দেশজুড়ে

বরিশাল বিভাগে ভয়াবহ ডায়রিয়া সংক্রমণের কারণ জানাল আইইডিসিআর

সরকারি হিসাবে বরিশাল বিভাগের ৬ জেলায় গত এক মাসে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ১৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। আর গত ৪ মাসে ৪৭ হাজার ৫৬৫ জন ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন। সুস্থ হয়েছেন ৪৬ হাজার ৬১৬ জন রোগী।

Advertisement

তবে সরকারি এ হিসাবের বাইরে এ বিভাগে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে অনন্ত আরও ১৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। আর আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ৫০ হাজারের বেশি বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের বরিশাল বিভাগীয় কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ভোলা জেলায় বেশি মানুষ ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন। গত জানুয়ারি মাস থেকে এ জেলায় ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন ৭ হাজার ৯৯৪ জন। তবে এ জেলায় ডায়রিয়ায় মৃত্যু হয়েছে এক জনের।

এরপর রয়েছে পটুয়াখালী জেলা। এ জেলায় আক্রান্ত হয়েছিলেন ৫ হাজার ৩২১ জন। মুত্যু হয়েছে ৫ জনের। বরগুনা জেলায় ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন ৪ হাজার ৪৭৭ জন। মারা গেছেন ৩ জন।

Advertisement

বরিশাল জেলায় আক্রান্ত হয়েছেন ৪ হাজার ৪৩৭ জন। মারা গেছেন ৫ জন। ঝালকাঠি জেলায় ৪ হাজার ৪২ জন আক্রান্ত হয়েছেন। এ জেলায় ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে কোনো রোগী মারা যাননি। পিরোজপুর জেলায় ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন ২ হাজার ৮৯০ জন। এ জেলায়ও ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে কোনো রোগী মারা যাননি।

বিভাগের ৬ জেলার বিভন্ন উপজেলার একাধিক জনপ্রতিনিধিসহ স্থানীয় ১৬ জন ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত একমাসে অনন্ত ৩১ জন ডায়রিয়ায় আক্রান্ত রোগী মারা গেছেন। এরমধ্যে বেশির ভাগ ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে বাড়িতে। অনেকে করোনা সংক্রমণের ভয়সহ নানা কারণে হাসপাতালে না গিয়ে বাড়িতেই চিকিৎসা নিয়েছেন। বাড়িতেই কয়েকজনের মৃত্যু হয়েছে। তবে এসব তথ্য স্বাস্থ্য অধিদফতরের কাছে পৌঁছাইনি। এজন্য তারা সরকারি হিসাবে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ১৪ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে তথ্য দিচ্ছে।

সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, এপ্রিল থেকে বরিশাল বিভাগের ৬ জেলায় ডায়রিয়ার প্রাদুর্ভাব ব্যাপক আকারে দেখা দেয়। এর কয়েকদিন পর তা মহামারি আকার ধারণ করে। প্রতিদিনই বাড়তে থাকে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। বিভাগের ৬ জেলায় দিনে প্রায় দেড় হাজার মানুষ ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছিলেন। প্রতিদিন বিশাল সংখ্যক মানুষ ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হওয়ায় রোগী সামাল দিতে হিমশিম খেতে হয় বিভাগের জেলা সদর ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য কর্মীদের। পর্যাপ্ত শয্যা, ওষুধ ও আইভি স্যালাইন না থাকায় ভোগান্তিতে পড়েন রোগী ও তাদের স্বজনরা।

পরিস্থিতি সামাল দিতে বরিশালসহ অপর ৫ জেলায় গঠন করা হয় ৪০৬টি বিশেষ মেডিকেল টিম। প্রতিদিন এত মানুষ ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছেন, তার কারণ জানতে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) সহায়তা চাওয়া হয়। আইইডিডিসিআরের ৬ সদস্যের গবেষক দল পাঠানো হয় বরিশালে।

Advertisement

গত ১৯ এপ্রিল থেকে বরিশাল ও বরগুনার প্রত্যন্ত এলাকায় কাজ শুরু করেন গবেষক দল। তারা বিভাগের বিভিন্ন উপজেলায় ঘুরে রোগীদের মল, বিভিন্ন উৎসের পানির নমুনা সংগ্রহের পাশাপাশি স্বাস্থ্য সচেতনায় জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে সভা করেন। একইসঙ্গে মানুষের খাদ্যাভ্যাস ও জীবনযাপনের নানা বিষয় সম্পর্কে খোঁজখবর নেন।

এ গবেষক দলে রয়েছেন ৩ জন রোগতত্ত্ববিদ ও ৩ জন কারিগরি সহায়ক। নেতৃত্বে ছিলেন রোগতত্ত্ববিদ জাহিদুর রহমান।

