বিশেষ প্রতিবেদন

বিএনপিতে নীতিনির্ধারণী ফোরাম পুনর্গঠনের তাগিদ

দীর্ঘ সময় ক্ষমতার বাইরে থাকা দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি নানা সংকটে জর্জরিত। দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া সরকারের শর্তসাপেক্ষে মুক্তি পেলেও মূলত তিনি বিএনপি বা রাজনীতিতে কোনো ভূমিকা পালন করতে পারছেন না। অন্যদিকে দলের দ্বিতীয় শীর্ষ নেতা তথা ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমান দীর্ঘ সময় ধরে রয়েছেন দেশের বাইরে।

Advertisement

বর্তমানে দলের নিয়ন্ত্রণ তারেক রহমানের হাতে থাকলেও দেশের বাইরে থেকে তিনি কতটা সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন বা পারবেন তা নিয়ে রয়েছে নানা আলোচনা। বিএনপির প্রতি সহানুভূতিশীল বুদ্ধিজীবীরাও মনে করেন, দূর থেকে দেশের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করা খুবই কঠিন কাজ।

অন্যদিকে বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী কমিটি নিয়েও দলের নেতাদের মধ্যে রয়েছে হতাশা। কাউন্সিল তো হওয়ার কোনো খবর নেই, বিশাল কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক সবশেষ কবে হয়েছে তা যেন বিএনপির শীর্ষ নেতারাই মনে করতে পারছেন না। এছাড়া একমাত্র কার্যকরী কমিটি জাতীয় স্থায়ী কমিটির অবস্থাও খুব বেশি ভালো নয়। শূন্যতা বিরাজ করছে সেখানেও। দলের অধিকাংশ সিদ্ধান্ত যেহেতু ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমান এই কমিটির সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমেই নেন, তাই এই নীতিনির্ধারণী ফোরাম সংস্কারের তাগিদ বোধ করছেন নেতাকর্মীরা।

জানা গেছে, বিএনপির ১৯ সদস্যের স্থায়ী কমিটির পাঁচটি পদ শূন্য। শারীরিক অসুস্থতা ও বিদেশে অবস্থান করায় চারজন সবসময়ই থাকেন অনুপস্থিত। সবশেষ স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের মৃত্যুতে আরও একটি পদ শূন্য হলো। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ইস্যুতে কর্মসূচি গ্রহণে সময়মতো সিদ্ধান্ত নিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে দলটিকে। শুধু তাই নয়, সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনায় কেন্দ্রীয় দিকনির্দেশনা প্রদানেও একই পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে।

Advertisement

বিএনপিতে স্থায়ী কমিটি বরাবরই একটি আকর্ষণীয় ও মর্যাদাসম্পন্ন পদ। আজীবন বিএনপির রাজনীতি করা পোড় খাওয়া নেতাদের টার্গেট থাকে শেষ জীবনে হলেও স্থায়ী কমিটিতে জায়গা করে নেয়া। দু-একটি ব্যতিক্রম বাদে এ ফোরামে সাংগঠনিকভাবে যোগ্য, পরীক্ষিত, ত্যাগী ও দলে তুলনামূলক গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিদেরই স্থান হয়। তাই প্রায় সব সিনিয়র নেতার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু স্থায়ী কমিটির সদস্য হওয়া। এ কমিটি নির্বাচনের প্রার্থী চূড়ান্ত, কর্মসূচি প্রণয়ন থেকে শুরু করে সার্বিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের কাজগুলো করে। স্থায়ী কমিটির সুপারিশের আলোকেই বেশিরভাগ সময় বিএনপির শীর্ষ নেতারা সিদ্ধান্ত দিয়ে থাকেন। অন্তত খালেদা জিয়ার ক্ষেত্রে এমনটি হয়েছে।

