করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে লকডাউনের কারণে দেশে ৯৯ শতাংশ রোগীর স্বাস্থ্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যার বিভিন্ন মেয়াদী প্রভাবে অনেকে ইতোমধ্যে মারা গেছেন এবং আরও অনেকের মৃত্যুর আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। আর লকডাউন দীর্ঘায়িত করলে জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন দেশের ৯ জন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ।
Advertisement
রোববার (২ মে) ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাগর-রুনি মিলনায়তনে ‘জনস্বাস্থ্যে লকডাউনের প্রভাব’ শীর্ষক এক সেমিনারে বক্তারা শঙ্কা প্রকাশ করে এসব তথ্য জানান। সেমিনারে ৯ জন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের পক্ষে লিখিত বিবৃতি পাঠ করেন অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের অধ্যাপক বিশিষ্ট অনুজীববিজ্ঞানী ড. মুহম্মদ মঞ্জুরুল করিম।
বিবৃতিতে বিশেষজ্ঞরা বলেন, গত বছর করোনাভাইরাস আসার পর আমাদের দেশের স্বাস্থ্য বিভাগের নন-কোভিড রোগীদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি ডেকে এনেছে। ২০২০ সালে দেশে মোট মৃত্যু ছিল ৮ লক্ষাধিক, কিন্তু করোনায় মৃত্যু ঘটে মাত্র ৮ হাজার লোকের, যা মোট মৃত্যুর মাত্র ১%। এ ১% মৃত্যুকে হ্রাস করতে গিয়ে বৈষম্যমূলক আচরণ করে বাকি ৯৯% মৃত্যুকে তরান্বিত করা হয়েছে। বিশেষ করে, লকডাউন দেয়ার ফলে এই ৯৯% রোগীর স্বাস্থ্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যার বিভিন্ন মেয়াদী প্রভাবে অনেক লোক ইতোমধ্যে মারা গেছে এবং আরও অনেকের মারা যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
যেমন- বিবিএসের মনিটরিং দ্য সিচুয়েশন অব ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, ২০২০ সালে হার্ট অ্যাটাকে মারা যায় ১ লাখ ৮০ হাজার ৪০৮ লোক, যা ২০১৯ সালের তুলনায় ২০% বেশি। ব্রেন স্ট্রোকে মারা যায় ৮৫ হাজার ৩৬০ জন, যা ২০১৯ সালের তুলনায় দ্বিগুণ। ২০২০ সালে কিডনি জটিলতায় মারা যায় ২৮ হাজার লোক, যা আগের বছরের তুলনায় প্রায় ৩ গুণ (সূত্র : ডেইলি স্টার ; ১০ মার্চ ২০২১)। কিডনি সংক্রান্ত জটিলতায় মৃত্যুর সংখ্যা প্রায় তিনগুণ হয়ে যাওয়া প্রসঙ্গে বিবিসির কাছে এক সাক্ষাৎকারে স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক নাসিমা সুলতানা নিজেও স্বীকার করেছেন, করোনা ও লকডাউন-ই এ মৃত্যু বৃদ্ধির মূল কারণ, (সূত্র : বিবিসি; ১১ মার্চ ২০২১)।
Advertisement
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, লকডাউনের কারণে মানুষের আর্থিক অসংগতি বৃদ্ধি পায়, যে কারণে মানুষ জরুরি ওষুধপত্র ক্রয় ও পরীক্ষা (স্ক্রিনিং), অপরেশন ও চিকিৎসা সেবা গ্রহণের সামর্থ হারাচ্ছে। ফলশ্রুতিতে নিকট ভবিষ্যতে দেশে মৃত্যুহার মারাত্মক আকারে বৃদ্ধির আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
