দেশজুড়ে

আজকের এই দিনে শত্রুমুক্ত হয় পঞ্চগড়

২৯ নভেম্বর। ১৯৭১ সালের আজকের দিনে শত্রুমুক্ত হয় পঞ্চগড়। দেশের দামাল ছেলেরা পাক হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে উত্তর প্রান্তের সীমান্ত জেলা পঞ্চগড়ে উড়ানো হয় স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। মহান মুক্তিযুদ্ধে অন্য এলাকার মতো কৃষক-শ্রমিক ও ছাত্র জনতা মিলিত হয়ে মুক্তিবাহিনী গড়ে তোলে। পাক হানাদার বাহিনী সড়কপথে ১৭ এপ্রিল সকালে পঞ্চগড় দখল করে নেয়। দিনটি যথাযোগ্য মর্যাদায় পালনে পঞ্চগড় জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড বদ্ধভূমিতে শ্রদ্ধাঞ্জলি, শোভাযাত্রা, আলোচনা সভাসহ নানা কর্মসূচি পালন করা হয়েছে।জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে ইতিহাসের বৃহত্তম গণহত্যা শুরুর পর অন্য এলাকার মতো এখানেও সাবেক পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সদস্যসহ সর্বস্তরের মানুষ মিলিত হয়ে মুক্তিবাহিনী গড়ে তোলেন।পঞ্চগড়ে মূলত যুদ্ধ শুরু হয় ১৭ এপ্রিল থেকে। ওই দিন সকালে পাকবাহিনী পঞ্চগড় দখল করে নেয়। হানাদার বাহিনীর আক্রমণে টিকতে না পেরে মুক্তিযোদ্ধারা পিছিয়ে যায়। যুদ্ধ চলতে থাকে পঞ্চগড় সদর উপজেলার তালমা, জগদলহাট, অমরখানা, শিংপাড়া, চৈতন্যপাড়া, বানিয়াপাড়া, মধুপাড়া, নিমাইপাড়া, থুকরিপাড়া, সোনারবান তালমা, ফকিরেরহাট, সিএন্ডবি মোড়, মীরগড়, গড়েরডাঙ্গা, টাঙ্গালী ব্রিজ, পানিমাছপুকুরী, বোদা উপজেলার মারেয়া, নয়াদিঘী, মানিকপীর, পেয়াদাপাড়া, কালিয়াগঞ্জ, সাকোয়া, ময়দানদীঘি, তেঁতুলিয়া উপজেলার ভজনপুর, জমাদারপাড়া, টোকাপাড়া, চেকরমারী, প্রধানপাড়া, ফকিরপাড়া, সাহেবীজোত, শিথলীজোত এবং আটোয়ারী উপজেলার মির্জাপুর, ধামোর, আটোয়ারী সদর, পাটশিরীহাট, ঝলঝলি, ছেপড়াঝাড়, ডুংডুঙ্গিরহাট, গোয়ালপাড়া, পুরানাদিঘী, তড়েয়া ও ডাঙ্গীরহাট এলাকায়। পাক হানাদার বাহিনী স্থানীয় দালাল, রাজাকার, আলবদর ও আলসামস বাহিনীর সহায়তায় গোটা এলাকায় হত্যা, নির্যাতন, অগ্নিকাণ্ডসহ লুটতরাজ চলতে থাকে। পঞ্চগড় দখল করে পাকবাহিনী পঞ্চগড় সদর, তালমা, গলেহা, মির্জাপুর, আটোয়ারী সদর, বোদা, ময়দানদীঘি, নয়াদিঘী, সাকোয়া, জগদল, অমরখানাসহ বেশ কয়েকটি স্থানে ক্যাম্প স্থাপন করে।কৌশলগত কারণে মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের যোদ্ধারা আশ্রয় নেয় তেঁতুলিয়া উপজেলার মাগুরমারীতে। তারা ভজনপুর এলাকার চাওয়াই নদীর ব্রিজ ডিনামাইড দিয়ে ভেঙে দেয়। এ কারণে আক্রমণকারী পাকহানাদার বাহিনী শেষ স্থান হিসেবে অবস্থান নেয় অমরখানায়। মুক্তিযোদ্ধারা তেঁতুলিয়ার চাউলহাটি, কোটগছ, থুকরাবাড়ি, ভজনপুর, মাগুরমারী, ময়নাগুড়ি, দেবনগর, ব্রাম্মণপাড়ায় ক্যাম্প করে। তারা প্রত্যন্ত অঞ্চলে অসংখ্য হাইড আউটের মাধ্যমে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়তে থাকে।চাওয়াই নদীর ব্রিজ ডিনামাইড দিয়ে ভেঙে দেওয়ায় পাকসেনারা জেলার শেষ পর্যন্ত তেঁতুলিয়া উপজেলা সদরে প্রবেশ করতে পারেনি। এজন্য মুক্তিযুদ্ধের সময় তেঁতুলিয়া মুক্তাঞ্চল হিসেবে বিশ্বে পরিচিতি লাভ করে। স্বাধীন বাংলাদেশের সকল কর্মকাণ্ডের তীর্থ ভূমিতে পরিণত হয় এই তেঁতুলিয়া। পরবর্তীতে তেঁতুলিয়া থেকেই মুক্তিযোদ্ধাদের সার্বিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়। কিন্তু, সরকারিভাবে এই তেঁতুলিয়া এখনও মুক্তাঞ্চল হিসেবে স্বীকৃতি পায়নি।