জাতীয়

কার্বন নিঃসরণ রোধে জি-২০ দেশগুলোর ‘মূল ভূমিকা’ চান প্রধানমন্ত্রী

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বব্যাপী কার্বন নিঃসরণ রোধে জি-২০ দেশগুলোকে ‘প্রধান ভূমিকা’ পালনের পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব থেকে বিশ্বকে বাঁচাতে প্যারিস চুক্তির ‘কঠোর বাস্তবায়নের’ আহ্বান জানিয়েছেন।

Advertisement

দুই দিনের ‘পররাষ্ট্র নীতি ভার্চুয়াল ক্লাইমেট সামিট’-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রচারিত তার পূর্বে ধারণকৃত বিবৃতিতে প্রধানমন্ত্রী করোনাভাইরাস থেকে মুক্তি পেতে বিশ্বের সব দেশের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার ওপরও জোর দেন।

তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন নির্দিষ্ট সীমানায় আবদ্ধ নয়। যদি একটি দেশ থেকে কার্বন নির্গত হয়, তাতে প্রতিটি দেশ প্রভাবিত হয়। সুতরাং প্রতিটি দেশকে তার (যথাযথ) ভূমিকা পালন করতে হবে। তবে ধনী দেশগুলো বিশেষ করে জি-২০ দেশগুলোকে বিশ্বব্যাপী (কার্বন) নিঃসরণ বন্ধে প্রধান ভূমিকা পালন করতে হবে।

শেখ হাসিনা অভিমত ব্যক্ত করেন, প্যারিস চুক্তির কঠোর বাস্তবায়নই বিশ্বব্যাপী কার্বন নির্গমন এবং এর ফলে বিশ্ব উষ্ণায়ন রোধের একমাত্র উপায়। তিনি বলেন, গ্রহটিকে বাঁচাতে পদক্ষেপ নেয়ার সময় আগামীকাল নয়, আজ।

Advertisement

প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিশ্বব্যাপী নিম্ন পর্যায়ের মাত্র ৩ দশমিক ৫ শতাংশ (কার্বন) নির্গমনের জন্য ১০০টি দেশ দায়ী এবং জি-২০ দেশগুলো ৮০ শতাংশের জন্য দায়ী।

প্যারিস চুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যাবর্তনের প্রশংসা করে শেখ হাসিনা বলেন, এটা ভালো খবর যে, যুক্তরাষ্ট্র প্যারিস চুক্তিতে ফিরে এসেছে। তিনি বলেন, আমরা মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সিদ্ধান্তের এবং গত সপ্তাহে জলবায়ু বিষয়ক নেতাদের শীর্ষ সম্মেলন করারও প্রশংসা করি।

প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন, প্যারিস চুক্তিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় অভিযোজন এবং প্রশমনের উদ্দেশ্যে প্রতি বছর ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের তহবিল গঠনের অঙ্গীকার করেছে।

চলমান করোনা মহামারি সম্পর্কে কথা বলতে গিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, কোভিড-১৯ মহামারির কারণে সারাবিশ্ব কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। মারাত্মক এই ভাইরাস থেকে মুক্তি পেতে আমাদের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন।

Advertisement

করোনার পর সম্ভবত জলবায়ু পরিবর্তন সবচেয়ে আলোচিত বিষয় উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিষয়টি এখন প্রতিটি দেশের জন্য বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো জলবায়ু দুর্বল দেশগুলোর জন্য একটি বিশাল হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

শেখ হাসিনা বলেন, বিশ্বব্যাপী তাপমাত্রা বাড়ছে এবং এতে কোনো সন্দেহ নেই। এই তাপমাত্রা বৃদ্ধি সমস্ত অসুস্থতার জন্য প্রধানত দায়ী। বিশ্বব্যাপী তাপমাত্রার ক্রমাগত বৃদ্ধি মানব জাতির জন্য সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয়।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বিশ্বব্যাপী তাপমাত্রা ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে উঠতে না দিতে সম্মত হয়েছে। কিন্তু তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্য দায়ী গ্রিন হাউস গ্যাসের নির্গমন রোধে এখন পর্যন্ত যথেষ্ট উদ্যোগ নেয়া হয়নি।

তিনি বলেন, বাংলাদেশের মতো দেশগুলো প্রতিনিয়ত বন্যা, খরা, জলোচ্ছ্বাস, বজ্রপাত ইত্যাদির মতো বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের অভিজ্ঞতা অর্জন করে আসছে। বর্তমানে আমার দেশে তাপপ্রবাহ চলছে।