মূলত বিজ্ঞান মতে, চিকিৎসা ও জনস্বাস্থ্যর ওপর কোনো পদক্ষেপ নেয়ার আগে তার সেফটি ও এফিকেসি (কার্যকারিতা) পরিমাপ করে, সে অনুসারে পদক্ষেপ নিতে হয়। সেটা শুধু ১% নয়, বরং শতভাগ জনগণের ওপর পরিমাপ করতে হয়। কিন্তু এক্ষেত্রে তা না করে, তাড়াহুড়ো করে লকডাউন দিয়ে দেয়া হয়েছে। যার মাশুল এখন জনস্বাস্থ্যে ভয়ঙ্কর আকারে দৃশ্যমান হচ্ছে।
অনেকে লকডাউনের প্রয়োজনীয়তা প্রমাণ করতে গিয়ে যুক্তি দিয়ে থাকেন, লকডাউন দিয়ে সংক্রমণ রোধ না করলে করোনায় মৃত্যুর সংখ্যা ১% না হয়ে আরও বেশি হতো। তারা এই ধরনের চটজলদি সিদ্ধান্ত লকডাউনের সেফটি-এফিকেসি নিয়ে গবেষণা না করেই বলে থাকেন।
মুলত লকডাউনের এফিকেসি গতবছর এপ্রিল মাসে প্রশ্নবিদ্ধ হয় যখন ইতালির বিভিন্ন শহরে লকডাউনের ডাটা প্রকাশ হতে থাকে। যেমন- ইতালির ভেনটো অঞ্চলের গ্রাফে দেখা যাচ্ছে, করোনায় মৃত্যুর ওপর লকডাউনের কোনো কার্যকর ভূমিকা নেই।
Advertisement
এ প্রসঙ্গে, অতি সম্প্রতি ঢাকা মেডিকেল কলেজের কেন্দ্রীয় তথ্যকেন্দ্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, হাসপাতালটিতে স্বাভাবিক অবস্থায় দৈনিক ৩৫০-৪০০ জন রোগী (নন-কোভিড) ভর্তি হয়। কিন্তু লকডাউনে রোগী ভর্তি হচ্ছে মাত্র ৭০-১০০ জন। একই অবস্থা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়েও (বিএসএমএমইউ)। যেখানে স্বাভাবিক সময়ে দৈনিক নন-কোভিড রোগী ভর্তি হয় ১৫০-২০০ মতো। অর্থাৎ, লকডাউনে হাসপাতালে সাধারণ রোগীর আগমন ৭০-৮০% পর্যন্ত হ্রাস পাচ্ছে। তাই সঠিক পদ্ধতিতে লকডাউনের এফিকেসি (কার্যকারিতা) প্রমাণিত হয় না, বরং লকডাউনের কার্যকারিতা ঋণাত্মক বলে প্রমাণিত হয়।
লকডাউনের এফিকেসি প্রমাণিত না হলেও লকডাউনের সেফটি নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। অনেক এলাকায় লকডাউনে ‘স্টে হোম স্টে সেফ’ প্রচারণাও ক্ষতিকর রূপে প্রমাণিত হয়েছে। জরিপে উঠে এসেছে, যারা বাসায় দীর্ঘদিন নিজেদের বন্দি রাখছেন করোনায় তারাই বেশি অসুস্থ হচ্ছেন। এ সম্পর্কে ২০২০ সালে মে মাসে নিউইয়র্ক হাসপাতালের প্রকাশিত তথ্যে পাওয়া যায়, হাসপাতালে ভর্তি ৬৬% রোগী ‘স্টে হোম স্টে সেফ’ নীতি অনুসরণ করে নিজেকে বাসায় বন্দি করে রেখেছিলেন। (তথ্যসূত্র: সিএনবিসি, ৬ মে, ২০২০)
বিবৃতিদাতারা হলেন- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীব বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মঞ্জুরুল করিম, ভ্যারিটাস প্রাইভেট লিমিটেডের এমবিএম রুহুল হাসান, আইসিইউ স্পেশালিস্ট ডাক্তার মুহম্মদ নুরুল আফসার, মুহম্মদ আসাদুজ্জামান (ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের সহকারী অধ্যাপক ফার্মেসি বিভাগ), ডা. মুহম্মদ মহসিন রেজা চৌধুরী, ডা. মুহম্মদ মুজাহিদুর হাসান, ড. এস.এম. ইবনে শাইখ, ডা. মুহম্মদ জর্জিসুর রহমান, ফার্মাসিস্ট আব্দুল্লাহ আল মামুন।
এইচএস/এমএসএইচ/জেআইএম