দিন যত যাচ্ছে; শঙ্কার মেঘ ততই ঘনীভূত হচ্ছে। নতুন ভোর আসছে ঠিকই কিন্তু সেখানে আশার আলোর দেখা মিলছে না। কারণ দুনিয়াজুড়ে রাজত্ব করছে করোনাভাইরাস। সময়ের পরিক্রমায় লাশের মিছিলটাও দীর্ঘ হচ্ছে। সংকটময় পরিস্থিতিতে সম্মুখে থেকে মুষ্টিমেয় কয়েকজন মানুষ মানবসেবায় নিজেকে উজাড় করে দিচ্ছেন। এমনই একজন মানুষ নোয়াখালীর পুলিশ সুপার (এসপি) আলমগীর হোসেন।
Advertisement
করোনা আক্রান্ত হয়ে যারা শ্বাসকষ্টজনিত রোগে ভোগেন; তাদের কথা চিন্তা করে কোভিড অক্সিজেন ব্যাংক চালু করার উদ্যোগ নেন নোয়াখালীর একজন পুলিশ সদস্য। সেই উদ্যোগকে কাজে লাগাতে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেন পুলিশ সুপার আলমগীর হোসেন। তারপর থেকে তাদের এ কাজ ব্যাপক প্রশংসা কুড়াচ্ছে।
সম্প্রতি জাগো নিউজের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় কাজের আদ্যোপান্ত নিয়ে কথা বলেছেন এসপি আলমগীর। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এস কে শাওন—
জাগো নিউজ: কোভিড অক্সিজেন ব্যাংক শুরুর গল্পটা জানতে চাই—আলমগীর হোসেন: করোনার যখন প্রথম ঢেউ শুরু হয়েছে; তখন মানুষের মধ্যে নানা সন্দেহ-সংশয় ছিল। এককথায় বলবো মানুষের মধ্যে একটা ভীতি কাজ করছিল। ওই সময়ে মানুষ আপনজনের লাশ ফেলে চলে গেছে। এমন চিত্র আমাদের চোখে পড়েছে। ওই পরিস্থিতিতে হাসপাতালে কোভিডের রোগী সঙ্কুলান করা যাচ্ছিল না। তাছাড়া আমাদের দু’ জন পুলিশ সদস্যও করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। তখন তাদের ঢাকায় নিতে গিয়ে অক্সিজেন শেষ হয়ে যাওয়ায় বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছিল। তখন আমরা চিন্তা করলাম যারা বাসায় চিকিৎসা নিচ্ছেন, তাদের যদি এই সেবা (অক্সিজেন সরবরাহ) দেওয়া যায়, তাহলে অন্তত কিছু মানুষের উপকারে আসবে। পরে আমরা কোভিড অক্সিজেন ব্যাংক চালু করি ২০২০ সালের ২৮ জুন।
Advertisement
জাগো নিউজ: অক্সিজেন সিলিন্ডারের অর্থায়ন হলো কিভাবে?আলমগীর হোসেন: আমাদের কিছু হিতৈষী অক্সিজেন সিলিন্ডারের অর্থ দিয়ে সহায়তা করেছেন। আর রিফিল করার যে কাজ, সেটা জেলা পুলিশের তরফ থেকে করা হচ্ছে।
জাগো নিউজ: আপনারা এখন কয়টি অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে কাজ করছেন?আলমগীর হোসেন: আমরা মোট ৫৫টি অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে কাজ করছি। তবে ১০টি অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে কাজ শুরু করেছিলাম।
জাগো নিউজ: অক্সিজেন সিলিন্ডার সরবরাহ করতে গিয়ে কোনো প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হচ্ছেন?আলমগীর হোসেন: তেমন কোনো প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হইনি। যারা করোনা আক্রান্ত হচ্ছেন, তাদের পক্ষ থেকে কেউ এসে অক্সিজেন সিলিন্ডার না নিতে পারলে তখন আমরা পৌঁছে দেই। আর নোয়াখালী ছাড়াও কুমিল্লা, লক্ষ্মীপুর ও ফেনী থেকেও অক্সিজেন সিলিন্ডার অনেকে চেয়েছেন। আমরা তাদেরও সহায়তা করেছি।
জাগো নিউজ: নোয়াখালী জেলা পুলিশের কাজ দেখে অন্যরাও কি উৎসাহিত হচ্ছেন?আলমগীর হোসেন: আমি যতদূর জানি, নরসিংদীসহ আরও কয়েকটি জেলায় এ সেবা চালু হয়েছে। তবে শুরুটা প্রথম আমরাই করেছিলাম।
Advertisement
