সাহিত্য

হুমায়ুন আজাদের কবিতা ও কবিশক্তি

আবু আফজাল সালেহ

Advertisement

‘এ লাশ আমরা রাখবো কোথায়?/তেমন যোগ্য সমাধি কই?/মৃত্তিকা বলো, পর্বত বলো/অথবা সুনীল-সাগর-জল-/সব কিছু ছেঁদো, তুচ্ছ শুধুই!/তাইতো রাখি না এ লাশ/আজ মাটিতে পাহাড়ে কিম্বা সাগরে,/হৃদয়ে হৃদয়ে দিয়েছি ঠাঁই-’ (এ লাশ আমরা রাখবো কোথায়?)। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ১৯৭৮ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি কবিতায় প্রতিক্রিয়া হুমায়ুন আজাদের। আমরা ড. হুমায়ুন আজাদকে লেখক হিসেবেই জানি। কিন্তু আরেকটি সত্তা আছে, কবিসত্তা। এ ক্ষেত্রে কিশোর কবিতাও আছে। সেগুলোও চমৎকার ও পাঠকপ্রিয়। ভাষাবিজ্ঞানী বা প্রাবন্ধিক আলোচনার ভিড়ে এ প্রতিভা খুব কমই আলোচিত হয়। কবিতা ক্ষেত্রে অনেক মূল কবির চেয়ে তাঁর অবদান কম নয়। তাঁর সমতুল্য কিশোর কবিতা এখনকার অনেক শিশুসাহিত্যিকই নির্মাণ করতে পারেননি। তাঁর কবিতা নির্মাণে যে মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন, তা আলোচনার দাবি করতেই পারে। কবিতায় ব্যবহৃত শব্দাবলী ও যুতসই ব্যবহার পাঠককে মুগ্ধ করে। অনেক কবিতা আবার অনেকের মুখে মুখে। এখনকার অনেক প্রতিষ্ঠিত কবির চেয়ে তাঁর কবিতার শিল্পমান, গুণ অনেক উন্নত। কবিতার সৌষ্ঠব অতুলনীয়। তাঁর বেশ কয়েকটি সফল কাব্যগ্রন্থ আছে।

হুমায়ুন আজাদ আমৃত্যু কাব্যচর্চা করে গেছেন। তিনি ষাটের দশকের কবিদের সমপর্যায়ী আধুনিক কবি। সমসাময়িক কালের পরিব্যাপ্ত হতাশা, দ্রোহ, ঘৃণা, বিবমিষা, প্রেম ইত্যাদি তার কবিসত্তার প্রধান নিয়ামক। তাঁর কাব্যগ্রন্থসমূহ হচ্ছে- অলৌকিক ইস্টিমার (১৯৭৩), জ্বলো চিতাবাঘ (১৯৮০), সবকিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে (১৯৮৫), যতোই গভীরে যাই মধু, যতোই ওপরে যাই নীল (১৯৮৭), আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে (১৯৯০), কাফনে মোড়া অশ্রুবিন্দু (১৯৯৮), পেরোনোর কিছু নেই (২০০৪)। হুমায়ুন আজাদের মৃত্যুর পর কাব্যসমগ্র প্রকাশিত হয়। হুমায়ুন আজাদ কবিতার গঠনরূপ সম্পর্কে লিখেছেন, ‘যা পুরোপুরি বুঝে উঠবো না, বুকে ওষ্ঠে হৃদপিণ্ডে রক্তে মেধায় সম্পূর্ণ পাবো না; আমি অনুপস্থিত হয়ে যাওয়ার পরও রহস্য রয়ে যাবে রক্তের কাছে, তাঁর নাম কবিতা; যদিও আমি কবিতা লিখেছি, লিখেছি তাঁর ভাষ্য, এবং আজো গদ্যের এ-পরাক্রান্ত কালে, কবিতা লিখতে চাই।’

‘ভালো থেকো ফুল, মিষ্টি বকুল, ভালো/থেকো।/ভালো থেকো ধান, ভাটিয়ালি গান, ভালো/থেকো।’ (ভালো থেকো)। ছোট ছোট চিত্রকে শিল্পরূপ দিতে পারঙ্গম হুমায়ুন আজাদ। উল্লেখিত কবিতাংশটিই তার প্রমাণ। ছোট ছোট চিত্রময়তা সৃষ্টি করে কবিতায় গতিময়তা দিয়েছেন। শৈশবের স্মৃতিময় জিনিসগুলো ব্যবহার করেই কবিতাটি নির্মাণ করেছেন তিনি। আবহমান সবুজ বাংলার বিভিন্ন উপাদান ব্যবহারের পাশাপাশি বাঙালি সমাজ-সংস্কৃতির বিভিন্ন চিরায়ত ঐতিহ্য ও ইতিহাস আশ্রয় করেও শব্দাবলী গ্রহণ করা হয়েছে। যুতসই ব্যবহারে দক্ষতা দেখিয়েছেন তিনি। এখানেই কবি হিসেবে হুমায়ুন আজাদের বিশাল সার্থকতা।