প্রতিনিধি দলের রোগতত্ত্ববিদ সুব্রত মালাকার জানান, আমরা ডায়রিয়ার উৎস বা কারণ খোঁজার চেষ্টা করেছি। রোগীদের মল, বিভিন্ন উৎসের পানির নমুনা সংগ্রহ করে প্রাথমিক পরীক্ষা-নীরিক্ষার পর দেখা গেছে বেশ কয়েকটি জায়গায় গ্রামীণ জনপদে ঘর গৃহস্থালির কাজে ব্যবহৃত পানিতে ডায়রিয়ার জীবানু রয়েছে। পানি ও রোগীর মলে শনাক্ত হয়েছে ই-কোলাই ব্যাকটেরিয়া। এ ব্যাকটেরিয়ার কারণে ডায়রিয়া মারাত্মক আকার ধারণ করেছিল। বরিশাল বিভাগের ৬ জেলায় ডায়রিয়ার প্রাদুর্ভাব ভয়াবহ আকার ধারণ করার এটাই অন্যতম কারণ ছিল।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের বরিশাল বিভাগীয় পরিচালক ডা. বাসুদেব কুমার দাস জানান, আইইডিসিআরের গবেষক দল বিভাগের বিভিন্ন উপজেলায় ঘুরে রোগীদের মল, বিভিন্ন উৎসের পানির নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা-নীরিক্ষা করেছেন। বরগুনা থেকে সংগ্রহ করা পানির নমুনায় সেখানকার পুকুর ও খালের পানিতে ডায়রিয়ার জীবানুর অস্তিত্ব পাওয়া গেছে।

ডা. বাসুদেব আরও বলেন, যে এলাকায় ডায়রিয়ার মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে সেখানকার পানি সংগ্রহ করে পরীক্ষা করেছে আইইডিসিআরের প্রতিনিধি দল। বরগুনার গবেষণায় দেখা গেছে, সেখানকার ৯৪ ভাগ মানুষ নলকূপের পানি পান করলেও শতকরা ৭১ ভাগ মানুষ নিত্য প্রয়োজনীয় কাজে খাল ও পুকুরের পানি ব্যবহার করছেন। অপরদিকে গভীর নলকূপের পানি ব্যবহারের আওতায় এসেছেন মাত্র ২০ ভাগ মানুষ।

তিনি আরও বলেন, প্রধানত দুটি কারণে ডায়রিয়া ছড়িয়ে পড়ে। গ্রামীণ জনপদের মানুষ এখনও বাসি পান্তা ভাত খাওয়ায় অভ্যস্ত। ওই ভান্তা ভাতে ব্যবহার করা হয় নদী, খাল ও পুকুরের পানি। পান্তা ভাতে ব্যবহৃত ওই পানি থেকে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে ডায়রিয়া।

তিনি বলেন, আইইডিসিআরের প্রতিনিধি দল বরিশাল থেকে ফিরে গিয়ে প্রাথমিকভাবে স্বাস্থ্য অধিদফতরে রিপোর্ট ও সুপারিশ আকারে বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরেছেন।

সুপারিশগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে- খাওয়ার ও ঘর গৃহস্থালির কাজে নিরাপদ পানি ব্যবহার নিশ্চিত করা, ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় গভীর নলকূপের সংখ্যা বাড়ানো, খাল-নদীর পানি ফুটিয়ে অথবা পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট দিয়ে পানি নিরাপদ করে ব্যবহার করা ও স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া।

ডা. বাসুদেব আরও বলেন, এরইমধ্যে তাদের সুপারিশ বাস্তবায়নে নানা পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। বিভিন্ন উপজেলায় বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট দেয়া হচ্ছে। সচেতনতা বাড়াতে প্রচারণা চালানো হচ্ছে। পাশাপাশি গভীর নলকূপের সংখ্যা বাড়ানোর জন্য সংশ্লিষ্ট দফতরকে চিঠি দেয়া হয়েছে। পদক্ষেপের কারণে সুফল পাওয়া যাচ্ছে। ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা অনেক কমে গেছে। মঙ্গলবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ৯২১ জনে নেমে এসেছে।

ডা. বাসুদেব বলেন, সরকারি হিসাবমতে বরিশাল বিভাগে ডায়রিয়া আক্রান্ত হয়ে এ পর্যন্ত ১৪ জন রোগী মারা গেছেন। বিভিন্ন মাধ্যমে বিভাগে ডায়রিয়া আক্রান্ত হয়ে ৩১ জন মারা গেছেন বলে প্রচার করা হচ্ছে। তবে এটা সঠিক নয়। কারণ বাড়িতে মারা যাওয়া বেশ কয়েকজন রোগীর বিষয়ে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা খোঁজ নিয়ে দেখেছেন। তাদের রোগ হিস্ট্রি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, তারা অন্য রোগে আক্রান্ত ছিলেন। দু’একবার পাতলা পয়াখানার কারণে তাদের ডায়রিয়া আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ার কথা বলা হচ্ছে। তবে বিষয়টি একদম ঠিক নয়।

সাইফ আমীন/এফএ/জিকেএস