টেস্টে বাংলাদেশের অষ্টম সেরা বোলিং ফিগারটি (৩৪.৩-৮-৯৭-৯) তার। আর এক টেস্টের এক ইনিংসে পেসারদের মধ্যে সেরা বোলিং নৈপূণ্যটিও সাহাদাত হোসেন রাজিবের। সেটা দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ঢাকার শেরে বাংলা স্টেডিয়ামে। গ্রায়েম স্মিথ আর নেইল ম্যাকেঞ্জিসহ দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে মাত্র ২৭ রানে ৬ উইকেট দখল করে হইচই ফেলে দিয়েছিলেন সাহাদাত হোসেন রাজিব।
Advertisement
পাশাপাশি মাশরাফির পরে (৩৬ টেস্টে ৭৮) এখনো পেসারদের দ্বিতীয় সর্বাধিক (৩৮ টেস্টে ৭২) উইকেট শিকারীও সাহাদাত হোসেন রাজিব।
কিন্তু মাঠের বাইরের অনাকাঙ্খিত অনৈতিক কর্মকান্ড আর মাঠে অখেলোয়াড়োচিত কার্যক্রমের কারণে পাঁচ বছর নিষিদ্ধ হয়েছিলেন, গত জাতীয় লিগের আগে শাস্তিমুক্ত হলেও আর মাঠে নামা হয়নি। তবে এখনো জাতীয় দলে ফেরার স্বপ্ন দেখেন এ দীর্ঘদেহী পেসার।
আজ শনিবার জাগো নিউজের সাথে আলাপে সে ইচ্ছের কথাই শুনিয়েছেন রাজিব...
Advertisement
জাগো নিউজ : কেমন আছেন রাজিব?
রাজিব : আছি ভাই মোটামুটি।
জাগো নিউজ : মোটামুটি কেন, কোন সমস্যা?
রাজিব : হ্যাঁ, আমার আম্মুতো ক্যান্সারে ভুগছেন। অবস্থা বিশেষ ভাল না। অলমোস্ট লাস্ট স্টেজে আছেন।
Advertisement
জাগো নিউজ : কোথায় আছেন আপনার মা এখন, হাসপাতালে?
রাজিব : নাহ! বাসায়। এখন আর হাসপাতালে রাখার স্টেজও নাই। তাই নারায়নগঞ্জে আমাদের বাসায়ই রেখেছি।
জাগো নিউজ : হঠাৎ ইংল্যান্ডে খেলার ইচ্ছে জাগলো যে?
রাজিব: কারণ হলো করোনা যেভাবে জেঁকে বসেছে, এর প্রভাব যেভাবে বেড়েছে- তাতে করে প্রিমিয়ার লিগ হবে কি না, সন্দেহ। তাই আমি বাইরে গিয়ে খেলতে চাই। অর্থটা এখানে বিবেচ্য না। আমার খেলাটা হতো। না হয় বাসার ভিতরে আর কতদিন? প্রিমিয়ার লিগ হবে কি না নিশ্চয়তা নেই।
জাগো নিউজ : কেন আপনি না শাস্তিমুক্ত হলেন, জাতীয় লিগে দল পাননি?
রাজিব : জাতীয় লিগে তো আর আমাকে নেয়নি। ঘুরিয়ে বললে দল পাইনি। কারণ আমি যখন নিষেধাজ্ঞামুক্ত হলাম, তখন আসলে সব দল হয়ে গিয়েছিল। কাজেই আমাকে কেউ আর নেয়নি। আমিও পীড়াপিড়ি করিনি। আমার পুরনো দলকেও নেয়ার জন্য চাপ দেইনি। তবে বিভিন্ন দলের নেটে বোলিং করেছি।
ইমরুল কায়েসরা সবাই বলাবলি করলো তুই এখনো অনেক ভাল বল করিস। তোরে আমরা নিয়ে নেই। পরে আর হয়নি। এক বিভাগের ক্রিকেটারকে অন্য বিভাগ কী আর নিতে চায় বলুন!
জাগো নিউজ : তাহলে এখন কিভাবে কাটছে সময়? দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে এক ইনিংসে ৬ উইকেট আছে, টেস্টে এমন মানের বোলার এখনো বেরিয়ে আসেনি। আপনি নেই। এটা কতটা কষ্টের, কতটা দুঃখের?
