ভারতের বিজেপির নেতাদের সাম্প্রতিক বক্তব্যে মনে হচ্ছে বাংলাদেশের জামায়াতে ইসলামী এতই শক্তিশালী যে তারা ভারতের রাজনীতিতে বড় ধরনের প্রভাব রাখে। আর এমনই প্রভাব যে তারা কাউকে ক্ষমতায়ও বসাতে পারে।এমনটি ধারণা করার কারণ হলো মঙ্গলবার কলকাতায় দেয়া এক বিজেপি নেতার বক্তব্য। তিনি বলেছেন জামায়াত মমতা ব্যানার্জিকে ক্ষমতায় বসিয়েছে। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর হাত ধরেই ক্ষমতায় এসেছে মমতা। এই নিয়ে কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকা এক প্রতিবেদন ছেপেছে।‘জামাতের হাত ধরেই ক্ষমতায় মমতা, অভিযোগ বিজেপির’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, পশ্চিমবঙ্গে পালাবদলের ভোটে তৃণমূল এবং কংগ্রেসের জোটের সঙ্গে বাংলাদেশের জামায়াতে ইসলামী এবং বিএনপির গোপন সমঝোতা হয়েছিল বলে অভিযোগ তুলল বিজেপি। দলের কেন্দ্রীয় নেতা সিদ্ধার্থনাথ সিংহের দাবি, জামায়াতের সাহায্য নিয়েই রাজ্যের বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী ৭৫টি বিধানসভা আসনের অধিকাংশে জিতেছিল কংগ্রেস-তৃণমূল জোট। এই সমঝোতার জেরেই প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের সঙ্গে ঢাকা সফর বাতিল করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তিস্তা চুক্তি রুখে দিয়েছিলেন কি না, সে প্রশ্নও তুলেছেন পশ্চিমবঙ্গের দায়িত্বপ্রাপ্ত বিজেপির এই কেন্দ্রীয় নেতা।মঙ্গলবার কলকাতায় সিদ্ধার্থনাথ বলেন, “জামায়াতে ইসলামীর সাহায্য নিয়েই সীমান্ত এলাকার ৭৫টি আসনের অধিকাংশে জিতেছিল কংগ্রেস-তৃণমূল জোট। তৃণমূল জিতেছিল ৩২টি এবং কংগ্রেস ১৩টিতে।” সিদ্ধার্থনাথের দাবি, নির্বাচনে সাহায্য পাওয়ার বিনিময়ে তৃণমূল জামাত নেতৃত্বকে আশ্বাস দিয়েছিল, বাংলাদেশে আওয়ামি লিগকে ক্ষমতাচ্যুত করতে তারা যথাসাধ্য সাহায্য করবে।আনন্দবাজার লিখেছে, সিদ্ধার্থনাথের প্রশ্ন, এই সমঝোতার ফলেই কি মনমোহন সিংহের সঙ্গে প্রস্তাবিত বাংলাদেশ সফর বাতিল করেছিলেন মমতা? ২০১১-র ওই সফরে দু’দেশের মধ্যে তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষর হওয়ার কথা থাকলেও মমতার আপত্তিতে তা হতে পারেনি। সিদ্ধার্থনাথ বলেন, “বাংলাদেশের গোয়েন্দাদের রিপোর্ট দু’পক্ষের এই সমঝোতার কথাই বলছে। ও দেশের সংবাদপত্রেই এই খবর প্রকাশিত হয়েছে।” তার তোলা এই অভিযোগ ভুল প্রমাণিত হলে তিনি দুঃখপ্রকাশ করবেন বলেও জানিয়েছেন ওই বিজেপি নেতা।