মাঝে নিউজিল্যান্ড সফরে শুধু ছিলেন না। তখন ড্যানিয়েল ভেট্টোরিই স্পিনারদের সাথে কাজ করেছেন। এছাড়া ঘরের মাঠে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সিরিজে আর এখন শ্রীলঙ্কা সফরে স্পিন কোচ হিসেবে আছেন সোহেল ইসলাম। টিম বাংলাদেশের কোচিং স্টাফদের মধ্যে একমাত্র বাংলাদেশি।
Advertisement
খেলোয়াড়ি জীবনে অফস্পিনার সোহেল ইসলাম দেশের ক্রিকেটের অন্যতম সুতিকাগার ‘বিকেএসপির’ ছাত্র। বিকেএসপিতে পড়া অবস্থায় ঢাকার ক্লাব ক্রিকেটে হাতেখড়ি। ব্রাদার্স ইউনিয়ন আর সূর্যতরুণের মত প্রতিষ্ঠিত দলে খেলেছেন।
এরপর ২০০৯ সাল থেকে কোচিংয়ে জড়িয়ে পড়া। এখন জাতীয় দলের পার্টটাইম স্পিন কোচের দায়িত্ব পালন করলেও সোহেল ইসলাম এমনিতে বিসিবির বেতনভুক্ত প্রশিক্ষক এবং বয়স ভিত্তিক ও এইচপির কোচিংয়ে জড়িত। বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৭ দলেরও হেড কোচ সোহেল।
এছাড়া ঢাকার ক্লাব ক্রীড়াঙ্গনের অন্যতম শীর্ষ ও জনপ্রিয় দল মোহামেডানের প্রধান কোচের দায়িত্ব পালন করছেন প্রায় ছয়-সাত বছর ধরে।
Advertisement
এই যে ভেট্টোরির জায়গায় তাকে স্পিন কোচ হিসেবে নিয়োগ দেয়া। ঠেকা কাজ চালানো। এটা কতটা উপভোগ করেন সোহেল? প্রস্তাব পেলে কী জাতীয় দলের স্পিন কোচের দায়িত্ব পালন করবেন? তার কোচিংয়ের ভুয়সি প্রশংসা তাইজুল-মিরাজদের মুখে। কী এমন জাদু আছে সোহেলের হাতে?
এসব নিয়েই আজ সকালে মুঠোফোনে জাগো নিউজের সাথে খোলামেলা কথা বলেছেন সোহেল ইসলাম।
জাগো নিউজ : আপনি এখন অনূর্ধ্ব-১৭ দলের হেড কোচ, সেখান থেকে যদি জাতীয় দলের স্পেশালাইজড কোচের প্রস্তাব দেয়া হয়, তাহলে কী গ্রহণ করবেন?
সোহেল : হেড কোচ থেকে স্পেশালিস্ট কোচ হবো কি না!
Advertisement
জাগো নিউজ : হ্যাঁ, ঠিক তাই।
সোহেল : দেখেন যে পদেই থাকেন হেড কোচ কিংবা স্পেশালাইজড কোচ- জাতীয় দলে কোচিং প্যানেলে থাকতে পারাটাই অনেক গর্বের। অনেক সম্মানের। আমি যখন ২০১৪ সালে বিসিবিতে কোচ হিসেবে যোগদান করি, তখন কিন্তু আমার পদবী ছিল ফিল্ডিং কোচ এবং আমি কিন্তু ৭ বছর আগে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ঘরের মাঠে সিরিজে জাতীয় দলের ফিল্ডিং কোচ হিসেবেই প্রথম কাজ করি।
এখন আমি এইচপি কোচ। ফিল্ডিংয়ের পাশাপাশি অনূর্ধ্ব-১৯, এইচপি সব জায়গায়ই আমি স্পিন কোচিংটাও দেখি। তার পরিপ্রেক্ষিতে এখন আমি জাতীয় দলে স্পিন কোচিংটা দেখছি। অবশ্যই এটা একটা প্রাইডের ব্যাপার।
জাগো নিউজ : তার মানে আপনি বলতে চাচ্ছেন, আপনাকে যদি এখন অনূর্ধ্ব-১৭ দলের হেড কোচ আর এইচপির ফিল্ডিং-স্পিন কোচ থেকে এনে জাতীয় দলের স্পিন কোচ করা হয় আপনি তাতে কাজ করতে রাজি বা করবেন?
