চলমান কোভিড প্যান্ডেমিকটি কবে শেষ হবে আর কোথায় গিয়েই বা দাঁড়াবে, তা নিয়ে আলোচনা-বিশ্লেষণ নিরন্তর। আর শেষ যেদিন হবে সেদিন কিভাবে হবে সেটি, তাই নিয়েও নানা মুনির নানা মত। যেটুকু নিশ্চিত তা হলো মাস্ক পরা, বারবার হাত ধোয়া আর অপ্রয়োজনে ঘরের বাইরে না যাওয়ার মতন স্বাস্থ্যবিধিগুলো মেনে চলার মধ্যে দিয়ে কোভিডকে হারানো না যাক, অন্তত এর রাশটা টেনে ধরা যায়। এর প্রমাণ এদেশেই আমরা দেখেছি একাধিকবার। দেখেছিলাম গত বছরের শেষে যখন কোভিডের নতুন রোগী শনাক্তের দৈনিক হারটা আমরা কয়েক সপ্তাহের জন্য নামিয়ে আনতে পেরেছিলাম ৫ শতাংশের নিচে আর দেখছি এই মুহূর্তেও যখন কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউটা বাংলাদেশে এখন নিন্মমুখী।
Advertisement
তবে কোভিডকে পাকাপাকিভাবে বিদায় করতে চাই ‘পালগত প্রতিরোধ’, অর্থাৎ হার্ড ইমিউনিটি। আর তা অর্জন করতে হলে ভ্যাকসিনের বিকল্প নেই। এরই মধ্যে এর কিছু কিছু উদাহরণও আমরা দেখতে শুরু করেছি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য আর ইসরাইলে। এদের মধ্যে ইসরাইল তার প্রায় শতভাগ জনগোষ্ঠিকে কোভিড ভ্যাকসিনের আওতায় নিয়ে এসেছে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র আর যুক্তরাজ্যে প্রায় অর্ধেক জনগোষ্ঠির টিকা নেয়া শেষ। এ তিনটি দেশে এরই মধ্যে কমতে শুরু করেছে কোভিড। সম্প্রতি যুক্তরাজ্যে এক গবেষণায় দেখা গেছে প্রথম যে তিন কোটি মানুষ সে দেশে কোভিডের প্রথম ডোজটি নিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে মাত্র ৬৮ জনকে ডোজটি নেয়ার পরও কোভিডে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছে, তবে তাদের কারোরই মৃত্যু হয়নি।
অন্যদিকে দ্বিতীয় ডোজ নেয়ার পরে সে দেশে কাউকে কোভিডে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে যেতে হয় হয়নি। একইভাবে দেশেও একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষনায় দেখা গেছে, এদেশে যারা কোভিডের টিকার প্রথম ডোজটি নিয়েছেন তাদের কেউ-কেউ কোভিডে আক্রান্ত হলেও তাদের মধ্যে ৮২ শতাংশ মানুষেরই হাসপাতালে যাওয়ার প্রয়োজন পরেনি। আর যে ১৭ শতাংশের মত মানুষকে টিকার প্রথম ডোজটি নেওয়ার পরও কোভিডে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে যেতে হয়েছে, তাদের প্রায় কারোরই তেমন কোন বড় কোন সমস্যা দেখা দেয়নি। কোভিডের টিকার প্রথম ডোজটি নেওয়ার পর কোভিডে আক্রান্ত হয়ে এদেশে মৃত্যু হয়েছে মাত্র একজন মানুষের। একসময় যে যুক্তরাষ্ট্র ছিল কোভিড মৃত্যুতে চ্যাম্পিয়ন, আজ তারাও সেই তালিকায় অনেক পেছনে ভ্যাকসিনের কল্যাণে।
কাজেই ভ্যাকসিন আমাদের লাগবেই। অথচ এমন একটা সময়ে এই লেখাটার অবতারণা যখন ভ্যাকসিন সংকটে চিন্তিত বাংলাদেশ। ভারত থেকে হঠাৎই বন্ধ হয়ে গেছে কোভিশিল্ডের সরবরাহ। এ নিয়ে চলছে নানা জল্পনা-কল্পনা। ব্যাপারটা কিন্তু প্রত্যাশিতই ছিল। কোভিডের দ্বিতীয় ওয়েভটি ভারতকে খুব জোর একটা ধাক্কা দিয়েছে। একেক দিনে সেদেশে তিন লাখেরও বেশি নতুন কোভিড রোগী শনাক্ত হচ্ছেন। এই পরিস্থিতিতে ভারত আমাদেরকে প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কোভিড ভ্যাকসিন দিতে পারবে এমনটা প্রত্যাশা করাটা কঠিন। এর আগেও আমরা দেখেছি ফাইজার আগাম টাকা নিয়েও সময়মত টিকা সরবরাহ করতে পারেনি কানাডাতে আর ইউরোপীয় ইউনিয়ন সেখানে উৎপাদিত টিকা রপ্তানির উপর জারি করেছে নিষেধাজ্ঞা। এমনকি