রাজিব : এটা আসলে অনেক কষ্টের। বলে বোঝাতে পারবো না কতটা খারাপ লাগে। আমি কিভাবে বলবো, মনে হয় না আমার বয়স ফুরিয়ে গেছে। আমার বেস্ট ফ্রেন্ড মুশফিক আর ভাল বন্ধু সাকিব এখনো আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে দারুন পারফর্ম করছে। দেশকে সার্ভিস দিচ্ছে। আর আমি নেই। পড়ে আছি বাইরে। আমি কিছুই করতে পারছি না। এটা যে কত খারাপ লাগার, ভিতরে রক্তক্ষরণ হচ্ছে।
অজকে তাসকিনকে তেখে খুব ভাল লাগলো। আবার তার বোলিং দেখে নিজের কথাও মনে হলো। আমিও এক সময় এমন তেড়েফুড়ে বল করেছি। দ্রুত গতি, বাউন্সার, সুইং আর পুরনো বলে রিভার্স সুইং করে প্রতিপক্ষ ব্যাটসম্যানদের কাছ থেকে সমীহ আদায় করে নিয়েছি। দক্ষিণ আফ্রিকার মত দলের বিপক্ষে এক ইনিংসে ৬ উইকেট শিকারের রেকর্ডও আছে আমার। তাসকিনের বোলিং দেখে অনেক ভাল লেগেছে। আবার অন্য ইচ্ছেও জেগেছে।
জাগো নিউজ : কি ইচ্ছে হলো আপনার?
রাজিব : বারবার মনে হয়েছে ইস! আমি যদি তাসকিনের সাথে থাকতাম। তার পার্টনার হিসেবে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে বোলিং করতে পারতাম। হ্যাঁ, মানছি আমি হয়ত তাসকিনের মত বেশির ভাগ ডেলিভারি ১৪০ কিলোমিটারের আশপাশে ছুঁড়তে পারতাম না, তবে মনে হয় আমার এখনো টেস্ট খেলার সামর্থ্য আছে এবং আমি সুযোগের অপেক্ষায়।
তাসকিনের মত একজন চমৎকার পার্টনার পেলে হয়ত নিজেকে আবার মেলে ধরতে পারতাম। আমি যখন খেলেছি আমার সঙ্গে মাশরাফি ভাই ছিলেন। মাশরাফি ভাই যে টেস্টে আহত হলেন আমিও ছিলাম ওই ম্যাচে। তাকে আমিই ধরাধরি করে মাঠের বাইরে নিয়ে গিয়েছিলাম।
লাইফে আমি অলওয়েজ ‘থ্রেট বোলার’ হতে চেয়েছি। আমি সৌভাগ্যবান ওই থ্রেট বোলিং পার্টনার হিসেবে মাশরাফি ভাইকে পেয়েছিলাম। তার সাথে খেলেওছি। তারপর আমার সাথে আসলো সৈয়দ রাসেল। আমি ওইভাবে থ্রেট বোলার আর পাইনি।
প্রচন্ড গতি, বাউন্সার ছুড়ে ব্যাটসম্যানকে ভড়কে দেয়া এবং প্রতিপক্ষ শিবিরে ভয় ধরানোর মত বোলার আমাদের আর আসেনি। আমার খুব ইচ্ছে ছিল আমিও এমন বোলার হবো; কিন্তু নানা কারণে আর হয়ে ওঠা হয়নি। আমার নিজের কাছে অনেক খারাপ লাগে।
আমিও হতে চেয়েছিলাম এমন এক বোলার। জানিনা আর কখনো সুযোগ পাব কি না! তবে আমি এখনো স্বপ্ন দেখি জাতীয় দলে খেলার। অন্তত আরও দুই তিন বছর জাতীয় দলকে সার্ভিস দেয়ার ইচ্ছে রাখি। সুযোগের অপেক্ষায় আছি।
জাগো নিউজ : আপনি কি বিশ্বাস করেন যে আপনার পক্ষে আবারো জাতীয় দলে ফেরা সম্ভব? আপনার বয়স, ফিটনেস কী জাতীয় দলে ফেরার মত? আপনার বোলিংয়েও কী সেই ধার আছে?