সোহেল : হ্যাঁ, করবো। এটা একটা ব্যাপার আমার পরিবারের একটা সমস্যা আছে। অনেক ট্যুর থাকলে আমার জন্য জাতীয় দলের হয়ে কাজ করা একটিু কঠিন। আমার পরিবার, স্ত্রী-সন্তান সবাই ঢাকার বাইরে। অনেক ট্যুর থাকলে সমস্যা হয়।
তবে একটা কথা, আমি যদি স্পেশালিষ্ট স্পিন কোচ হিসেবে কাজ নাও করি, তাও আমি বাংলাদেশের স্পিনারদের নিয়ে কাজ করে যাব। করিও। আমি এটা নিজের দায়বদ্ধতার থেকেই করি।
জাগো নিউজ : তাইজুল-মিরাজ আপনার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। আপনার সাথে কাজ করে তারা খুব তৃপ্ত। এটার মুল কারণ কী? ভাষা, সংস্কৃতি একই হওয়া? মানে আপনার সাথে যতটা স্বচ্ছন্দে কথা বলতে পারেন তারা, নিজেদের ভাল-মন্দ নিয়ে কথা বলতে পারেন, সে কারণেই কী আপনার প্রশংসায় পঞ্চমুখ তারা?
সোহেল : না না, ভাষা ও সংস্কৃতি এর কোনটাই ফ্যাক্টর না। বড় কারণও না। আসল কারণ হলো, ক্রিকেটাররা সবার আগে দেখে কার কাছে গেলে তার লাভ হবে। তিনি লাভবান হবেন। এখানে ভাষা ও সংস্কৃতি একই খুব কিছু না। আসলে প্রফেশনাল ক্রিকেটে পারফরমাররা তার কাছেই যেতে চায়, যার কাছে গেলে লাভবান হওয়া যায়।
যদি মনে হয় আমেরিকা থেকে এসে কেউ আপনার সাথে কাজ করবে এবং তার কাছে গেলেই আপনার লাভ হবে। আপনার ভাল মন্দ নিয়ে তার সাথে খোলামেলা কথা বলতে পারবেন, সে আপনার ত্রুটি বিচ্যুতি, ছোট-খাট সমস্যা শুধরে দিতে পারবেন- আপনি খুব স্বাভাবিকভাবে তার কাছেই যাবেন। এখানে তাইজুল-মিরাজের ব্যাপারটাই তাই। তারা নিশ্চয়ই উপকৃত হয়, হয়েছে- তাই হয়ত আমাকে তাদের ভাল লেগেছে। আমার সাথে কাজ করে তারা সন্তুষ্ট। এখানে আবেগ দিয়ে চিন্তা করার অবকাশ নেই।
জাগো নিউজ : তাহলে কী আপনি বোঝাতে চাচ্ছেন, যে তাইজুল-মিরাজরা ভাষা ও সংস্কৃতি এক হওয়ার কারণেই আপনার সাথে কাজ করতে স্বচ্ছন্দ বোধ করছেন না?
সোহেল : নাহ। শুধু ভাষা, সংস্কৃতি আর ভাল ব্যবহার কখনোই একজন স্পেশালিস্ট কোচের মূল মানদণ্ড হতে পারে না। তার ক্যাপাবিলিটিও একটা বড় ফ্যাক্টর। কোচিং অ্যাবিলিটি, টেকনিক্যাল, ট্যাকটিক্যাল ও স্পিনের সুক্ষ্ম কারুকাজগুলো শেখানোর ক্ষমতা থাকাও জরুরি।
এগুলোই মূল যোগ্যতা, আপনাকে অবশ্যই স্পিন বোলিংয়ের টেকনিক্যাল, ট্যাকটিক্যাল ও সুক্ষ্ম কারুকাজগুলো শেখানোর, বোঝানোর ক্ষমতা থাকতে হবে। তবেই আপনার সাথে কাজ করে ক্রিকেটাররা তথা স্পিনাররা উপকৃত হবে। আপনার সাথে কাজ করতে আগ্রহী হবে। শুধু ভাষা আর সংস্কৃতির জন্য নয়।
জাগো নিউজ : আপনাকে বোধকরি প্রশ্নটা বোঝাতে পারিনি। আপনি বাংলায় কথা বলেন, আপনার কথা সহজবোধ্য এবং আপনার কোচিং ম্যাথডটা রপ্ত করা তাইজুল-মিরাজদের সহজ হচ্ছে কি না? তারা স্বচ্ছন্দবোধ করছেন কি না?