কানাডার বিশ্বস্ততম মিত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও বিপদে তাদের পাশে দাঁড়ায়নি, বরং বলা উচিত দাঁড়াতে পারেনি, কারণ তারা নিজেরাই কোভিডের চাপে জর্জরিত ছিল। পাশাপাশি কোভিশিল্ডের সাথে এখন যোগ হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ফ্যাক্টরও। যুক্তরাষ্ট্র ভারতে কোভিশিল্ডের কাচামাল রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছে। এই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের ব্যাপারে ভারতে কোভিশিল্ড উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান পুনের সেরাম ইনস্টিটিউটের প্রধান নির্বাহী পুনেওয়ালা মার্কিন রাষ্ট্রপতি জো বাইডেনের হস্তক্ষেপও কামনা করেছেন, কিন্তু কোন সুরাহা হয়নি।
Advertisement
তবে ভুলে গেলে চলবে না, ভারত থেকে এ পর্যন্ত যে ছয় কোটি বাষট্টি লাখ ডোজ কোভিশিল্ড দেশের বাইরে গেছে তার মধ্যে সর্বোচ্চ এক কোটি তিন লাখ ডোজ এসেছে বাংলাদেশে। বাংলাদেশ আর মরক্কো পেয়েছে সর্বোচ্চ ৭০ লাখ ডোজের বাণিজ্যিক চালান। যুক্তরাজ্য পেয়েছে ৫০ লাখ, ব্রাজিল ৪০ লাখ আর দক্ষিণ আফ্রিকা আর নেপাল প্রত্যেকে ১০ লাখ করে। একইভাবে ভারতের উপহার হিসেবে সর্বোচ্চ ৩৩ লাখ ডোজ ভ্যাকসিনও পেয়েছে বাংলাদেশই। নিশ্চিত করেই বলা যায় কোভিডের দ্বিতীয় ধাক্কাটা এত জোরেশোরে না লাগলে আমাদের সাপ্লাই চেইনটি ঠিকই থাকতো। ভারতের কোভিডের দ্বিতীয় ওয়েভের ধাক্কায় যে ঝামেলায় শুধু আমরা তাই নয়, ঝামেলায় গোটা বিশ্বও। কারণ সেরাম ইনস্টিটিউট ভ্যাকসিন দিতে পারছে না কোভ্যাক্স কোয়ালিশনকেও। তবে ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার ভারত থেকে ফিরে এসে সম্প্রতি সংবাদকর্মীদের কাছে যে বক্তব্য রেখেছেন তাতে ধারণা করা যায় যে, ভারত সরকার অন্তত আমাদের কোভিশিল্ডের দ্বিতীয় ডোজের ঘাটতি পুষিয়ে দিবেন। মাননীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সাম্প্রতিক বক্তব্যেও তেমন ইঙ্গিতই আছে।
তবে এই সময়টায় এ নিয়ে কোন কোন দায়িত্বশীল ব্যক্তির মন্তব্য অতন্ত দুঃখজনক। একজন সাংসদ যখন এ নিয়ে কথা বলতে গিয়ে ভারত বাংলাদেশের সম্পর্ককে শুধু ব্যবসার মানদণ্ডে দাঁড় করান, তখন বুঝতে বাকি থাকে না যে তিনি সাংসদ হিসেবে নন, বরং নিজের ব্যবসার জায়গাটি থেকে দাঁড়িয়েই অমন বক্তব্য দিচ্ছেন। দায়িত্বশীল ব্যক্তির এমন মন্তব্যে সুযোগ নেয় সুযোগসন্ধানীরা। মাননীয় সাংসদের বক্তব্য দিতে দেরি হয়েছে, কিন্তু দেরি হয়নি বিরোধী দলের প্রতিক্রিয়া আসতে। বিএনপির একজন বড় নেতাতো বলেই বসেছেন, একজন ব্যবসায়িকে সুবিধা দিতে গিয়েই নাকি গোটা দেশকে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে ফেলা হয়েছে। কি অর্বাচীন বক্তব্য! অথচ অমন বক্তব্য দেয়ার সুযোগটা তাকে হাতে তুলে উপহার দেয়া হলো।
কিন্তু ঐ যে আমরা বারবার লেখায়-কথায় আর বলায় বলি যে, যখন ‘শেখ হাসিনার হাতে দেশ, তখন পথ হারাবে না বাংলাদেশ’ এ যাত্রায়ও তার লক্ষণগুলো স্পষ্ট। গত বছর যখন দুষ্টু লোকে বলতে শুরু করেছিল যে, ভ্যাকসিন পাবে না বাংলাদেশ, তখন বিশ্বের অধিকাংশ দেশের আগেই ভ্যাকসিন এনে দিয়ে দেশের মানুষকে বাঁচিয়েছিলেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। এবারও স্পষ্টতই তার নির্দেশনায় নড়েচড়ে বসেছে প্রশাসন। ভ্যাকসিনের মজুদ যখন ফুরিয়ে আসছিল তখন প্রথম ডোজের কার্যক্রম কি যুক্তিতে অব্যাহত রাখা হয়েছিল তা কখনোই বোধগম্য হয়নি। তবে অবশেষে ভ্যাকসিন কর্তাদের সুমতি হয়েছে। সাময়িকভাবে বন্ধ করা হয়েছে ভ্যাকসিনের প্রথম ডোজ দেয়া।