রাজিব : আমি সুযোগের অপেক্ষায়। আমার বিশ্বাস আমি পারবো। তাসকিনের কাম ব্যাকটা দেখে আরও অনুপ্রাণিত হয়েছি। ওহ কি দারুণ কামব্যাক করেছে তাসকিন! আবেগে না কনফিডেন্টলি বলছি, আমি আবার কামব্যাক করতে পারবো। যেমন মাঝে দেড় বছর বাইরে থেকে ঠিক ফিরেছিলাম। ফিরে ওয়ানডে ম্যাচও খেলেছিলাম। টেস্টে হয়ত আমাকে ডাকা হয়নি। ২০১৯ সালে নিউজিল্যান্ড সফরে যাওয়ার আগে সুমন ভাই (হাবিবুল বাশার) বলেছিলেন তোকে আমরা আবার টেস্টে নিতে চাই।
জাগো নিউজ : কিন্তু আপনি তো প্র্যাকটিস ম্যাচে নিজেকে মেলে ধরতে পারেননি।
রাজিব : হ্যাঁ, স্বীকার করছি এর মধ্যে একটি প্র্যাকটিস ম্যাচে সুযোগ পেয়েছিলাম। তবে প্র্যাকটিস ম্যাচে তেমন ভাল করতে পারিনি। বাংলাদেশ টিমে অনেক দিন খেলেছি। অভিজ্ঞতা আছে। আমি আর একটিবার সুযোগ চাই। কামব্যাক করার প্লাটফর্ম করে দিলে আমি সামর্থের সবটুকু উজাড় করে দিতাম। আমি মনে করি, এখনই সময়। ৩০ পেরিয়ে গেছে, এখন পরিপূর্ণ আমি।
জাগো নিউজ : ক্যারিয়ারকে আপনি কিভাবে মূল্যায়ন করবেন? দ্রুত গতির সাথে বাউন্সার আর ইয়র্কার দিয়ে প্রতিপক্ষ ব্যাটসম্যানকে ব্যতিব্যস্ত করার কথা কী মনে পড়ে না?
রাজিব : অনেক মনে হয়। আমার সেই ভাল দিনের স্মৃতিগুলো নিজে নিজে রোমন্থন করি। সেই ভাল স্পেলগুলোর ভিডিও দেখি। ভাল লাগে। আবেগ কাজ করে।
জাগো নিউজ : দেখে কী মনে হয়?
রাজিব : মিশ্র প্রতিক্রিয়া। ভাল লাগে। আবার খারাপও ফিল করি। বারবার মনে হয়, আজ কোথায় থাকার কথা ছিল আমার। পারিনি। তবে তাসকিনকে দেখে মনে হচ্ছে মানুষের অসাধ্য কিছু নেই। কেউ ভাবেনি তাসকিন এভাবে ফিরে আসতে পারবে। কিন্তু তাসকিন ফিরে এসেছে। বীরের মত। প্রচন্ড গরমেও কী বোলিংটাই না করছে। কষ্ট করেছে। ফলও পেয়েছে। সবই আল্লাহর ইচ্ছে। আমিও কষ্ট করতে চাই। চারদিনের ম্যাচ বেশি বেশি করে খেলতে চাই। ইনশাল্লাহ ট্রাই করছি। দেখি কি হয়?
জাগো নিউজ : আপনি যে দুই বছর মাঠের বাইরে ছিলেন তা নিয়ে কিছু বললেন না?
রাজিব : নাহ! সেটাতো অনেক খারাপ অনুভুতি। মাঠের বাইরে থাকার যন্ত্রণা আসলে কত- তা কোনো কারণে মাঠের বাইরে ছিটকে পড়লেই বোঝা যায়। খুব কষ্টে ছিলাম। তবে আমি খুব বেশি কিছু মিস করিনি। ওই সময়টায় একটি বিপিএল খেলা হয়নি। আর একটি প্রিমিয়ার লিগ এক রাউন্ড হয়েই বন্ধ হয়ে গেছে করোনার কারণে।
ঈদের পরে প্রিমিয়ার লিগ শুরু হলে মন দিয়ে খেলতে চাই। একজন ট্রেনার রেখেছি নিজেকে ফিট রাখার। আমি আবার মাঠে ফিরতে চাই। আমার মা’র স্বপ্ন, আবার জাতীয় দলে ফিরি। আমি এই রোজার মাঝেও চেষ্টা করছি। রোজা রেখে পারি না। ইফতারের পরে রানিং করি এলাকায়। আর রাত ১০ থেকে ১১টার দিকে জিমে যাই। ট্রেনারকে সাথে নিয়ে জিম করি।
এআরবি/আইএইচএস