Advertisement

ভালো কবিরা সময় ও ইতিহাসকে এড়িয়ে চলতে পারেন না। এড়িয়ে চললে পরবর্তীতে পাঠকরা তাঁকে বর্জন করেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে গ্রহণই করেন না। কবি হুমায়ুন আজাদ যথেষ্ট জ্ঞানী। ইতিহাস-ঐতিহ্য জ্ঞান তাঁর অগাধ। বিজ্ঞানের বিভিন্ন টার্ম তাঁর মাথায় ছিল। ইতিহাস-ভূগোল-বিজ্ঞান মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে কবিতায়। এসবের প্রভাব পড়েছে বিভিন্ন কবিতায়। ‘...তুমি কি জানো না গাঁধারা কখনো/অগ্নিগিরিতে চড়ে না/তোমার কানের লতিতে কতটা বিদ্যুৎ আছে/তা কি তুমি জানতে? আমিই তো প্রথম/জানিয়েছিলাম...’ (আমাকে ছেড়ে যাবার পর)। প্রকৃত বিষয় অনুধাবন করা কঠিন। তাই তো হুমায়ুন আজাদ বলেছেন, তিনি উচ্চশ্রেণির পাঠকদের জন্য লেখেন। টিনএজার পাঠকের বোধগম্য করা তাঁর লেখার উদ্দেশ্য নয়। কারণ এসব বিভিন্ন টার্ম নিয়ে জানতে হলে স্বশিক্ষিত হতে হবে। আধুনিক সময় হতাশার। নাগরিক জীবন হতাশায় পরিপূর্ণ। কিন্তু কারও জন্য সময় থেমে থাকে না। থেমে থাকলে পিছিয়ে পড়তে হয়। অনাধুনিক হতে হয়। এসবও কিন্তু এড়িয়ে যায়নি হুমায়ুন আজাদের কবিতা। ‘তুমি চলে গেছো, ভালো নেই।/তাই বলে গালে খোঁচাখোঁচা দাড়ি নেই/তাই বলে গায়ে ছেঁড়াফাড়া জামা নেই/তাই বলে জেগে জেগে কাটাই না রাত/তাই বলে একলা ঘুরি না বনে বনে।’ (ভালো নেই)। ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি সর্বত্রই বিরাজমান। ধর্মের অপব্যবহারে অনেক সময় মানবতা ও মৌলিক অধিকারসমূহ বাধাগ্রস্ত হয়। ধর্মান্ধ সমাজকে পাপি করে তোলে। কবি হুমায়ুন আজাদও সেটাই মনে করেন এভাবে, ‘ছেলেবেলায় আমি যেখানে খেলতাম/তিরিশ বছর পর গিয়ে দেখি সেখানে একটি/মসজিদ উঠেছে।/আমি জানতে চাই ছেলেরা এখন খেলে/কোথায়?’ (প্রার্থনালয়, কাফনে মোড়া অশ্রুবিন্দু)

চড়াই-উৎরাই পেরিয়েই জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হয়। ভয় পেলে জীবন পিছিয়ে যায়। বিভিন্ন সমস্যাবলী ও বাধাসমূহ উপভোগ করতে পারলেই সফলকাম হওয়া সম্ভব। কবি হুমায়ুন আজাদ বিভিন্ন প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও ‘পাহাড়ের মতো অটল, পর্বতের মতো অবিচল’ হয়েই জীবন উপভোগ করতে প্রস্তুত: ‘...মেঘ হয়ে কতো দিন উড়ে গেছি আড়িয়ল/বিলের ওপর দিয়ে,/গলগলে গজল হয়ে কতো রাতে ঝরেছি টিনের/চালে,/নৌকো হয়ে ভেসে গেছি থইথই ঢেউয়ের/ওপর।’ (পর্বত)

‘সেই কবে থেকে’ কবিতায় কবি হুমায়ুন আজাদ বলেন, ‘সেই কবে থেকে জ্বলছি/জ্বলে জ্বলে নিভে গেছি বলে/তুমি দেখতে পাওনি।’ অতৃপ্তি ও হতাশার কথা ফুটে উঠেছে। এতটুকু কবিতাংশ পড়েই বোঝা যায় যে, হুমায়ুন আজাদ কবিতাগুলো হেলাফেলায় লেখেননি। উপমা-উৎপ্রেক্ষা ব্যবহারে দারুণ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। এখনকার কবিতা মানেই যে চিত্রকল্প। চিত্রকল্প নির্মাণেও তিনি সিদ্ধহস্ত। ‘তুমি জানো না, কোনোদিন জানবে না,/কেমন লাগে একটি নড়োবড়ো বাঁশের পুলের/ওপর দাঁড়িয়ে কালো জলের দিকে তাকিয়ে/ থাকতে।’ (ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না)