সোহেল : হ্যাঁ, আমার তথা আমাদের দেশের কোচদের কোচিং স্ট্র্যাটেজি অবশ্যই তারা পছন্দ করে। এই স্ট্র্যাটেজি অনুসরণ করাও তাদের জন্য সহজ। এছাড়া আরও একটি বড় কারণ আছে।
বলি শুনুন, যখন মাঠে কোন একটা বড় চ্যালেঞ্জ আসে। প্রতিপক্ষ ব্যাটসম্যান যখন চিন্তার, মাথা ব্যাথার কারণ হন। রীতিমত ‘থ্রেট’ হয়ে দাঁড়ান। তখন আমি বা আমরা স্থানীয় কোচরা বুঝতে পারি যে, ওই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আমাদের ছেলেদের সামর্থ্য কতটা? তারা ওই পরিস্থিতি মোকাবিলায় টেকনিক্যালি কতটা দক্ষ, পারঙ্গম- আমি খুব ভাল বুঝি।
কঠিন পরিস্থিতিতে তাদের কার কতটুকু মেন্টাল স্ট্রেন্থ আছে, সবই আমার জানা। কারণ তাদের প্রায় সবার বেড়ে ওঠা এবং পরিণত হওয়া চোখের সামনে। তাদের প্লাস, মাইনাস, দক্ষতা, অদক্ষতা, সীমাবদ্ধতা আর ঘাটতির জায়গাগুলো আমার নখদর্পনে। আর আমার মনে হয় ঠিক ওই সময় অন্যদের চেয়ে আমি ঠিক সে প্ল্যানগুলো ভাল বাতলে দিতে পারি। ওই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কার কী করণীয়, কার কোথায় সমস্যা হচ্ছে- সেটা খুব ভাল বুঝতে পারি। এটা আমার অ্যাডভান্টেজ।
জাগো নিউজ : বলেন শ্রীলঙ্কায় জাতীয় দলের সঙ্গে কাজ করাটা কতটা উপভোগ করছেন?
সোহেল : অবশ্যই ভাল লাগছে। অনুভুতি চমৎকার। তবে এমন নয় এটা খুব স্পেশাল কিছু। কারণ জাতীয় দলের সাথে এটাই আমার প্রথম সম্পৃক্ততা নয়। আমি কিন্তু জাতীয় দলের সাথে এর আগেও অনেকবার কাজ করেছি। জাতীয় দলের সাথে প্রথম যুক্ত হয়েছি ৭ বছর আগে ২০১৪ সালে। নিউজিল্যান্ডের সাথে হোম সিরিজে। তারপরও বহুদিন হয়েছে জাতীয় দলের সাথে। কখনো এসেছি। কাজ করেছি। আবার করিনি। আবার যুক্ত হয়েছি। আমি সব সময়ই জাতীয় দলের সাথে কাজ করাটা উপভোগ করি। এটা একটা বড় সম্মানও।
জাগো নিউজ : প্রথম টেস্টের উইকেটে স্পিনারদের আসলে করার কিছু ছিল না। তারপরও আপনি স্পিনারদের পারফরমেন্সে কতটা সন্তুষ্ট?