তবে সিদ্ধার্থনাথের অভিযোগকে ‘কাল্পনিক’ আখ্যা দিয়েছেন তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়। তার তির্যক মন্তব্য, “কলকাতায় বসে সিদ্ধিনাথবাবু হালে পানি পাননি। এখন চলে গিয়েছেন সীমান্তে। পাগলে কী না বলে! জামায়াতের বন্ধু কারা বোঝা যাচ্ছে!” এর পরে পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের অভিযোগ, “যা নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের বলার এবং তৎপর হওয়ার কথা, যে তথ্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কাছে থাকার কথা, তা এক জন নেতার কাছে থাকে কী ভাবে? সন্দেহ হয়, রাজনাথ সিংহ কি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নেই?” তার আরও অভিযোগ, “যে সময়ের কথা উনি বলছেন, তখন তৃণমূল ক্ষমতায় ছিল না!” কংগ্রেসও সিদ্ধার্থনাথের অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছে। প্রদেশ কংগ্রেস নেতা আব্দুল মান্নান বলেন, “বিজেপি যা খুশি তাই বলছে। বিধানসভা নির্বাচনে ভোটটা কি বাংলাদেশের মানুষ এসে দিয়ে গিয়েছিল?”প্রতিবেদনে বলা হয়, এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফের কথায়, বিজেপি যে সব অভিযোগ এনেছে তা ভারতের ঘরোয়া রাজনীতির বিষয়। তিনি বলেন, “তবে রাজনৈতিক স্বার্থে মৌলবাদী ও জঙ্গিদের প্রশ্রয় দেয়ার ফল যে কী ধ্বংসাত্মক হতে পারে, বাংলাদেশের মানুষ তা ঠেকে শিখেছেন। আমরা চাই বিশ্বের কোথাও কেউ যেন জঙ্গিদের প্রশ্রয় না দেয়।” হানিফ বলেন, মৌলবাদীদের সাহায্যে ক্ষমতায় এসেছিলেন বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া। রাজনীতিতে আজ তিনি অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গিয়েছেন। ভারতের ঘরোয়া বিষয় নিয়ে তারা কোনো মন্তব্য করতে চান না বলে জানিয়েছেন বিএনপি নেতৃত্বও।প্রতিবেদনে আনন্দবাজার দাবি করছে, তবে সারদা কেলেঙ্কারি থেকে শুরু করে খাগড়াগড় বিস্ফোরণ সব ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের জামাতে ইসালমির সঙ্গে তৃণমূলের যোগসাজসের অভিযোগ উঠে এসেছে। তৃণমূলের এক সাংসদের বিরুদ্ধে সারদার টাকা বাংলাদেশে পাচার করে জামায়াতের জঙ্গি কার্যকলাপে মদত দেয়ার অভিযোগ উঠেছে। আবার খাগড়াগড়ে তৃণমূলের স্থানীয় নেতাদের মদতেই বাংলাদেশে সন্ত্রাস চালানোর জন্য বিস্ফোরক তৈরি হচ্ছিল বলে অভিযোগ। এই সব অভিযোগের সত্যতা এখন খতিয়ে দেখছে এনআইএ এবং অন্যান্য কেন্দ্রীয় সরকারি সংস্থা। বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকেও নানা তথ্য পাচ্ছে তারা। বস্তুত, ভারতের মাটি থেকে বাংলাদেশ-বিরোধী সন্ত্রাসে মদত দেয়ার অভিযোগ করে খোদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির হাতে ডসিয়ের তুলে দিয়েছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।