সাম্রাজ্যবাদে বা আজকের দিনে অপরাধীদের শেষ আশ্রয়স্থল বলা হয় রাজনীতিকে। পরিবার ও সমাজ জীবনে মায়েদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। সন্তানদের আগলে রাখেন পরম মমতা দিয়েই। অনেক সময় পরিবার প্রধান বাবারা সন্তানদের বকাঝকা করেন। স্ত্রীদের অবমূল্যায়ন ও নির্যাতন করেন। পুরুষতান্ত্রিক এ যুগে এটা সাধারণ একটি বিষয় হয়ে গেছে। এর মধ্যেও সন্তানদের মায়েরা আগলে রাখেন। এসব সামাজিক চিত্র পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ ভাবে তুলে ধরা হয়েছে ‘আমাদের মা’ কবিতায়।

Advertisement

প্রেম ও সৌন্দর্যতত্ত্ব, নান্দনিকতার ক্ষেত্রেও কবি হুমায়ুন আজাদ সফল। মানবিকতার পাশাপাশি তাঁর সৌন্দর্যবোধ যথেষ্ট প্রশংসারযোগ্য। ভিন্নস্বরে নান্দনিকতাকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছেন তিনি। সময় বড় একটি ফ্যাক্টর, বিশ্বাস-অবিশ্বাসের মধ্যে পার্থক্য নেই বললেই চলে। একটু এদিক-ওদিক হলেই হিসাবে বৈপরীত্য দেখা দেয়। ‘আমরা দুজন পাশাপাশি ব’সে করছি পান,/আমাদের হাত থরথর কাঁপে ব্যাকুল হাতে।/...আমি জানি তুমি বহুজনকেই দিয়েছো দেহ,/আমিও বেঁধেছি বহু পল্লরী আলিঙ্গনে।’ (একাদশ প্রেম’ই)। এভাবেই প্রেমিকার স্বরূপ নির্ধারণ করেছেন কবি হুমায়ুন আজাদ। ‘আমাকে ভালোবাসার পর’ কবিতাটিও এক্ষেত্রে আলোচনার দাবি রাখতে পারে।

এখনকার সময় কুটিল ও জটিল। বেঁচে থাকাটাই বিস্ময়। পদে পদে ভণ্ডামী ও কপটতা। এখানে কোনটা সাহসের কাজ আর কোনটা সাহসবিহীন কাজ তা শনাক্ত করা কঠিন। প্রতিটি ক্ষেত্রে সূক্ষ্ন হিসাব করতে হয়। ভগ্নাংশ হিসাবের গড়মিলে অনেক কিছুই ঘটে যাওয়া সম্ভব। যে ফলাফল প্রত্যাশিত নয় বা কল্পনা করাও হয় না, এমনও ঘটে যেতে পারে। মেরুকরণ করা এখনকার সমাজের প্রধান বৈশিষ্ট্য। এমন চিন্তার প্রয়োগ কবি আজাদের ‘সাহস’ কবিতায় দেখতে পাই।

বর্তমান সমাজ-কাঠামোয় প্রবল বিরোধিতা করতেন হুমায়ুন আজাদ। সমাজের বেশিরভাগ অংশই পচে গেছে বলতেন তিনি। ‘জলপাই রঙের অন্ধকার’ কবিতায় বললেন, ‘আমাদের যা কিছু ছিল ভাল, তার সবটায় প্রায়/নষ্টদের অধিকারে চলে গেছে, এখনো যে দু এক/ফোঁটা ভাল পড়ে আছে অগোচরে তাও/শিগগিরই তাদের কবলে পড়বে, নষ্ট হবে।’ এসব কী সুন্দর ও নিখুঁত বর্ণনা নয় কি! বর্তমান সমাজের অন্তর্নিহিত কিন্তু এসব প্রকাশ্য সমস্যাবলী নিয়েই কবিতা।

উপমা ও রস ব্যবহারে হুমায়ুন আজাদ সিদ্ধহস্ত। বরং সমসাময়িক কবিদের কাছে ঈর্ষার মতো। তাঁর কবিতায় উপমা, রস, ছন্দে জীবনের গভীর অনুভূতিমালা সৃষ্টি করতে সক্ষম। অনুভূতির সংবেদনশীলতা প্রকাশে তাঁর কবিতা হয়েছে আরও গতিশীল, বাঙ্ময়। সৌন্দর্যতত্ত্বও খুঁজে পেতে কষ্ট হবে না। আর মানবিকতাবোধ বিদ্যমান কবিতার পরতে পরতে। অসাম্প্রদায়িক বোধ তাঁর কবিতায় ফুটে ওঠে সব সময়। সমাজের আনাচে-কানাচের শব্দাবলী যুতসই ব্যবহারেও সজাগ ও যথেষ্ট পারঙ্গমতা দেখিয়েছেন। প্রথা থেকে বেরিয়ে উপমাগুলো দারুণভাবে উপস্থাপন করেছেন তিনি। এমন যুতসই ব্যবহার তাঁর আগে অনেক কবিই করতে সফল হননি।

লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক।

এসইউ/এএসএম