জানা গেছে, মহান মুক্তিযুদ্ধে পঞ্চগড় ছিল ৬ (ক) সেক্টরের আওতাধীন। এ অঞ্চলে মোট সাতটি কোম্পানির অধীনে ৪০টি মুক্তিযোদ্ধা ইউনিট পাকহানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। সেক্টর কমান্ডার মেজর আবুল বাশার, স্কোয়াড্রন লিডার সদরুদ্দিন, ক্যাপ্টেন নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন শাহরিয়ার, লে. মাসুদুর রহমান, লে. আব্দুল মতিন চৌধুরী, লে. মো. হাসান আলী (আইও), মেজর কাজিমউদ্দিন, সুবেদার ফজলু, সুবেদার খালেক, সুবেদার হাজী মুরাদ আলী, সুবেদার গোফরান, সুবেদার শফিউদ্দিন দেওয়ান, সুবেদার বদিউজ্জামান, সুবেদার আমজাদ আলী, সুবেদার আব্দুল হাফিজ, সুবেদার আবুল হাশেম, কমান্ডার মাহবুব আলম, আইয়ুব আলী, শহীদ আইয়ুব আলী মাস্টার, তরিকুল আলমসহ অন্যান্যদের নেতৃত্বে জেলার বিভিন্ন এলাকায় মুক্তিযোদ্ধারা সংগঠিত হতে থাকে। সুসংগঠিত হয়ে মুক্তিযোদ্ধারা ট্রেনিং নিয়ে পাকবাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসর দালাল শান্তি কমিটি এবং রাজাকার আলবদরদের ওপর গেরিলা ও সম্মুখ যুদ্ধ জোরদার করে।এদিকে নভেম্বররে শুরুর দিকে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে যোগ হয় ভারতীয় মিত্রবাহিনী। উভয় বাহিনীর যৌথ আক্রমণের তীব্রতায় পিছু হটতে বাধ্য হয় পাক বাহিনী। মুক্ত হতে থাকে নুতন নতুন এলাকা। যৌথ বাহিনী পর্যায়ক্রমে ২০ নভেম্বর অমরখানা, ২৫ নভেম্বর জগদলহাট, ২৬ নভেম্বর শিংপাড়া, ২৭ নভেম্বর তালমা, ২৮ নভেম্বর পঞ্চগড় সিও অফিস এবং একই দিনে আটোয়ারী ও মির্জাপুর মুক্ত করে। এরপর আরও কিছু এলাকা শত্রুমুক্ত করা হয়। অবশেষে ২৯ নভেম্বর পঞ্চগড় এলাকা শত্রুমুক্ত হয়। এদিন পঞ্চগড়ে সম্মিলিত মিত্রবাহিনীর আক্রমণে পাকবাহিনী টিকতে না পেরে ঠাকুরগাঁও ও দেবীগঞ্জ হয়ে সৈয়দপুরের দিকে পিছু হঠে। তবে যাওয়ার সময় পাক বাহিনী পঞ্চগড় শহরের বাজারসহ বিভিন্ন অবকাঠামো জ্বালিয়ে দেয়।জেলার প্রবীন মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পঞ্চগড়ের পাঁচ উপজেলা সম্পূর্ণভাবে শত্রুমুক্ত হয় আরও তিনদিন পর। ২৯ নভেম্বর পঞ্চগড় সদর উপজেলার বিভিন্ন এলাকা মুক্ত হয়। এরপর পাকবাহিনী শহরের দক্ষিণ-পূর্বে বোদা এবং দেবীগঞ্জ উপজেলার দিকে চলে যায়। দুই ডিসেম্বর তারা পঞ্চগড়ের সীমানা ছেড়ে যায়। কিন্তু ২৯ নভেম্বর পঞ্চগড়ের জেলা শহর দখলমুক্ত হয়। এজন্য দীর্ঘদিন থেকে জেলার মুক্তিযোদ্ধারা সম্মিলিতভাবে ২৯ নভেম্বর দিনটিকেই পঞ্চগড় মুক্ত দিবস হিসেবে পালন করে আসছে।পঞ্চগড় জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা মির্জা আবুল কালাম দুলাল বলেন, আমরা সকলেই ঐক্যবদ্ধভাবে ২৯ নভেম্বর দিনটিকেই পঞ্চগড় মুক্ত দিবস হিসেবে পালন করে আসছি। এজন্য আজকের এই দিনে আমরা মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ এবং আত্মত্যাগের জন্য শহীদদের আত্বার মাগফিরাত কামনায় দোয়া, বদ্ধভূমিতে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ, শহরে শোভাযাত্রা এবং আলোচনা সভাসহ নানান কর্মসূচি গ্রহণ করেছি।এমএএস/আরআইপি

Advertisement