চলমান করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) পরিস্থিতিতে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) মোবাইল অ্যাপ ব্যবহারকারী বিনিয়োগকারীর সংখ্যা বেড়েছে। তবে বিনিয়োগকারীর সংখ্যা বাড়লেও অ্যাপের মাধ্যমে লেনদেনের হার কমে গেছে।
Advertisement
ডিএসইর মোবাইল অ্যাপের লেনদেন পর্যালোচনায় দেখা গেছে, লকডাউন শুরুর আগে ডিএসইতে যে লেনদেন হয় তার প্রায় ১৫ শতাংশ ছিল মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে। কিন্তু লকডাউনের মধ্যে তা কমে ১০ শতাংশের কাছাকাছি চলে এসেছে। অথচ লকডাউনের মধ্যে মোবাইল অ্যাপে নতুন বিনিয়োগকারী বেড়েছে প্রায় দুই হাজার।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডিএসইর মোবাইল অ্যাপে নানা সুবিধা রয়েছে। কিন্তু সঠিক প্রচার-প্রচারণার অভাবে এই অ্যাপ ব্যবহাকারীর সংখ্যা খুবই কম। এছাড়া ডিএসইতে দক্ষ লোকবলের অভাবে মোবাইল অ্যাপে প্রায় বিভিন্ন ধরনের সমস্যা দেখা দেয়, যা বিনিয়োগকারীদের মধ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। আবার যারা এই অ্যাপ ব্যবহার করছেন, তাদের সিংহভাগ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী। ফলে লেনদেনের খুব কম অংশই অ্যাপের মাধ্যমে হচ্ছে।
প্রচার-প্রচারণার অভাব থাকলেও বেশ ঘটা করেই ২০১৬ সালের ৯ মার্চ ‘ডিএসই মোবাইল’ নামে একটি অ্যান্ড্রয়েডভিত্তিক অ্যাপ্লিকেশন চালু করে ডিএসই। এরপর পাঁচ বছর কেটে গেলেও অ্যাপটি ব্যবহারে বিনিয়োগকারীদের তেমন সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। মাত্র এক শতাংশের মতো বিনিয়োগকারী বর্তমানে মোবাইল অ্যাপটি ব্যবহার করছেন।
Advertisement
তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, লকডাউনের আগের দিন গত ৪ এপ্রিল ডিএসইর মোবাইল অ্যাপে নিবন্ধিত বিনিয়োগকারীর সংখ্যা ছিল ৬২ হাজার ৪৭৬ জন। ২৯ এপ্রিল এসে সেই সংখ্যা দাঁড়ায় ৬৪ হাজার ৬৫ জনে। এই হিসাবে লকডাউনের মধ্যে মোবাইল অ্যাপে নতুন করে নিবন্ধিত হয়েছেন এক হাজার ৫৮৯ জন।
এদিকে লকডাউনের আগে এপ্রিলের শুরুতে বা ১ এপ্রিল ডিএসইর মোট লেনদেনের ১৪ দশমিক ৬৫ শতাংশ ছিল মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে। লকডাউনের আগের কার্যদিবস ৪ এপ্রিল ডিএসইর মোট লেনদেনের ১৪ দশমিক ৯২ শতাংশ ছিল মোবাইল অ্যাপ থেকে।
অন্যদিকে ২৯ এপ্রিল ডিএসইর মোট লেনদেনের ১১ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ মোবাইল অ্যাপ থেকে ছিল। তার আগের কার্যদিবস ২৮ এপ্রিল মোবাইল অ্যাপ থেকে লেনদেনের পরিমাণ ছিল ডিএসইর মোট লেনদেনের ১০ দশমিক ৬৩ শতাংশ। এপ্রিলে মোবাইল অ্যাপে লেনদেন হার সবচেয়ে কম ছিল ২০ এপ্রিল। ওই দিন ডিএসইর মোট লেনদেনের ৭ দশমিক ২৮ শতাংশ ছিল মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে। এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, লকডাউনের মধ্যে ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়লেও মোট লেনদেনে মোবাইল অ্যাপের অংশ কমে গেছে।