বিএনপির পরবর্তী কাউন্সিল কবে হবে তা নিয়ে এখনই কোনো তথ্য জানা যাচ্ছে না। নিকট ভবিষ্যতে হবে কি-না, তাও বলছেন না কেউ। এমতাবস্থায় যোগ্য, দক্ষ, নবীন-প্রবীণের সমন্বয়ে স্থায়ী কমিটি পূরণের কথা বলছেন দলের নেতাকর্মীরা। স্থায়ী কমিটি ছাড়াও দলের নির্বাহী কমিটির শূন্যপদগুলোও পূরণের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে বলে মনে করছেন তারা।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির একটি বৈঠকের ছবি। এ বৈঠকে থাকা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ (ডান পাশের সারির কোট পরিহিত) আর বেঁচে নেই

সর্বশেষ ২০১৬ সালের ১৯ মার্চ ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিল করে বিএনপি। দলটির গঠনতন্ত্র অনুযায়ী জাতীয় নির্বাহী কমিটি তিন বছরের জন্য নির্বাচিত হয়ে থাকে এবং পরবর্তী জাতীয় নির্বাহী কমিটি দায়িত্ব গ্রহণ না করা পর্যন্ত এ কমিটিই দায়িত্ব পালন করে। ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিল শেষে দলটির জাতীয় স্থায়ী কমিটির ১৯ সদস্যের মধ্যে ১৭ জনের নাম ঘোষণা করা হয়েছিল। এর মধ্যে চারজন মারা গেছেন। তারা হলেন তরিকুল ইসলাম, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আ স ম হান্নান শাহ, এমকে আনোয়ার ও ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ।

Advertisement

এছাড়া রাজনীতি থেকে অবসর নিয়েছেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান। যদিও তার পদত্যাগপত্র বিএনপির পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ বা প্রত্যাখ্যান কোনোটিই করা হয়নি। এর মধ্যে ২০১৯ সালের জুনে সেলিমা রহমান ও ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুকে স্থায়ী কমিটির শূন্যপদে নিয়োগ দেয়া হয়।

সেই হিসাবে এখন এই কমিটির সদস্য সংখ্যা ১৪ জন। এখনো ফাঁকা পাঁচটি পদ। এর মধ্যে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা  ও আইনি জটিলতাসহ পারিপার্শ্বিক সীমাবদ্ধতার কারণে তার রাজনীতিতে ফেরাটা অনিশ্চিত। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমান লন্ডনে অবস্থান করছেন। সেখান থেকেই ভার্চুয়ালি স্থায়ী কমিটির বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন। মামলা জটিলতায় সালাহউদ্দিন আহমেদ রয়েছেন ভারতের শিলংয়ে। অসুস্থ আছেন ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া। বয়সের কারণে বৈঠকে নিয়মিত নন ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার। এছাড়া মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান, আব্দুল মঈন খানসহ সিনিয়র যেসব নেতা রয়েছেন, প্রত্যেকেই বার্ধক্যজনিত জটিলতায় ভুগছেন।

সূত্র জানায়, ২০১৯ সালের মার্চে বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির মেয়াদ শেষ হয়েছে। চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কারাগারে থাকায় মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও কাউন্সিলের উদ্যোগ নেয়নি দলটি। এর মধ্যে আবার গত বছরের মার্চ থেকে দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরু হয়েছে।

সবকিছু মিলে শিগগির জাতীয় কাউন্সিল হচ্ছে না বলে দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা জানিয়েছেন। তারা মনে করেন, দলের কার্যক্রমকে গতিশীল করতে স্থায়ী কমিটির শূন্যপদ পূরণের বিষয়ে খুব দ্রুতই সিদ্ধান্ত নেবে হাইকমান্ড।

অনেকেই মনে করেন বিএনপিতে তরুণ নেতৃত্বকে আরও সামনে নিয়ে আসা উচিত। এ দলে অনেক তরুণ নেতা আছেন যারা যোগ্য, কিন্তু অবহেলিত। তাদের সামনে আনা হচ্ছে না। লন্ডনের নেতৃত্ব হোক বা ঢাকার নেতৃত্ব হোক, তারা নিশ্চয়ই জানেন কারা সাম্প্রতিক সময়ে দলে বড় ভূমিকা পালন করেছেন। এমন একটা নেতৃত্ব আনতে হবে, যারা আগামী ১০ বছর দলকে সুন্দরভাবে পরিচালিত করতে পারবেন। সেক্ষেত্রে যারা বয়স্ক, ঠিকভাবে হাঁটাচলা করতে পারছেন না তাদের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য করা প্রয়োজন। না হলে বিএনপি এক ধরনের নেতৃত্বশূন্যতার মধ্যে দিয়ে যাবে, দলকে চাঙ্গা করতে পারবে না।

