মতামত

অদৃশ্য সূতার টানে থমকে যায় উচ্ছেদ?

তেজগাঁও সাতরাস্তা মোড় থেকে কারওয়ান বাজার রেল ক্রসিং। রিক্সায় যেতে বড়জোর পাঁচ মিনিটের দূরত্ব। কিন্তু নিয়মিত যারা এই পথ পাড়ি দেন, কেবল তারাই জানেন এই পথের দূরত্ব কত মিনিটের। বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি, মিনিটের হিসাব কখনো কখনো ঘন্টার কাঁটা ছুঁয়ে যায়। ঢাকার রাস্তায় দীর্ঘ সময় যানজটের ভোগান্তি আমাদের নিত্যদিনের। এটা এখন গা সওয়া একটা ব্যাপার। কিন্তু সাতরাস্তা থেকে কারওয়ান বাজারতো কেবল জটের ভোগান্তি না। এর প্রতিটি মুহূর্ত স্বাস্থ্যঝুঁকিরও বটে। অপরিচ্ছন্ন গোটা এলাকাটিই। সড়কটির পাশ ঘেঁষেই তেজগাঁও ট্রাকস্ট্যান্ড। মাঝে মাঝে তাই ঠাওর করার উপায় থাকে না, কোথায় সড়ক আর কোথায় স্ট্যান্ড। কারণ স্ট্যান্ড ছাপিয়ে সড়কের দুই পাশতো বটেই, পুরো সড়কজুড়েই দাঁড় করিয়ে রাখা হয় ছোট বড় ট্রাক। ডিজেল-পেট্রোলের গন্ধের সঙ্গে সব সময়ই মিশে থাকে মানববর্জ্যের পুঁতিগন্ধ। বাতাসে ভেসে বেড়ায় ধুলোবালি। সবমিলিয়ে এমন অস্বাস্থ্যকর একটি সড়ক তেজগাঁওয়ের আর কোথাও আছে কিনা- বলা মুশকিল।শহর ঢাকার এতসব গুরুত্বপূর্ণ সড়ক ফেলে হঠাৎ কেন মাত্র এক কিলোমিটার পথ নিয়ে এত কথার অবতারণা? অনিয়ম, দুর্নীতি আর অপরাধের মাত্রা বোঝার জন্য রাজধানীর এই এক কিলোমিটার সড়ক আর তার আশপাশের এলাকাটি ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে ট্রাকস্ট্যান্ডের পাশে থাকা প্রায় ৩৯ বিঘা জায়গা। যার মালিকানা রেলওয়ের। কিন্তু পুরোটাই এখন বেদখল। ট্রাকস্ট্যান্ড অবৈধ দোকানপাট, পুরোনো ও বিকল ট্রাকের দখলে। তাই সারি সারি ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান রাখা হয় সড়কের দুই পাশজুড়ে। ট্রাকস্ট্যান্ডের ভেতরে অর্ধশতাধিক মেরামত কারখানা। এসব দোকানের যন্ত্রাংশ, অব্যবহৃত ও বাতিল জিনিসপত্র পুরো স্ট্যান্ডকে ময়লার ভাগাড়ে পরিণত করেছে। মাদকও বিক্রি হয় দেদারছে। সন্ধ্যার পরতো বটেই, কখনো কখনো দিনে-দুপুরেই চলে ছিনতাই। পুরো এলাকার যানজট তৈরি হয় এখান থেকেই। জায়গাটি তাই তেজগাঁওয়ের বিষফোঁড়া।এই বিষফোঁড়া তুলে ফেলার দাবি, পরিকল্পনা অনেক দিনের। কিন্তু কোথায় যেন একটা সূতার টান থাকায় এর চিকিৎসা হচ্ছিলো না কখনোই। একেবারেই যে কখনো চেষ্টা হয়নি তা কিন্তু নয়। যখনই ওষুধ দেয়া হয়েছে তখনই টান পড়েছে অদৃশ্য সূতায়। সেই টানে ওষুধ পড়ে গেছে। বিষফোঁড়া সারেনি কখনোই। অদৃশ্য ওই সূতা যে কখনো কাটা পড়েনি তা কিন্তু নয়। সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ের কথা নিশ্চয়ই মনে আছে সবার। ওই সময় একবার