সিদ্ধার্থনাথ খাগড়াগড়ে বাইরেও তৃণমূলের মদতে জঙ্গি কাজকর্ম চলছে বলে অভিযোগ করেছেন। ২০১২ সালের এপ্রিলে কলকাতার মেটিয়াবুরুজের বিস্ফোরণের প্রসঙ্গ তুলে তিনি বলেন, “মেটিয়াবুরুজে যে বাড়িতে বিস্ফোরণ হয়, সেখানে শাকিল আহমেদ থাকত। এই শাকিলই খাগড়াগড় বিস্ফোরণে মারা গিয়েছে। মেটিয়াবুরুজের সেই বিস্ফোরণের সঠিক তদন্ত হলে সে দিনই শাকিলের ধরা পড়ার কথা। খাগড়াগড়ের ঘটনা তা হলে এড়ানো যেত।”তবে মেটিয়াবুরুজের ঘটনার তদন্ত না-হওয়ার অভিযোগ ঠিক নয় বলে দাবি করছে পুলিশ। জঙ্গি সংস্রবের কথা আঁচ করে তদন্তে নামে এসটিএফ-ও (স্পেশ্যাল টাস্ক ফোর্স)। তিন মাসের মাথায় সিমি-র (স্টুডেন্টস ইসলামিক মুভমেন্ট অব ইন্ডিয়া) প্রাক্তন নেতা হারুন রশিদ গ্রেফতার হয়। তারও মাসখানেক পর শিয়ালদহের একটি হোটেল থেকে হারুনের মজুত করা বিস্ফোরক উদ্ধার হয়। এসটিএফের এক অফিসার বলেন, “মেটিয়াবুরুজ বিস্ফোরণের তদন্ত ঠিক ভাবে না হলে হারুন তো গ্রেফতারই হতো না। এটা ঠিক, তখন আমরা শাকিলের নাম জানতে পারিনি।”কলকাতার আর একটি পুরনো অপরাধের প্রসঙ্গও এ দিন উত্থাপন করেছেন সিদ্ধার্থনাথ। গার্ডেনরিচে ২০১৩-র ১১ ফেব্রুয়ারি বোমা বাঁধতে গিয়ে জখম হয় ১৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল কাউন্সিলর রঞ্জিত শীলের ছেলে অভিজিৎ ও তার দুই সঙ্গী। লালবাজারের এক কর্তার স্বীকারোক্তি, “শাসক দলের কয়েক জনের নাম ওই ঘটনায় জড়িয়ে যাওয়ায় তদন্ত সে ভাবে করা হয়নি।”সোমবার সল্টলেকে এনআইএ দফতরের সামনে যে বিস্ফোরণ হয়েছে, সেটিকেও কলকাতায় জঙ্গি তৎপরতার দৃষ্টান্ত হিসেবে দেখিয়েছেন সিদ্ধার্থনাথ। তার কথায়, “জঙ্গিরা বোঝাতে চেয়েছে কলকাতাতেও তারা রয়েছে, অতএব গোয়েন্দারা সাবধান।” খাগড়াগড় কাণ্ডের পর থেকেই বিজেপি নেতৃত্ব এনআইএ তদন্ত চাইলেও মূল অভিযুক্ত সাজিদকে রাজ্য পুলিশই গ্রেফতার করেছে। তবে সিদ্ধার্থনাথের বক্তব্য, “কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাদের তথ্য নিয়েই রাজ্য পুলিশ সাজিদকে ধরেছে। সুতরাং, এটা তাদের একার কৃতিত্ব হতে পারে না।”এই প্রসঙ্গে পার্থর বক্তব্য, “আমাদের পুলিশের যোগ্যতা আছে। এনআইএ-ও সার্টিফিকেট দিয়েছে। এমনকী জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল এ রাজ্যে এসে প্রকাশ্যে বলেছেন, বর্ধমান কাণ্ডের তদন্ত সম্পর্কে তারা সন্তুষ্ট।”একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান বিস্ফোরণের পর যাদের ধরা হচ্ছে তারা জামায়াতে ইসলাম বাংলাদেশ বা জেএমবি সদস্য বলে সেদেশের গোয়েন্দারা দাবি করছে। তবে ভারতের মিডিয়া বিশেষ করে কলকাতার বাংলা পত্রিকাগুলো প্রায়ই জেএমবি না লিখে শুধু ‘জামাত’ লিখে যাচ্ছে। সূত্র : আনন্দবাজার
Advertisement