গত বছর বাংলাদেশে ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে দেশটির এক-তৃতীয়াংশ এলাকা পানিতে নিমজ্জিত হয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাংলাদেশে গত বছর ভারী বৃষ্টিপাত ছাড়াও সুপার সাইক্লোন আমফানসহ বেশ কয়েকটি সাইক্লোন আঘাত হানে এবং এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলেই ঘটেছে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ কার্বন নিঃসরণকারী দেশ নয় এবং বাস্তবিক অর্থে শুধু বাংলাদেশই নয় বরং ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের (সিভিএফ) কোনো সদস্য রাষ্ট্রই উল্লেখযোগ্য কার্বন নিঃসরণকারী নয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমরাই জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। প্রতি বছর জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে আমার দেশের ২ শতাংশ জিডিপির ক্ষতি হচ্ছে।

রোহিঙ্গা ইস্যুতে শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ মানবিক বিবেচনায় ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছে। জোরপূর্বক-বাস্তুচ্যূত এসব মিয়ানমারের নাগরিকদের পরিবেশগত-সংকটপূর্ণ কক্সবাজারে আশ্রয় দেয়া হয়েছে। কিন্তু তাদেরকে আশ্রয় দেয়ায় ওই এলাকার পরিবেশ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

সিভিএফ জলবায়ু অভিযোজনের সম্মুখভাগে রয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, স্বল্পোন্নত দেশগুলোর (এলডিসি) মধ্যে বাংলাদেশই প্রথম একটি ক্লাইমেট চেঞ্জ ট্রাস্ট ফান্ড গঠন করেছে। ৮০০ এর বেশি অভিযোজন ও প্রশমন কর্মসূচি বাস্তবায়নে আমরা এখন পর্যন্ত আমাদের নিজস্ব সম্পদ থেকে ৪১৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি অর্থ ব্যয় করেছি।

শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ চলমান জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণতাকে ২০১৯ সালে একটি বৈশ্বিক জরুরি পরিস্থিতি ঘোষণা করেছে। আমরা দেশব্যাপী ৩০ মিলিয়ন বৃক্ষরোপণের পরিকল্পনা করেছি এবং কম কার্বনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে ‘মুজিব ক্লাইমেট প্রোসপারিটি প্ল্যান’ প্রণয়নের পরিকল্পনা গ্রহণ করছি।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রতি বছর আমরা আমাদের জিডিপির প্রায় ২.৫ শতাংশ বা প্রায় ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগ মোকাবিলায় টেকসই জলবায়ু সহনশীল ব্যবস্থা গড়ে তুলতে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণে ব্যয় করি। আমরা উপকূলীয় এলাকায় ১২ হাজার সাইক্লোন শেল্টার নির্মাণ করেছি এবং ২০০ হাজার হেক্টর ‘গ্রিন বেল্ট’ করেছি।

শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশি বিজ্ঞানীরা লবণাক্ততা ও বন্যা সহনশীল শস্য, বৃষ্টির পানির সংরক্ষণের জলাধার ও পুকুর-বালি-ফিল্টার উদ্ভাবন করেছেন। এছাড়াও তারা উপকূলীয় এলাকার মানুষের জন্য পানির ওপর ভাসমান কৃষি প্রযুক্তি ও ভ্রাম্যমাণ পানি শোধনাগার প্ল্যান্ট উদ্ভাবন করেছেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা উপকূলীয় জেলাগুলোর চরাঞ্চলে কৃত্রিম ম্যানগ্রোভ বন করছি। তার সরকার সাইক্লোন-প্রবণ এলাকাগুলোর দরিদ্রদের জন্য সাইক্লোন সহনশীল টেকসই বাড়ি-ঘর নির্মাণ করছে। পানি সংরক্ষণ ও জলাশয়গুলো নাব্যতা বাড়াতে আমরা সারাদেশে নদী ও খাল ড্রেজিং করছি।

ঢাকায় সাউথ এশিয়ান রিজিওনাল অফিস অব গ্লোবাল সেন্টার অন অ্যাডাপটেশন স্থাপনের কথা তুলে ধরে বাংলাদেশ প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই কেন্দ্রটি স্থানীয় উদ্ভাবিত অভিযোজন প্রচারণায় কাজ করে যাচ্ছে।

এসইউজে/এআরএ