এদিকে মোবাইল অ্যাপে যে বিনিয়োগকারীরা নিবন্ধিত তার তিন ভাগের দুই ভাগই নিয়মিত লগ-ইন করেন না বা অ্যাপ ব্যবহার করেন না। সম্প্রতি অ্যাপে প্রবেশ করা বিনিয়োগকারীর সংখ্যা বেড়েছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে অ্যাপের মাধ্যমে ক্রয়-বিক্রয়ের আদেশ দেয়ার সংখ্যা। লকডাউনের শুরুতে প্রবেশকারীর সংখ্যা এবং ক্রয়-বিক্রয়ের আদেশের সংখ্যা কমে গিয়েছিল।
Advertisement
লকডাউনের আগের দিন ৪ এপ্রিল নিবন্ধিত ৬২ হাজার ৪৭৬ জন বিনিয়োগকারীর মধ্যে অ্যাপে প্রবেশ করেন ১৯ হাজার ৩৪১ জন। এসব বিনিয়োগকারী মোট ৪৫ হাজার ৭৯৫টি ক্রয়-বিক্রয়ের আদেশ দেন। এর মধ্যে ৩৭ হাজার ৮৩৭টি ক্রয়-বিক্রয়ের আদেশ নিষ্পন্ন হয়।
লকডাউন শুরুর পর অ্যাপে প্রবেশ করা বিনিয়োগকারীর সংখ্যা কমতে কমতে ১৩ এপ্রিল ১৭ হাজার ৬৫৪ জনে নেমে আসে। সেই সঙ্গে ক্রয়-বিক্রয়ের আদেশ কমে দাঁড়ায় ৩৭ হাজার ৭৪৪টিতে, যার মধ্যে লেনদেন নিষ্পন্ন হয় ২৫ হাজার ১২৩টি।
অবশ্য শেষ দুই কার্যদিবসে (২৮ ও ২৯ এপ্রিল) অ্যাপে প্রবেশকারী বিনিয়োগকারীর সংখ্যা ২০ হাজার ছাড়িয়েছে। এর মধ্যে ২৮ এপ্রিল ২০ হাজার ২২০ জন বিনিয়োগকারী অ্যাপে প্রবেশ করে ৪৭ হাজার ৭১৩টি ক্রয়-বিক্রয়ের আদেশ দেন। লেনদেন নিষ্পন্ন হয়েছে ৩৪ হাজার ২৭০টির। ২৯ এপ্রিল ২০ হাজার ৩৬২ জন বিনিয়োগকারী অ্যাপে প্রবেশ করে ৫২ হাজার ৩৩৩টি ক্রয়-বিক্রয়ের আদেশ দেন, যার মধ্যে নিষ্পন্ন হয়েছে ৩৯ হাজার ৫৯১টি।
এ বিষয়ে শেয়ারবাজার বিশ্লেষক অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আবু আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে লেনদেন হার কমে যাওয়ার কারণ লকডাউনের মধ্যে লেনদেনের পরিমাণ বেড়েছে। তাছাড়া মোবাইল অ্যাপ ব্যবহার করেন ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা। বড় বিনিয়োগকারীরা মোবাইল অ্যাপ ব্যবহার করেন না।’
বড় বিনিয়োগকারীরা মোবাইল অ্যাপ ব্যবহার না করার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘বড় বিনিয়োগকারীরা ব্রোকারেজ হাউসের লোকজনের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে চান। তারা অ্যাপের বদলে যোগাযোগের মাধ্যমে লেনদেন করতে বেশি আগ্রহী।’
অধ্যাপক আবু আহমেদ আরও বলেন, ‘আমাদের শেয়ারবাজারে মোবাইল অ্যাপ ব্যবহারকারী বিনিয়োগকারীর সংখ্যা অনেক কম। এর কারণ সচেতনতার অভাব। আবার অ্যাপে বিভিন্ন সময় সমস্যাও দেখা দেয়। তাছাড়া আমাদের দেশের মানুষ এখনও প্রযুক্তিনির্ভর হয়ে উঠতে পারেনি। যে কারণে এখনও লেনদেনের ৮০ শতাংশ হয় ক্যাশে। কার্ডের মাধ্যমে মাত্র ২০ শতাংশের মতো লেনদেন হয়।’
এদিকে পাঁচ বছরেও মোবাইল অ্যাপে বিনিয়োগকারীদের তেমন সাড়া পাওয়া না গেলেও চলতি বছরের সেপ্টেম্বরের মধ্যে এই মাধ্যমে তিন লাখ বিনিয়োগকারীকে যুক্ত করার পরিকল্পনা নিয়েছে ডিএসই।
