দেশজুড়ে

স্বাস্থ্যঝুঁকিতে ভারতফেরত জটিল রোগীরা

করোনার শুরু থেকে বাংলাদেশ থেকে ভারতে পাসপোর্টধারী যাত্রীদের যাতায়াত বন্ধ রয়েছে। তবে বেশ কিছুদিন সব রকম ভিসা স্থগিত থাকার পর ভারত সরকার বাংলাদেশের জন্যে চিকিৎসা, শিক্ষা, ব্যবসা, কূটনীতি, সাংবাদিকতাসহ পেশাভিত্তিক ভিসা সীমিত আকারে দেয়া শুরু করে।

Advertisement

এরই সুবাদে বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে কিছু লোক ভারতে যাতায়াত করছিলেন। সম্প্রতি করোনা সংক্রমণ ঊর্ধ্বমুখী হওয়ায় কঠোর লকডাউন ঘোষণা করে সরকার। এতে ভারতে বাংলাদেশি পাসপোর্টধারী যাত্রীরা আটকা পড়েন। তারা ভারতে অবস্থিত বাংলাদেশের হাইকমিশনের বিশেষ অনুমতিপত্র নিয়ে ফিরে আসছেন। আসার পরই তাদেরকে ১৪ দিনের বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টাইনে রাখা হচ্ছে।

২৬ এপ্রিল থেকে যশোরের বেনাপোল দিয়ে এ পর্যন্ত ফিরে আসা পাঁচ শতাধিক যাত্রীকে বিভিন্ন হোটেলে কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়েছে। এদের অধিকাংশ চিকিৎসা ভিসার পাসপোর্টধারী যাত্রী বলে জানা গেছে। আবার কিছু জটিল রোগে আক্রান্ত রোগীও আছেন। তাদের নিয়মিত স্বাস্থ্যের পরীক্ষা প্রয়োজন। এসব জটিল রোগীকে কোয়ারেন্টাইনে রাখার পর তাদের দেখভালের জন্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের প্রয়োজন। কিন্তু সেখানে সাধারণ চিকিৎসকও নেই।

বেনাপোলের বিভিন্ন আবাসিক হোটেলে ছড়িয়ে থাকা কোয়ারেন্টাইনের পাসপোর্টধারী যাত্রীদের একজন বিশ্বনাথ ভট্টাচার্য (৬৫)। আছেন সীমান্ত ঘেঁষা নিশাধ হোটেলে। তিনি বলেন, ‘আমার বয়স ৬৫ বছর। আমার চোখ অপারেশন করে এসেছি। অবস্থা মোটেও ভাল না। ডায়াবেটিকসের সমস্যাও রয়েছে। এরকম জটিল অবস্থায় এই বৃদ্ধ বয়সে এখানে কোয়ারেন্টাইনে থাকায় আমি আরও বিপদে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছি।’

Advertisement

একই হোটেলে অবস্থানরত আরও একজন যাত্রী আমির হামজা (২৮)। বাড়ি কুষ্টিয়া জেলায়। লোকটি অন্ধ-প্রতিবন্ধী। তিনি বলেন, ‘আমি অচল মানুষ। এখানে থাকায় রমজান মাসে রোজা রাখতে পারছি না। একইসঙ্গে নামাজ আদায়ও স্বাভাবিকভাবে করার সুযোগ পাচ্ছি না। খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারেও বেশ কষ্ট পেতে হচ্ছে। সব মিলিয়ে খুবই খারাপ অবস্থায় রয়েছি।’

একই হোটেলে থাকা নারায়ণগঞ্জের রুহুল আমিন (৩৮)। তিনি বলেন, ‘আমার চার বছরের মেয়ের রক্তের প্লাটিলেট কমে গেছে। একজন স্বাভাবিক মানুষের রক্তের প্লাজমা থাকে দেড় লাখ থেকে সাড়ে ৪ লাখ। আর আমার মেয়ের আছে মাত্র ৪ হাজার প্লাজমা। এরকম চরম দুরবস্থার মধ্যেই আমি এখানে মেয়েকে নিয়ে রয়েছি। যেকোনো সময় বড় ধরনের বিপদে পড়ে যেতে পারি। এই মুহূর্তে দরকার আমার মেয়ের জন্য উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থার।’

কোয়ারেন্টাইনে থাকা রোগীদের সম্পর্কে শার্শা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডাক্তার ইউসুফ আলী বলেন, ‘যেসব জটিল রোগী কোয়ারেন্টাইনে রয়েছেন তাদের অবস্থা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে প্রয়োজনে উন্নত চিকিৎসা প্রাপ্তির সুযোগ আছে, এ রকম রোগীদের হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে।’

