করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ সামাল দিতে না পেরে মুখ থুবড়ে পড়েছে টাঙ্গাইলের তাঁতশিল্প। লকডাউন, একের পর এক বিধিনিষেধ! দীর্ঘস্থায়ী বন্যার পর পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির ফলে জেলার অন্যতম অর্থনৈতিক খাত হিসেবে পরিচিত ঐতিহ্যের ধারক তাঁতশিল্প এখন বেহাল দশায়।
Advertisement
জানা গেছে, তাঁতশিল্পের তৈরি ঐতিহ্যবাহী টাঙ্গাইল শাড়ি মূলত: বাংলা নববর্ষ, ঈদুল ফিতর, ঈদুল আজহা, দুর্গাপুজা ও বিয়ের উৎসব ইত্যাদি বিকিকিনির প্রধান উপলক্ষ হিসেবে পরিগণিত।
এছাড়া টাঙ্গাইলের তাঁতশিল্পের শাড়ি, লুঙ্গি, গামছা, চাঁদর ইত্যাদি সারা বছরই কমবেশি বিকিকিনি হয়ে থাকে। তাঁতশিল্পের পণ্যের অধিকাংশের পাইকারি ক্রেতারাই সড়ক পথে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে এসে কাপড়ের হাট থেকে কিনে নিয়ে বাজারজাত করে থাকে। জেলার করটিয়া, বাজিতপুর, পাথরাইল, বল্লা, রামপুর, জোকারচর হাট মূলত: কাপড়ের জন্য পরিচিত। তাঁত মালিক, শ্রমিক ও তাঁত বোর্ডের স্থানীয় বেসিক সেন্টারের কর্মকর্তারা জানান, করোনার প্রথম ঢেউয়ে গত বছরের ২৬ মার্চ থেকে তাঁত ফ্যাক্টরিগুলো বন্ধ রাখায় তাঁতে থাকা সুতার ভিম পোকার আক্রমণের শিকার হয়ে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এরপরই দীর্ঘস্থায়ী বন্যায় ফ্যাক্টরিতে পানি ঢুকে তাঁত ডুবে স্মরণকালের সবচেয়ে বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়।
তারপরও জমি-ভিটা বিক্রি করে, কেউ কেউ এনজিও ও ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে তাঁত ফ্যাক্টরি চালানোর উদ্যোগ নিয়েছিল। এরই মধ্যে সুতা, রঙ ও রাসায়নিক কেমিক্যালের দাম দুই দফায় বেড়ে নাগালের বাইরে চলে যায়। এতে প্রতিপিস শাড়ি তৈরিতে ১০০-১৩০ টাকা অতিরিক্ত ব্যয় বেড়েছে।
Advertisement
এরপর ফের করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলায় লকডাউনের ফলে ঘরে মজুদ করে রাখা তাঁতপণ্যগুলোও বাজারজাত করতে না পারায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কোনো রকম সরকারি সহায়তা না পাওয়ার ফলে এর প্রভাব পুরো তাঁতশিল্পের উপর পড়েছে।
টাঙ্গাইলের তাঁতশিল্পের সঙ্গে সরাসরি জড়িত তাঁত মালিক ও শ্রমিকরা জানায়, শাড়ি ব্যবসার জন্য পয়লা বৈশাখ, ঈদুল ফিতর, ঈদুল আজহা ও দুর্গাপুজা প্রধান মৌসুম। এ বছর পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে করোনার প্রথম ঢেউ ও বন্যার পর কোনো কোনো তাঁত ফ্যাক্টরি মালিক ঘরে মজুদ থাকা শাড়ি কম দামে পাইকারি বিক্রি করে এবং তাঁত (১০টির মধ্যে ২-৩টি) বিক্রির টাকায় শাড়ি তৈরি করেছেন।
অনেক তাঁতি গত বছরের পয়লা বৈশাখের উৎসবের জন্য যেসব শাড়ি তৈরি করেছিল অথচ করোনার কারণে বিক্রি হয়নি সেগুলো মজুদ করে রেখেছিল। এবারও সেগুলো বিক্রি হয়নি। ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার জন্য নতুন শাড়ি বানানো বা চাহিদা নিরূপণ করা হয়নি। ঈদুল ফিতরে সবচেয়ে দামি শাড়ি তৈরি ও বেশি শাড়ি বিক্রি হয়।