নেতৃত্বে জটিলতার কারণে বিএনপি সরকারবিরোধী আন্দোলন জমাতে পারছে না বলে মনে করেন নেতাকর্মীরা

তবে, দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরামে জিয়া পরিবারের সদস্য ও তারেক রহমানের সহধর্মিণী ডা. জোবায়দা রহমান, এমনকি কন্যা জাইমা রহমানের অন্তর্ভুক্তির দাবিও রয়েছে দলের বিভিন্ন পর্যায় থেকে। খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হওয়ায় ক্লিন ইমেজের ডা. জোবায়দা দলকে গোছাতে পারবেন বলে অনেকেই মনে করেন। সেক্ষেত্রে শাহজাহান ওমর, হাফিজউদ্দিন আহমেদ, শামসুজ্জামান দুদু, এজেডএম জাহিদ হোসেন, আব্দুল আউয়াল মিন্টু, আসাদুজ্জামান রিপন, আমান উল্ল্যাহ আমান, রুহুল কবির রিজভী, সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, হাবিব উন নবী খান সোহেল, শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি, রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু, জহির উদ্দিন স্বপন, ফজলুর রহমান, শামা ওবায়েদদের স্থায়ী কমিটিতে জায়গা দেয়া দরকার এখনই।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরাও মনে করেন, বিএনপি অনেক ক্ষেত্রেই এক ধরনের নেতৃত্বশূন্যতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। দলটিতে একটা ঢাকাকেন্দ্রিক নেতৃত্ব আছে, লন্ডন থেকে আছে আরেকটি নেতৃত্ব। ফলে সব মিলিয়ে দলে একটা জটিলতা তৈরি হয়েছে। তাই যেভাবে শূন্যপদগুলো পূরণ করা দরকার তা হচ্ছে না। যে কারণে দলটি সঠিক নেতৃত্ব পাচ্ছে না।

দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের এক নেতার ভাষ্য, প্রবীণ নেতারা বিএনপির সম্পদ। তাদের শিক্ষা-দীক্ষা ও রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার কোনো তুলনা নেই। দল পুনর্গঠন করা হলে তাদের অবশ্যই সম্মানজনকভাবে বিদায় দিতে হবে। তাদের থেকে এখনো আমাদের অনেক কিছুই শেখার আছে। এই নেতাদের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে তরুণ নেতৃত্বকে বিএনপির হাল ধরতে হবে।

এ বিষয়ে বিএনপিপন্থি বুদ্ধিজীবী হিসেবে পরিচিত ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, ‘বিএনপিতে যারা বয়স্ক, শক্তি নেই—তাদের দিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের কৌশল ঠিক করা সম্ভব নয়। কারণ স্থায়ী কমিটির সদস্যরা মাঠে থাকলেই নেতাকর্মীরা উজ্জীবিত হবেন। কিন্তু স্থায়ী কমিটিতে এখন ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকারের মতো বয়স্ক ও ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়ার মতো অসুস্থ কয়েকজন আছেন। বয়সের কারণে যাদের মস্তিষ্কের শিরাগুলো ঘুমিয়ে পড়েছে। স্থায়ী কমিটিতে ইয়াংদের জায়গা দিতে হবে এবং অবিলম্বে জাতীয় কাউন্সিল করা উচিত।’

এ প্রসঙ্গে বিএনপির দফতরের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স বলেন, ‘এই মুহূর্তে আমরা কাউন্সিলের কথা ভাবছি না। করোনায় আমরা বিপর্যস্ত-বিধ্বস্ত, দল পুনর্গঠনের কার্যক্রম স্থগিত রয়েছে।’

কেএইচ/এমআরআর/এইচএ/জিকেএস