বিশেষ প্রতিবেদন

বোরো এলে চালে স্বস্তি ফিরবে?

দেশের বাজারে চালের চড়া দাম সাধারণ মানুষকে ভোগাচ্ছে দীর্ঘদিন ধরেই। দাম কমাতে সরকারের নেয়া উদ্যোগগুলোর কার্যত কোনো সুফল মেলেনি। তাই শেষমেশ ইরি-বোরোকে ভরসা করে রয়েছে সবাই। তবে সময় যত এগিয়ে আসছে, প্রত্যাশা ততই কমছে। বোরো ধান ওঠার পর চালের দামে কতটুকু স্বস্তি ফিরবে—এখন সেটা নিয়েই শঙ্কা প্রকাশ করছেন সংশ্লিষ্টরা।

Advertisement

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিগত এক যুগের বেশি সময়ের তুলনায় সরকারের হাতে চালের মজুত কম। আর এ সময় সরকার আমদানি করতে কার্যত ব্যর্থ হয়ে দেশের বাজার থেকে বেশি পরিমাণ চাল সংগ্রহের পরিকল্পনা করেছে। তার একটি নেতিবাচক প্রভাব বাজারে পড়তে পারে। পাশাপাশি করোনা পরিস্থিতিতে খাদ্য সহায়তা বেড়ে যাওয়ায় আরেকটি প্রভাব বাজারে রয়ে গেছে।

তারা আরও বলছেন, দেশের কিছু অঞ্চলে তীব্র তাপদাহ ও হিটশকের কারণে এ বছরের বোরোর ফলন কমেছে। অন্যদিকে প্রাকৃতিক পানি স্বল্পতা ও করোনার কারণে শ্রমিক সংকটে বেড়েছে উৎপাদন খরচও। সবমিলিয়ে এ বছর বোরো ধান ভোক্তাদের চালের দাম কমাতে কতটা সহায়ক হবে—সেটাই এখন বড় প্রশ্ন।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএসের সাবেক গবেষণা পরিচালক এম আসাদুজ্জামান জাগো নিউজকে বলেন, ‘চালের দাম কমানোর ভালো সমাধান ছিল, আগে-ভাগে সরকারি পর্যায়ে বিদেশ থেকে চাল আমদানি। কিন্তু সরকার সেটা করতে পারেনি। এখন মজুত বাড়াতে দেশের অভ্যন্তরে বেশি বেশি চাল সংগ্রহের পরিকল্পনা করেছে। মিলারদের কাছ থেকে সংগ্রহে দামও বেশি নির্ধারণ করেছে। এর প্রভাব বাজারে পড়বে।’

Advertisement

এদিকে চলতি বোরো মৌসুমে অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে মোট  ১৮ লাখ টন ধান ও চাল কিনবে সরকার। মিলারদের কাছ থেকে নিতে প্রতি কেজি চালের দর ৪০ টাকা এবং কৃষকদের কাছ থেকে নিতে প্রতি কেজি ধানের দর ২৭ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এ বছর মিলারদের কাছ থেকে চার টাকা বেশি দরে চাল কেনা হচ্ছে। যদিও কৃষকদের বেড়েছে মাত্র এক টাকা।

গত বোরো মৌসুমে ২৬ টাকা কেজি দরে ধান এবং ৩৬ টাকা কেজি দরে চাল কেনা হয়েছিল। তবে বাজারে চালের দাম বেশি থাকায় গত বোরো ও আমন মৌসুমে ধান-চাল কিনতে পারেনি সরকার। ফলে মজুতে বড় ধরনের ঘাটতি পড়ে, যা পূরণে বেশি চাল কেনা হবে এবার। তবে এ পরিমাণ চাল বাজার থেকে কিনে সরকার মজুত করলে তার প্রভাব বাজারে পড়বে বলে মনে করা হচ্ছে।

এদিকে এ বছর সেচ মৌসুমে বৃষ্টিপাত না হওয়ায় কৃষকের খরচ বেড়েছে। তাপদাহ, তীব্র খরা ও স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত না থাকায় বিভিন্ন অঞ্চলে স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় দেড় থেকে দুই গুণ পর্যন্ত বেশি খরচ করে সেচ দিতে হয়েছে।

জয়পুরহাটের আক্কেলপুর উপজেলার শান্তা গ্রামের কৃষক লিয়াকত মিয়া জাগো নিউজকে বলেন, ‘গত বছর বিঘাপ্রতি সর্বোচ্চ দেড় হাজার টাকা সেচ খরচ হলেও এবারে খরচ হয়েছে দুই হাজার টাকার বেশি। তারপরও প্রচণ্ড গরমে ফলন ভালো হয়নি। বাজারে অন্যান্য বছরের মতো ধানের দাম থাকলে নিশ্চিত লোকসান হবে।’

Advertisement

বিগত এক যুগের বেশি সময়ের তুলনায় সরকারের হাতে এখন চালের মজুত কম

এদিকে গত কয়েক দিন ধান কেটে ঘরে তুলেছেন এমন কয়েকজন কৃষকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা এ বছর ফলন কম পাচ্ছেন। তারা জানিয়েছেন, ২৫-৩০ মণ ফলনের আশা করলেও ধান কাটার পর দেখা যাচ্ছে ২০ থেকে ২২ মণের বেশি পাচ্ছেন না তারা। এতে তাদের প্রতিকেজি ধানের খরচ প্রায় ৩০ টাকার কাছাকাছি পৌঁছে গেছে।