তারা জানান, গত বছর বৈশাখে শাড়ি তৈরিতে ১০৭ কোটি ১৩ লাখ ৬০ হাজার টাকার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল। শাড়ি বিক্রি না হওয়ায় সেগুলো মজুদ রয়েছে। এ বছর ১১০ কোটি টাকার শাড়ি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হলেও বৈশ্বিক করোনা পরিস্থিতির কারণে তা পূরণ হয়নি। বাতাঁবো সূত্রে জানা গেছে, টাঙ্গাইলের ঐতিহ্যবাহী তাঁতশিল্পের উন্নয়ন ও প্রসারের জন্য জেলার কালিহাতীর বল্লায় (ঘাটাইল, মধুপুর, ধনবাড়ী, গোপালপুর, কালিহাতী ও ভূঞাপুর উপজেলার জন্য একটি এবং সদর উপজেলার বাজিতপুরে দেলদুয়ার, বাসাইল, মির্জাপুর, নাগরপুর, সখীপুর ও সদর উপজেলার জন্য একটি) বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের দুইটি বেসিক সেন্টার রয়েছে।
Advertisement
বাতাঁবো’র বাজিতপুর ও বল্লা এ দুইটি বেসিক সেন্টারের নিয়ন্ত্রণে ৪৯টি প্রাথমিক তাঁতি সমিতি এবং ৪টি মাধ্যমিক তাঁতি সমিতি রয়েছে। এসব সমিতির চার হাজার ৩৯১টি তাঁত ফ্যাক্টরি মালিকের ২৭ হাজার ৯৩১টি তাঁত চালু বা সচল এবং দুই হাজার ৬৭৩টি তাঁত আগে থেকেই বন্ধ বা অচালু রয়েছে।
করোনাভাইরাসের প্রথম ঢেউয়ে গত বছরের ২৬ মার্চ থেকে সরকারি নির্দেশনায় কল-কারখানা-ফ্যাক্টরি বন্ধ ঘোষণা করায় চালু তাঁত ফ্যাক্টরিগুলোও বন্ধ হয়ে যায়। ফলে জেলার তাঁতশিল্পে প্রতিদিন গড়ে এক কোটি ৮৭ লাখ ৫৬ হাজার ৪০০টাকা ক্ষয়-ক্ষতির শিকার হয়।
সে সময় করোনা মহামারির সঙ্গে বন্যার করাল থাবা জেলার তাঁতশিল্পকে আরও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করে। করোনায় বন্ধ হয়ে যাওয়া ফ্যাক্টরিতে তাঁত মালিকদের বিনিয়োগ বিনষ্ট হচ্ছিল। এর সঙ্গে বন্যার পানি এসে ফ্যাক্টরিতে চালু তাঁত, তাঁতে থাকা সুতার ভিম, কাপড় ও সরঞ্জামাদি প্রায় সবই নষ্ট হয়ে যায়।
এরপরও তাঁতশিল্প খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছিল। এরই মধ্যে সুতা, রঙ, রাসায়নিক কেমিক্যাল ও তাঁতের অন্যান্য সরঞ্জামাদির দামও বেড়ে যায়। করোনা মহামারির দ্বিতীয় ঢেউ এসে সেখানেও কঠোর ধাক্কা দিচ্ছে। ফলে ‘নদী চর খাল বিল গজারির বন, টাঙ্গাইল শাড়ি তার গরবের ধন’ প্রবাদটি টাঙ্গাইলের পরিচিতির সঙ্গে আর প্রযোজ্য না হওয়ারও আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
আসন্ন ঈদুল ফিতরে শাড়ি উৎপাদনে কোনো লক্ষ্যমাত্রাই নির্ধারণ করা হয়নি। একই অবস্থা ছিল গত ঈদুল আজহায়। আগামি দুর্গাপুজায়ও একই অবস্থা বিরাজ করার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই করোনা পরিস্থিতি না দেখে তাঁত মালিকরা আগাম কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না।
ফলে ছোট তাঁত মালিকদের কেউ কেউ পৈত্রিক পেশা ছেড়ে ভিন্ন পেশায় গিয়েও তেমন সুবিধা করতে না পেরে পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়ছে। ফলে টাঙ্গাইলের ঐতিহ্যবাহী তাঁতশিল্পই মুখ থুবড়ে পড়েছে। এ শিল্পের তাঁতিরা স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় লাভ-লোকসান তো পরের হিসাব এ শিল্পের অস্তিত্ব রক্ষা হবে কিনা তা নিয়েই শঙ্কিত।