এদিকে ভারত ফেরত বাংলাদেশিদের ব্যক্তিগত খরচে ১৪ দিন বেনাপোলের বিভিন্ন আবাসিক হোটেলে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে থাকার নির্দেশনা নিয়ে যাত্রীদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। ভারতফেরত এসব যাত্রীরা বলছেন, তাদের বেশির ভাগই চিকিৎসা নিতে ভারত গিয়েছিলেন। ভারতে আটকা পড়লে কলকাতায় নিযুক্ত বাংলাদেশি উপ-হাইকমিশনার অফিসে আবেদন করে ছাড়পত্র নিয়ে দেশে ফিরেছেন। এছাড়া তাদের কাছে রয়েছে করোনা নেগেটিভ রিপোর্ট।

Advertisement

তাদের অভিযোগ, বেনাপোলের আবাসিক হোটেলে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইন তাদের জন্য অনিরাপদ এবং ব্যয়বহুল। প্রতিদিন রুম ভাড়া ৫০০ থেকে হাজার টাকা গুণতে হচ্ছে। খাওয়াসহ অন্যান্য খরচতো আছেই। তাই সবার স্ব স্ব এলাকার হোটেলে বা সরকারি স্থানে রাখার দাবি জানান তারা।

যশোর জেলা প্রশাসন ও বেনাপোল ইমিগ্রেশন সূত্রে জানা গেছে, ২৬ এপ্রিল থেকে স্থলবন্দর সাময়িক বন্ধ ঘোষণা করা হয়। শর্ত সাপেক্ষে প্রথম দিনে ছয়জন দেশে ফেরেন। এরপর ভারতে বাংলাদেশ দূতাবাসের অনুমতি নিয়ে এ পর্যন্ত প্রায় ২ হাজার যাত্রী দেশে ফিরেছেন।

সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী, ভিসার মেয়াদ ১৫ দিনের কম থাকা যাত্রীরা দেশে ফিরতে পারবেন। কিন্তু যারা দেশে ফিরেছেন, তাদের বেশির ভাগের ভিসার মেয়াদ ১৫ দিনের বেশি রয়েছে। যে কারণে যাত্রীদের কোয়ারেন্টাইনে রাখার ব্যবস্থাপনা সামাল দিতে জেলা প্রশাসন ও স্বাস্থ্য বিভাগ হিমশিম অবস্থায় পড়েছে।

এদিকে বেনাপোলের আবাসিক হোটেলগুলোতে বিশুদ্ধ খাওয়ার পানির সরবরাহ নেই। খাবারের দাম বেশি ও অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের অভিযোগ করছেন কোয়ারেন্টাইনে থাকা যাত্রীরা।

হোটেলে রাখার সময় প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, জনপ্রতি প্রতিদিন ২০০ টাকা ভাড়া দিতে হবে, কিন্তু হোটেল কর্তৃপক্ষ ৪০০ থেকে ৮০০ টাকা করে ভাড়া নিচ্ছে। প্রতিদিন খাওয়া ও থাকা দিয়ে একজনের খরচ হচ্ছে ৯৫০ থেকে ১২০০ টাকা। ভারতে চিকিৎসা খরচ মিটিয়ে দেশে ফিরে এখন এই ব্যয় নির্বাহ করা আমাদের পক্ষে খুব কঠিন হয়ে যাচ্ছে বলে জানালেন অনেকে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে যশোরের জেলা প্রশাসক তমিজুল ইসলাম খান বলেন, ‘স্বাভাবিক সময়ে যে ভাড়া নেয়া হয়, তার অর্ধেক নেয়ার জন্য আবাসিক হোটেল কর্তৃপক্ষকে বলা হয়েছে। তাতে তারা রাজিও হয়েছে। ভাড়া নিয়ে কোনো জটিলতার সৃষ্টি হলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) সঙ্গে কথা বলে ভাড়া পরিশোধ করার জন্য যাত্রীদের পরামর্শ দেয়া হচ্ছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘প্রতিদিনই যাত্রী আসার সংখ্যা বাড়ছে। এদিকে বেনাপোলের সব আবাসিক হোটেল পরিপূর্ণ। বিকল্প হিসেবে ঝিকরগাছার গাজীর দরগা মাদরাসায় কোয়ারেন্টাইনে রাখার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। সেখানে রান্না করে খাওয়ার ব্যবস্থা আছে। এ ছাড়া যশোর শহর ও পরবর্তীকালে বিভাগীয় কমিশনারের সঙ্গে আলোচনা করে যাত্রীদের সংশ্লিষ্ট জেলার আবাসিক হোটেলে কোয়ারেন্টাইনে রাখার পরিকল্পনা করা হচ্ছে।’

মো. জামাল হোসেন/এসজে/জিকেএস