সোহেল : মোটা দাগে বলতে গেলে আমি সন্তুষ্ট। কারণ স্পিন কোচ হিসেবে আমার প্রথম দেখার বিষয় হলো আমরা যে লক্ষ্য-পরিকল্পনা নিয়ে শ্রীলঙ্কা এসেছিলাম, তার কতটা ফুলফিল হয়েছে। বেশি হয়ে থাকলেই কোচ হিসেবে আমার সন্তুষ্টি। আমি সন্তুষ্ট। কারণ আমাদের দুই স্পিনার এই পাল্লেকেল্লের ব্যাটিং সহায়ক উইকেটে প্রচন্ড গরমে ৫১ ওভার বল করে ওভার পিছু ২.২ রান করে দিয়েছে।
তাইজুল ৩৭ ওভার বল করে ১৩৮ রান দিয়েছে। অলমোস্ট ওভার পিছু ৩ রান। আমার মনে হয় মিরাজ আমাদেরকে ম্যাচে ধরে রেখেছিল। চতুর্থ দিন মিরাজ-তাইজুল দুই স্পিনার রানের গতি নিয়ন্ত্রনে না রাখলে আমাদের আরও চাপে পড়ে যেতে হতো। লঙ্কানরা আরও আগে এক থেকে দেড়শো রানে এগিয়ে ইনিংস ঘোষণা করে দিত। আর আমাদের হয়ত শেষ দিনের পুরো তিন সেশন উইকেটে কাটাতে হতো।
সেটা অবশ্যই বাড়তি চাপের আর কঠিন কাজ হতো। মিরাজ আর তাইজুল লঙ্কানদের রান তোলার গতি কমিয়ে রাখায় তারা আগে আমাদের রান টপকে অন্তত ১০০ প্লাস রান বেশি করে ইনিংস ঘোষণার সুযোগটা পায়নি।
কাজেই শুধু উইকেট প্রাপ্তি দিয়ে বিচার বিবেচনা করলে চলবে না। দেখতে হবে ম্যাচে আমাদের স্পিনারদের ইনপ্যুট কী ছিল? আমার মনে হয় মিরাজ আর তাইজুল দারুণ বোলিং করেছে। ফ্ল্যাট ট্র্যাক। এখানে প্রচন্ড ধৈর্য্য আর মনোসংযোগ নিয়ে ব্যাটসম্যানের মতিগতি বুঝে বল করতে হয়। মিরাজ ঠিক সেই কাজটিই দারুণভাবে করেছে। তাইজুলও তাই করার প্রাণপন চেষ্টা করেছে।
ফ্ল্যাট উইকেটে যখন বলের কারুকাজ কম হবে, বল ঘুরবে না, উইকেটে ক্ষত কম তৈরি হবে। বল ঘোরানোর সুযোগ ও অবকাশ কম থাকবে- তখন অ্যাটাক না করে কিভাবে ধৈর্য্য ধরে ব্যাটসম্যানকে স্বচ্ছন্দে খেলা থেকে বিরত রাখা যায় এবং লম্বা সময় ধরে কিভাবে মাপা বোলিং করা যায়- সেটাই ছিল ক্যান্ডি টেস্টের অগ্নি পরীক্ষা।
আমি বলবো আমাদের স্পিনাররা প্রথম টেস্টে তা করে দেখিয়েছে এবং খুবই ভাল করেছে। মিরাজ ৫০ ওভার বোলিং করে দুই রান করে দেয়ার সামর্থ্য ছিল না। তাইজুলেরও একই অবস্থা ছিল। উইকেটে না পেলে আক্রমণাত্মক হয়ে বল করতে গিয়ে বাড়তি রান দিয়ে ফেলতো। এবার তা করেনি। স্পিনাররা আমাদের প্ল্যান মতই বল করেছে।
জাগো নিউজ : লঙ্কানরা দ্বিতীয় টেস্টে দলে একজন বাড়তি স্পিনারের অন্তর্র্ভূক্তি ঘটিয়েছে। তাতে করে কী মনে হয় এই পাল্লেকেলে স্টেডিয়ামে পরের টেস্টের উইকেট কিছুটা স্পিন ফ্রেন্ডলি হতে পারে?
সোহেল : উইকেট এখনো বলতে পারছি না। আমার মনে হয় না আমার মেইন স্ট্রেন্থ যেহেতু স্পিন, তাই লঙ্কানরা মনে হয় না স্পিন সহায়ক ট্র্যাক তৈরি করবে। মানে স্পিন বান্ধব উইকেট চাইবে না। আমার মনে হয় প্রথম টেস্টের মতই উইকেট থাকবে।
এআরবি/আইএইচএস/এমএস