এ বিষয়ে ডিএসই পরিচালক মো. রকিবুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা চলতি বছরের সেপ্টেম্বরের মধ্যে মোবাইল অ্যাপের আওতায় তিন লাখ বিনিয়োগকারী নিয়ে আসবো। এ জন্য সব ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। মোবাইল অ্যাপের যে ধরনের প্রযুক্তিগত সংস্কারের প্রয়োজন তা করা হচ্ছে।’
লকডাউনের মধ্যে অ্যাপ ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়লেও লেনদেনের হার কমে যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বিনিয়োগকারীরা সঠিক সময়ে অ্যাপে ঢুকতে পারছেন না, অ্যাপে লেনদেন হার কমে যাওয়ার এটি একটি কারণ হতে পারে। তবে ডিএসই সবকিছু দেখছে। অ্যাপ ব্যবহার আরও কীভাবে সহজ ও আরামদায়ক করা যায় তার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।’
এদিকে একাধিক ব্রোকারেজ হাউসের কর্মীরা জানিয়েছেন, অ্যাপের মাধ্যমে লেনদেন কম হলেও লকডাউনের মধ্যে ব্রোকারেজ হাউসে বিনিয়োগকারীদের আসার পরিমাণ কমে গেছে। এখন বেশিরভাগ বিনিয়োগকারী অ্যাপের মাধ্যমে ব্রোকারেজ হাউসের কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে লেনদেন করছেন। যদিও এ ধরনের লেনদেনের আইনগত কোনো ভিত্তি নেই। তারপরও বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে সম্পর্কের ভিত্তিতে ব্রোকারেজ হাউসের কর্মীরা মোবাইল ফোনেই ক্রয়-বিক্রিয়ের আদেশ নিচ্ছেন।
তারা জানান, আইনগত ভিত্তি না থাকলেও সম্পর্কের ভিত্তিতে প্রতিটি ব্রোকারেজ হাউস বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে মোবাইলে ক্রয়-বিক্রয়ের আদেশ নেন। তবে লকডাউন পরিস্থিতিতে এ ধরনের লেনদেনের পরিমাণ অনেক বেড়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ডিএসই মোবাইল অ্যাপে তিনটি সংস্করণ রয়েছে। এর মধ্যে দুটি বিনিয়োগকারীদের জন্য, একটি ব্রোকারেজ হাউসের জন্য। বিনিয়োগকারীদের জন্য থাকা দুটি সংস্করণ হলো ‘ডিএসই মোবাইল ভিআইপি’ এবং ‘ডিএসই মোবাইল ট্রেডার’।
যেভাবে ব্যবহার করতে হয় ডিএসই মোবাইল অ্যাপযে কোনো বিনিয়োগকারী ডিএসই মোবাইল অ্যাপটি গুগল প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করতে পারবেন। ডাউনলোড করার পর এটি ব্যবহারের জন্য একজন বিনিয়োগকারীকে ব্রোকারেজ হাউস থেকে একটি ইউজার আইডি ও পাসওয়ার্ড নিতে হয়। এই ইউজার আইডি ও পাসওয়ার্ড নেয়ার পর অ্যাপটির মাধ্যমে শেয়ার কেনাবেচার আদেশ দিতে পারেন বিনিয়োগকারীরা। আদেশ কার্যকর হলে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে তার মোবাইলে একটি এসএমএস যায়।
কোন সংস্করণে কীডিএসই ইনভেস্টর সংস্করণ দিয়ে হাউসগুলো ডিলার হিসেবে শেয়ারের সর্বশেষ তথ্য জানার পাশাপাশি শেয়ার কেনা-বেচার আদেশ দিতে পারে। অন্যদিকে ডিএসই মোবাইল ভিআইপি দিয়ে সরাসরি লেনদেন করা যায় না। এটি দিয়ে মোবাইলে পোর্টফোলিও দেখা যায়।
ডিএসই মোবাইল ট্রেডার দিয়ে বিনিয়োগকারী নিজেই লেনদেন সম্পন্ন করতে পারেন। তবে বাজার দরের চেয়ে বেশি দরে লেনদেনের অফার বা অর্ডার করলে সংশ্লিষ্ট ব্রোকারেজ হাউস তা বাতিল করতে পারে।
এমএএস/এমএসএইচ/এইচএ/জিকেএস