জাগো নিউজ: আপনার পরিবার বিষয়টিকে কীভাবে দেখছে?আলমগীর হোসেন: এটি তো মানবিক কাজ। মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারছি বলে আমার পরিবার খুব খুশি। করোনা মহামারীতে বর্তমানে যে পরিস্থিতি, সেখান থেকে মানুষের জন্য কিছু করতে পারছি এটা সবার জন্যই খুব আনন্দের। কারণ সবাই এই সুযোগ পান না।
জাগো নিউজ: করোনায় এ কাজ ছাড়া অন্য কোনো উল্লেখযোগ্য কাজ করেছেন কি-না?আলমগীর হোসেন: করোনায় গত বছরে আমরা অনেককেই সহায়তা করেছি। যেমন- কর্মহীনদের খাদ্য সহায়তা দিয়েছি। এখানকার সংবাদকর্মীদের মধ্যে খাদ্য সহায়তা বিতরণ করেছি। ওই সময়ের অনেককে খাদ্য সহায়তা দিয়েছি। মাস্ক, হ্যান্ড স্যানিটাইজার বিতরণ করেছি। মাস্ক বিতরণের কার্যক্রম এখনো চলছে। পুলিশের হেড কোয়ার্টার থেকে যে কার্যক্রমগুলো চালু আছে- মানুষকে সচেতন করা, মাইকিং, লিফলেট বিতরণ আমাদের এখানেও চলমান।
জাগো নিউজ: নোয়খালীতে অন্যান্য পুলিশ সদস্য যারা আছেন, তারা আপনাকে কিভাবে সহায়তা করছেন?আলমগীর হোসেন: রোগীরা সুস্থ হয়ে গেলে দেখা যায় যে, অক্সিজেন সিলিন্ডার লাগছে না। কিন্তু ভুলে যায় যে এটি ফেরত দিতে হবে। তখন পুলিশ সদস্যরা সিলিন্ডারটি ফেরত নিয়ে এসে অন্য রোগীকে দিচ্ছেন। তাছাড়া রোগীদের শুধু অক্সিজেন সিলিন্ডার দিয়ে দিলেই হচ্ছে না। এটিকে অপারেটিংয়ের ব্যাপার আছে। এটিকে কীভাবে ব্যবহার করতে হয়, তা পুলিশ সদস্যরা শিখিয়ে দিচ্ছেন। এভাবেই সবাই এ কাজে সহায়তা করছেন।
জাগো নিউজ: কাজটি করতে আপনাকে সবচেয়ে বেশি উৎসাহ দিচ্ছেন কে?আলমগীর হোসেন: নোয়াখালীর ট্রাফিক পুলিশ পরিদর্শক এস এম কামরুল হাসান আমাকে প্রস্তাব দিলেন যে, রোগীদের জন্য অক্সিজেন সিলিন্ডার সরবরাহ করা যায় কি-না। বিষয়টি তিনি উত্থাপন করলে আমরা কাজ শুরু করি। আমরা বিভিন্ন জায়গায় যোগাযোগ করে কাজের পরিধি বাড়ানোর চেষ্টা করছি। যাতে মানুষ আমাদের কাছে সাপোর্ট চেয়ে কোনোভাবে নিরাশ না হয়। মোটকথা পুলিশ সদস্যরা সবাই এ কাজ খুব আগ্রহ নিয়েই করছেন, সবাই উৎসাহ দিচ্ছেন।
জাগো নিউজ: আপনারা যে মানবিক কাজ করছেন, তা নিয়ে ভবিষ্যতে কোনো পরিকল্পনা আছে কি?আলমগীর হোসেন: আমরা চাচ্ছি যে, কাজটি করছি এটিই যেন সফলভাবে করতে পারি। যতদিন কোভিড আছে, এ সেবা চালু থাকবে। এটি বিনা মূল্যের সেবা। অনেক জায়গায় দেখা যায়, এ সেবা নিতে গেলে টাকা দিতে হয়। কিন্তু আমরা অক্সিজেন সিলিন্ডার সার্ভিস পুরোপুরি ফ্রি দিচ্ছি। দুর্দিনে মানুষের পাশে দাঁড়ানোই আমাদের লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য। তাছাড়া মানুষের মাঝে মাস্ক বিতরণ, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ব্যাপারে মানুষকে সচেতন করা আমাদের কাজ। সমাজসেবামূলক যে কাজগুলো আছে। যেমন- দরিদ্র লোকদের সাহায্য করা, এ কাজগুলো আমরা অব্যাহত রেখেছি।
জাগো নিউজ: সামনে ঈদ এবং লকডাউন চলমান। দরিদ্র মানুষকে জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে কোনো সহযোগিতা দেওয়া হবে?আলমগীর হোসেন: জেলা পুলিশের এ ধরনের কাজ করার নির্দিষ্ট কোনো তহবিল নেই। তবে কাজগুলো আমরা নিজেদের উদ্যোগে করি। যারা সদস্য আছেন, তাদের মধ্য থেকে কিছু এবং হিতৈষী যারা আছেন; তাদের সাথে নিয়ে আমরা এ ধরনের সহায়তাগুলো করি। যাদের প্রকৃত চাহিদা আছে, তাদেরই সহায়তা করি।
এসইউ/এমএস