উচ্ছেদ করা হয় তেজগাঁও ট্রাকস্ট্যান্ডের সব অবৈধ স্থাপনা। আশ্চর্যের বিষয় কোনো বিক্ষোভ তখন হয়েছে বলে আমার অন্তত মনে পড়ে না। বরং দ্বিগুণ বিস্ময় নিয়ে আমার মতো অনেকেই দেখেছে কি বিশাল একটি জায়গা বেদখল হয়েছিলো দীর্ঘদিন। রাস্তার পাশে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে থাকতো ট্রাক, কাভার্ডভ্যান। ওই সময়টায় কখনো ওই সড়কে যানজটে পড়েছি বলেও মনে পড়ে না। কিন্তু নির্বাচনের পর গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় আসলে বিশাল সেই জায়গা বেদখল হতে সময় লাগেনি খুব একটা। ওই পথে চলাচলকারীরা এখনো দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে সময়ের কথা মনে করে।তবে এ বছরের মধ্য অক্টোবরে কিছুটা আশার আলো দেখা যায়। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে একটি সভার আলোচনা অনুযায়ী সিদ্ধান্ত হয় তেজগাঁও ট্রাকস্ট্যান্ড সরিয়ে নেয়া হবে অন্য কোথাও। স্ট্যান্ডের ভেতরের কোনো জায়গা যাতে গ্যারেজ হিসাবে ব্যবহৃত না হয়- নিশ্চিত করা হবে সেটি। যানজট নিরসনের লক্ষ্যেই এমন সিদ্ধান্ত। বলা হয়,  কোনো অবস্থাতেই ট্রাক-কাভার্ডভ্যান তেজগাঁও অঞ্চলের রাস্তার উপর রাখা যাবে না। প্রথম পর্যায়ে রেলওয়ের জায়গায় অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে সেখানে ট্রাক-কাভার্ডভ্যান সারিবদ্ধভাবে রাখা হবে। রাজধানীর চারপাশে বিভিন্ন স্থানে গড়ে তোলা হবে বহুতল ট্রাকস্ট্যান্ড। এ জন্য জায়গার প্রাপ্যতার বিষয়ে দায়িত্ব দেয়া হয় ঢাকার জেলা প্রশাসককে।সরকারের এই সিদ্ধান্তকে কতজন গুরুত্ব দিয়েছে তা বলা মুশকিল। কারণ এ ধরনের সিদ্ধান্ত বহুবার বহুক্ষেত্রে নিয়েছে সরকার। তার বাস্তবায়ন খুব একটা দেখা যায়নি। তবে এবার কিছুটা ব্যতিক্রম দেখা যায়। কারণ ১ নভেম্বর থেকে তেজগাঁও ট্রাকস্ট্যান্ডের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন ও ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান মালিক সমিতির মধ্যে কথা হয়েছে দফায় দফায়। রেলপথমন্ত্রী মুজিবুল হক ও ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান মালিক সমিতির নেতাদের নিয়ে তেজগাঁও ট্রাকস্ট্যান্ড এলাকা পরিদর্শনও করেন উত্তরের মেয়র আনিসুল হক। তখন তিনি ৭ নভেম্বরের মধ্যে তেজগাঁওয়ে রেলওয়ের জায়গার অবৈধ স্থাপনা সরিয়ে ফেলতে সময়সীমা বেঁধে দেন। সাফ বলে দেন, না সরালে ৮ নভেম্বর সেগুলো উচ্ছেদ করা হবে।ঢাকায় এই প্রথম একজন মেয়র পেলাম আমরা যিনি ঘোষণা আর প্রতিশ্রুতির কথা মনে রেখেছিলেন। যথারীতি ৮ নভেম্বর তেজগাঁও ট্রাকস্ট্যান্ডে গিয়ে হাজির আনিসুল হক। গিয়ে দেখেন সবকিছু আছে আগের মতোই। ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান মালিকদের নতুন সময়সীমা দিয়ে আসলেন তিনি। মালিক সমিতিও আশ্বাস দেয় ২৭ নভেম্বরের মধ্যেই সবকিছু সরিয়ে ফেলবে তারা। কথা দিয়েছিলো অবৈধ স্থাপনাও উচ্ছেদ করবে নিজেরাই। সে মোতাবেক তারা কাজও করে কিছু। কিন্তু পুরোপুরি কাজ না হওয়াতে ২৯ নভেম্বর উচ্ছেদ অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত নেয় ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষ।বোঝাই যাচ্ছিলো অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ না করে ছাড়বেন না মেয়র সাহেব। আমরাও প্রতীক্ষায় ছিলাম, দেখা যাক কি ঘটে ২৯ নভেম্বর। কথা ও কাজে মিল রাখতেই দুপুরের দিকে তেজগাঁও ট্রাকস্ট্যান্ডে হাজির আনিসুল হক। সিটি কর্পোরেশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাতো ছিলেনই, মেয়রের সঙ্গে ছিলেন রেলপথমন্ত্রী মুজিবুল হকও। ঘটনাস্থলে থাকা প্রতিবেদকের মুখ থেকে এ কথা শুনেই বুঝতে পারলাম এবার আর অবৈধ দখলদারদের নিস্তার নেই। আবার শঙ্কাও ছিলো। দীর্ঘদিন ধরে যারা অবৈধ দখল নিয়ে কোটি কোটি টাকার ব্যবসা করছে, যাদের পেছনে রয়েছে অদৃশ্য সূতার টান- তারা কি এত সহজেই মেনে নেবে সব? না মেনে নেয়নি তারা। অবধারিতভাবেই উচ্ছেদ শুরু করতেই এসেছে বাধা। ইট-পাটকেল ছোঁড়া হয়েছে মেয়র আর মন্ত্রীকে লক্ষ্য করে। বাধ্য হয়ে তারা ঠাঁই নিয়েছেন ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান চালক ইউনিয়নের কার্যালয়ে। রাস্তায় তখন রীতিমতো রণক্ষেত্র। পুলিশের ছররা গুলি, শ্রমিকদের ইট-পাটকেল। কোথাও টায়ারে জ্বলছিলো আগুন। ছড়িয়ে দেয়া হয় শ্রমিক নিহতের গুজব। বেশ কিছুক্ষণ চলে পুলিশ-শ্রমিক সংঘর্ষ।ট্রাক চালকদের কার্যালয়ের ভেতরে তখন অবরুদ্ধ থাকলেও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ এক মেয়রকেই আমরা দেখতে পাই বিভিন্ন বেসরকারি টেলিভিশনের লাইভ সম্প্রচারের কল্যাণে। স্পষ্টই তিনি জানিয়ে দেন, ‘যারা মাস্তানি করছেন, তাদের বলছি—এসব মাস্তানি চলবে না। আমার পেছনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর, মানুষের সমর্থন আছে। ঢাকা শহরে এসব অবৈধ কাজ হবে না।’ এমন দৃঢ়চেতা নগরপিতাই আমরা চেয়েছি এতদিন। আমি নিশ্চিত রাজধানীর অনেক উৎসুক মানুষেরই চোখ তখন টেলিভিশনগুলোর পর্দায়। সবাই জানতে চাচ্ছিলো, বুঝতে চাচ্ছিলো- শেষ পর্যন্ত কি হয়।