে। অনেক পরিবারের অভিভাবকরা সচেতন না হওয়ায় তারা এটিকে স্বাভাবিক মনে করছেন। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করবে।

গ্রামের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আর্থিক বিশেষ প্রণোদনা দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে এই শিক্ষাবিদ বলেন, এমনিতে গ্রামের শিশুরা পুষ্টিহীনতায় থাকে। করোনার মধ্যে সব কিছু স্থবির হয়ে পড়ায় বর্তমানে তারা নানা সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। সে কারণে তাদের এগিয়ে নিতে হলে বাড়তি সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। মফস্বলের শিক্ষকদের অনলাইন ক্লাস পরিচালনা ও কনটেন্ট তৈরি করতে প্রশিক্ষিত করে তুলতে হবে। তাদের ডিজিটাল ডিভাইস বিষয়ে ধারণা ও ব্যবহারে উৎসাহিত করতে হবে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যে যাদের ডিভাইস নেই তাদের আর্থিক ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে। শিক্ষার্থীদের মাসিক দেড়শো টাকার উপবৃত্তির অর্থ বাড়িয়ে পড়ালেখায় আগ্রহ তৈরি করতে হবে। শিক্ষকদের সঙ্গে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সংযোগ বাড়াতে হবে।

এ বিষয়ে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক আলমগীর মুহম্মদ মনসুরুল আলম জাগো নিউজকে বলেন, সরকারি সিদ্ধান্ত মোতাবেক বিদ্যালয় খোলা হবে। কোথাও সংক্রমণ কম থাকলেই সেখানে বিদ্যালয় খুলে ক্লাস শুরু করা সম্ভব নয়। জাতীয় টেকনিক্যাল কমিটি বিদ্যালয় খোলার পরামর্শ দিলে সরকারিভাবে এ সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হবে। সেটি বাস্তবায়ন করা অধিদফতরের কাজ।

উল্লেখ্য, গত বছরের ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়। এরপর ওই বছরের ১৭ মার্চ থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ আছে। পরে ২৯ মার্চ মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক এবং ৭ এপ্রিল সংসদ বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রাথমিক স্তরের পাঠদান শুরু করা হয়। আগামী ২৩ মে স্কুল-কলেজ খোলার ঘোষণা দিয়েছে সরকার।

 

এমএইচএম/এসএস/জেআইএম