টাঙ্গাইল শাড়ির রাজধানী হিসেবে পরিচিত পাথরাইলের শাড়ি প্রস্তুতকারক ও ব্যবসায়ী নীল কমল বসাক জানান, করোনার প্রথম ঢেউয়ের সঙ্গে বন্যা তাঁত শিল্পের ব্যাপক ক্ষতি করেছিল। কিন্তু করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে এ শিল্প টিকে থাকবে কিনা তা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে। ঐতিহ্যবাহী এ শিল্প এখন এক প্রকার মুখ থুবড়ে পড়েছে। এ শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে সরকারি প্রণোদনার পাশাপাশি তাঁত শাড়ির বাজার তৈরিতেও সরকারের ভূমিকা প্রত্যাশা করেন তিনি।
টাঙ্গাইল জেলা তাঁতিলীগের সহ-সভাপতি কাঁলাচাঁদ বসাক জানান, করোনা মহামারির দ্বিতীয় ঢেউয়ে ঐতিহ্যবাহী টাঙ্গাইল শাড়ি পুরোপুরি মুখ থুবড়ে পড়েছে। করোনার প্রথম ঢেউ আর বন্যা মোকাবিলা করেও তাঁতিরা ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছিল।
কিন্তু হঠাৎই দুই দফায় সুতা, রঙ ও রাসায়নিক কেমিক্যালসের দাম অতিরিক্ত বৃদ্ধি পাওয়ায় শাড়ি তৈরিতে তার প্রভাব পড়তে থাকে। ফলে বেশি দামে বাজারে শাড়ি বিক্রি করা সম্ভব হয়নি। তিনি আরও জানান, করোনা পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এ শিল্প আদৌ থাকবে কি-না সে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। শর্তহীন সুদমুক্ত ঋণ ও সরকারি প্রণোদনা ছাড়া তাঁতিরা আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না বলেও জানান তিনি।
টাঙ্গাইল শাড়ি ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি ও যজ্ঞেশ্বর অ্যান্ড কোং এর মালিক রঘুনাথ বসাক জানান, করোনার প্রথম ঢেউয়ের সাথে বন্যা এবং প্রায় একই সঙ্গে করোনা মহামারির দ্বিতীয় ঢেউয়ের ভয়াবহ দুর্যোগে জেলার তাঁত শিল্পে স্থবিরতা নেমে এসেছে।
এ শিল্পের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত প্রায় দুই লাখ পরিবার কর্মহীন হয়ে পড়েছে। তাদের জীবন-জীবিকার উপর এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে।
টাঙ্গাইল সেন্ট্রাল কো-অপারেটিভ ওয়েল ফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের (অর্টিজেন্স) সভাপতি মো. মোফাখখারুল ইসলাম জানান, করোনা মহামারি জেলার তাঁতশিল্পকে অস্তিত্বের মহাসঙ্কটে ফেলেছে। তাঁত মালিক ও এর সাথে জড়িত প্রায় দুই লাখ মানুষ কর্মহীন অবস্থায় সামাজিক নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে।
যারা এক সময় দান-অনুদান দিয়েছেন, তারাও এখন নিজেদের পরিবারের মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে পারছেন না। করোনার প্রথম ঢেউয়ের সাথে গেল বন্যার সময় থেকে তাঁতিদের উৎপাদিত পণ্য ঘরে থেকে বিনষ্ট হচ্ছে, কোথাও বিক্রি হচ্ছে না। ফলে পুরো তাঁতশিল্পই মুখ থুবড়ে পড়েছে।
টাঙ্গাইল সদরের বাজিতপুর বেসিক সেন্টারের লিয়াজোঁ অফিসার মো. রবিউল ইসলাম জানান, করোনা মহামারি মোকাবিলা ও শাড়ি উৎপাদন এবং বাজারজাত করণ কিংবা নতুন বাজার সৃষ্টিতে তাঁতিদেরকেই এগিয়ে আসতে হবে।
তিনি জানান, মূলত: করোনা মহামারির শুরু থেকেই তাঁতশিল্প ক্ষতির মুখে পড়েছে। এর মধ্যে গেল বন্যায়ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তার উপর তাঁত সংশ্লিষ্ট দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি ও করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ তাঁতশিল্পকে ধসের মুখে ফেলেছে।
এমআরএম/জিকেএস