পাশাপাশি বিকল্প উৎস থেকে ভ্যাকসিন সংগ্রহের ব্যাপারেও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতির খবর পাওয়া যাচ্ছে। রাশিয়া ও চীন থেকে ভ্যাকসিন আনায় যথেষ্ট অগ্রগতির খবর এখন ইথারে-ইথারে। এই ভ্যাকসিনগুলো অনেক আগেই আনা হয়ত সম্ভব হতো, কিন্তু তখন যুক্তি দেয়া হয়েছিল বিধিবিধানগত বাধ্যবাধকতার। তবে সম্প্রতি দেশের মানুষের জন্য দেশের মানুষের তৈরি বিধিমালা সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সামনেই আমরা পেতে যাচ্ছি চীনের উপহার ৫ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন আর কোভ্যাক্স কোয়ালিশনের মাধ্যমে ঈদের আগেই আসতে যাচ্ছে ফাইজারের ১ লাখ ডোজ টিকাও। সরকারের সাথে দেশে স্পুটনিক-৫ উৎপাদনের ব্যাপারে রাশিয়ার সাথে স্বাক্ষরিত হয়েছে নন-ডিসক্লোজার এগ্রিমেন্ট যা মাননীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমাদের জানিয়েছেন। দায়িত্বশীল ব্যক্তিরাই জানাচ্ছেন দেশেই তৈরি হবে চীনা টিকাও।
Advertisement
অন্যদিকে পত্রিকা মারফত জানা যাচ্ছে ভারত সরকার চিঠি দিয়ে অনুরোধ করেছে দেশে ভারতীয় অর্থায়নে ভারতে উদ্ভাবিত কোভিড ভ্যাকসিন ‘কোভ্যাকসিনের’ ট্রায়ালের ব্যাপারে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে। এমনকি প্রস্তাবও দেয়া হয়েছে এই ভ্যাকসিনটি বাংলাদেশে যৌথভাবে উৎপাদনেরও। প্রকাশিত প্রাথমিক তথ্য-উপাত্ত অনুযায়ী ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর মেডিকেল রিসার্চ ও ভারত বায়োটেকের উদ্ভাবিত এই ভ্যাকসিনটি কোভিডের বিরুদ্ধে ৭২ শতাংশ কার্যকর। ভারতের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও নিজে এই ভ্যাকসিনটিই গ্রহণ করেছেন। একইভাবে যখন এই প্রবন্ধটি লিখছি তখন টেলিভিশনে স্ক্রলে দেখা যাচ্ছে যে দেশে উদ্ভাবিত কোভিড ভ্যাকসিন ক্যান্ডিডেট ‘বঙ্গভ্যাক্সের’ ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের ব্যাপারেও ইতিবাচক সিদ্ধান্ত আসতে পারে দ্রুতই।
সব মিলিয়ে বলা যায় কোভিড থেকে পাকাপাকি মুক্তির ‘হলি গ্রেইলটি’ বোধহয় আমরা অবশেষে দেখতে পাচ্ছি আর পরিস্থিতি এই মুহূর্তে যতই ঘোলাটে মনে হোক না কেন, সামনেই নতুন নতুন ভ্যাকসিন আমদানি আর দেশে স্থানীয়ভাবে ভ্যাকসিন উৎপাদনের মাধ্যমে আমরাও সেই ‘হলি গ্রেইলটি’ আমাদের হাতের মুঠোয় পেতে যাচ্ছি। তবে অন্যের উপর নির্ভরতা কমিয়ে আনাটাও জরুরি। কাজেই আমাদের বেসরকারিখাতে একদিকে যেমন ভ্যাকসিন তৈরির সক্ষমতা বাড়াতে হবে, তেমনি বাড়াতে হবে সরকারি সক্ষমতাও।
অনেকেই আজ জানেন না যে একসময়ে আমাদের সরকারের ইনন্সটিটিউট অব পাবলিক হেলথের তৈরির গুটি বসন্তের ভ্যাকসিন দিয়ে দেশ থেকেতো বটেই, এমনকি ভারত আর পাকিস্তান থেকেও গুটি বসন্ত নির্মূল করা হয়েছিল। সরকারের সক্ষমতার সেই হৃত গৌরবটিও পুনরুদ্ধার করতে হবে। আজ কোভিড এসেছে, গতকাল এসেছিল স্প্যানিশ ফ্লু, সামনেও অবশ্যই আসবে কিছু না কিছু। আর কোভিডও তো পিছু ছাড়ছে না এত সহজে। কাজেই উদ্যোগটা চাই এখন থেকেই। বাঙালির ভ্যাকসিনের জয়ধ্বনি আবারো ছাড়িয়ে যাক বাংলাদেশের সীমানা!
লেখক : চেয়ারম্যান, লিভার বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ও সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ।
এইচআর/জেআইএম