তিন থেকে সাড়ে তিন ঘন্টা ইউনিয়ন কার্যালয়ে অবরুদ্ধ থাকলেন আনিসুল হক। এরপর বেরিয়ে এসে হ্যান্ড মাইকে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখলেন ট্রাক চালক ও শ্রমিকদের উদ্দেশ্যে। কি বললেন তিনি? মেয়র বললেন, ‘আপনারা আমাকে ভোট দিয়ে মেয়র বানিয়েছেন। আমি আপনাদের ছেলে। আপনারা আমাদের সহযোগিতা করুন। আমরা আপনাদের জন্য ভালো টার্মিনাল তৈরি করব।’ নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্য দিয়ে চলে গেলেন মেয়র। স্থগিত হয়ে গেলো অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ। কেন স্থগিত করা হলো উচ্ছেদ অভিযান, তার ব্যাখ্যা কিন্তু দিয়ে গেলেন না মেয়র মহোদয়। স্বাভাবিকভাবেই তাই প্রশ্ন উঠেছে, মেয়র কি তবে সূতার টানে হেরে গেলেন? তার দৃঢ় মনোবলেও কি তবে টান পড়লো?অবৈধ দখলমুক্ত, পরিচ্ছন্ন রাজধানীর যে স্বপ্ন আমরা দেখি- তা কি স্বপ্ন হয়েই থেকে যাবে? তেজগাঁও ট্রাকস্ট্যান্ডের মতো অসংখ্য জায়গা এভাবে দখল হয়ে আছে পুরো শহরে। চলছে অবৈধ ব্যবসা, ঘটছে নানা অপরাধ। এসব থেকে মুক্তি দেয়ার প্রতিশ্রুতিই দিয়েছিলেন দুই মেয়র আনিসুল হক আর সাঈদ খোকন। আনিসুল হক মাঠে নেমেছেন। হেরে গেছেন কিনা এখনই বলার সময় আসেনি। হয়তো কৌশলগত কারণে কিছুটা সময় নিলেন তিনি। কিন্তু দক্ষিণের মেয়র সাঈদ খোকন কি করছেন? গুলিস্তানের ফুটপাত দখলমুক্ত করতে একটা মতবিনিময় সভা করেছেন মাত্র। হকারদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন রাস্তা আটকে না বসতে। মেয়রের আহ্বানে যে সাড়া দেয়নি কেউ তা গুলিস্তানে গেলেই বোঝা যায়। সাঈদ খোকন যদি হকারদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা আগে করে তারপর উচ্ছেদের কথা ভেবে থাকেন- সেটি নিশ্চিতভাবেই সমর্থনযোগ্য। কিন্তু তারও নিশ্চয়ই জানা আছে, এই ঢাকা শহরের হকারদের পুনর্বাসনে এর আগেও বেশ কয়েকবার ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। তাদের জন্য গড়ে তোলা হয়েছে আলাদা বিপণী বিতান। মেয়র নিশ্চয়ই এও জানেন, সেসবের দখল কাদের কাছে? প্রকৃত হকাররা কি সেখানে ব্যবসা করতে পেরেছে, পারছে? নাকি অদৃশ্য সূতার মালিক যারা- তারাই সবকিছু করে খাচ্ছে, করে খাবে?  ঢাকার দুই মেয়রের কাছে তাই অনুরোধ, নগরবাসীকে কেবল প্রতিশ্রুতি আর চমক লাগানো পরিকল্পনার মায়াজালে আটকে রাখবেন না। কারণ অদৃশ্য সূতা না কাটা পর্যন্ত আপনাদের কোনো পরিকল্পনাই কাজে আসবে না। কাজে আসতে দেয়া হবে না। আপনারা হয়তো জানেন অদৃশ্য সূতার এক প্রান্ত কাদের হাতে। সেই হাতগুলোকে গুঁড়িয়ে দেন। কেটে ফেলুন সূতা। তাহলেই কেবল আপনাদের আর কখনোই কোনো প্রতিশ্রুতি দিতে হবে না। শুধু পরিকল্পনা করবেন, আর বাস্তবায়ন হবে।লেখক : বার্তা সম্পাদক, এসএটিভিshahariar@journalist.comএইচআর/এমএস

Advertisement