অবশ্য এ বছর যে ধান-চালের উৎপাদন খরচ বেশি, সেটা সরকারও বলছে। কৃষি বিপণন অধিদফতরের হিসাব অনুযায়ী, এ বছর ধানের কেজিপ্রতি উৎপাদন ব্যয় ২৬ টাকা ১ পয়সা, চালের ৩৮ টাকা ৯৬ পয়সা। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর ধানের উৎপাদন ব্যয় ২৬ টাকা ১৯ পয়সা, চালের ৩৮ টাকা ৫৩ পয়সা; বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট ধানের উৎপাদন ব্যয় ২৫ টাকা ২৮ পয়সা, চালের ৩৭ টাকা ৭ পয়সা এবং কৃষি মন্ত্রণালয় ধানের উৎপাদন ব্যয় ২৭ টাকা ও চালের ৩৯ টাকা নির্ধারণ করেছে। গত বছর বোরোর উৎপাদন খরচ ছিল ২৬ টাকার কম এবং চালের উৎপাদন খরচ ছিল ৩৫ টাকার কম।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, চলতি মৌসুমে সারাদেশে ৪৮ লাখ ৮৩ হাজার ৭৬০ হেক্টর জমিতে বোরোর আবাদ হয়েছে। যেখানে দেশের ৩০টিরও বেশি জেলার ধানের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া হিটশকের প্রভাবে ৬৮ হাজার জমির ধান আক্রান্ত হয়েছে। কৃষি মন্ত্রণালয় প্রায় এক লাখ টন ফসলের ক্ষতির কথা বললেও, এই পরিমাণ আরও বাড়ছে।

অতিরিক্ত গরম হাওয়া পুড়িয়ে দিয়েছে কয়েক হাজার হেক্টর জমির ধান

তবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মহাপরিচালক মো. আসাদুল্লাহ বলেন, ‘খরা ও হিটশকের কারণে উৎপাদনে সামান্য প্রভাব পড়লেও সার্বিকভাবে কোনো ঘাটতি তৈরি হওয়ার শঙ্কা নেই। এ বছর লক্ষ্যমাত্রা থেকে বেশি জমিতে বোরো চাষ হয়েছে।’

সরকারের অবস্থান এবার  চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখবে বলে মনে করেন কৃষি অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম খান। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘গত দুই মৌসুমে সরকারের গুদামে চালের মজুত না থাকায় সরকার বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। এবারও অবস্থার উন্নতি হয়নি। এ কারণে ব্যবসায়ী-মজুদদাররা ইচ্ছামতো চালের দাম নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে।’

তিনি বলেন, ‘চালের বাজারে একটি বড় সমস্যা ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট। আসন্ন বোরো মৌসুমেও সিন্ডিকেট আক্টিভ (তৎপর) থাকবে। তারা চাইবে চালের দাম খুব ঊর্ধ্বমুখী থাকুক। কারণ বিদেশ থেকে আট লাখ টনের মতো চাল কিনে এনেছে বেসরকারি পর্যায়ের বিভিন্ন ব্যবসায়ী। আরও চাল পাইপলাইনে রয়েছে। তারা কখনও চাইবে না চালের দাম কমে যাক।’

এসব সমস্যার সমাধান সরকারকেই করতে হবে উল্লেখ করে ড. জাহাঙ্গীর আলম আরও বলেন, ‘সিন্ডিকেট রুখতে হবে, মজুত স্থিতিশীল করতে হবে। সবমিলিয়ে চালের দামের বিষয়টি নির্ভর করবে সরকার কতটা অ্যাক্টিভ রোল প্লে করতে পারে তার ওপর।’

বৃষ্টিপাত না হওয়ায় কৃষকের খরচ বেড়েছে

এ বছরের শুরুতে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের (বিএআরসি) গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে চালের বাজারের বড় সিন্ডিকেট মিলাররা। গত ২০১৮ থেকে ২০২০ সালের তিন বোরো মৌসুমে চাল প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে এসব মিল মালিকরা লাভ করেছেন প্রতি কেজিতে চার টাকা ৭০ পয়সা থেকে আট টাকা ২০ পয়সা পর্যন্ত।

গবেষণায় আরও দেখা গেছে, গত বছর করোনাভাইরাসের প্রকোপ শুরুর পর থেকে  চালের অস্বাভাবিক দামের কারণ মজুত প্রবণতা। করোনায় খাদ্য ঘাটতির শঙ্কায় ব্যবসায়ী ও মিল মালিকরা প্রচুর চাল মজুত করেছিলেন। এ বিষয়ে সরকার যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয়েছে।

গবেষণায় বলা হয়, করোনাভাইরাসের কারণে কৃষকরাও ধীরে ধীরে চাল বিক্রি করেছেন। তবে ধান ওঠার এক মাসের মধ্যে নিজেদের প্রয়োজনের উদ্বৃত্ত চাল বিক্রি করে দেন তারা। এরপর ব্যবসায়ী ও মিল মালিকরা চাল মজুত করেন।

সরকার চাল সংগ্রহ এবং যথাসময়ে আমদানি করতে পারেনি উল্লেখ করে এতে বলা হয়, চালের বিষয়ে যথাযথ হস্তক্ষেপ করতে ব্যর্থ হয়েছে সরকার। এসবের সুযোগ নিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। চালে মধ্যস্বত্বভোগী হিসেবে মিলার, আড়তদার ও পাইকাররা বেশি মুনাফা করেন।

এনএইচ/এমএসএইচ/এইচএ/জিকেএস