সবকিছু এলোমেলো করে দিচ্ছে মহামারি করোনাভাইরাস। জনজীবন থেকে ব্যবসা-বাণিজ্য সব খানেই পড়ছে এর থাবা। প্রযুক্তির যুগে সম্ভাবনাময় তথ্য-প্রযুক্তি বা আইটি খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোও রক্ষা পাচ্ছে না প্রাণঘাতী এই ভাইরাসের হাত থেকে।
Advertisement
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সরকার কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করায় এ খাতের সংকট আরো বেড়েছে। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে জরুরি সেবার আওতায় অভ্যন্তরীণ কার্যক্রম চালালেও অনেক আইটি কোম্পানি গ্রাহকের কাছ থেকে পাওনা টাকা আদায় করতে পারছে না।
করোনাভাইরাসের প্রকোপের নেতিবাচক চিত্র উঠে এসেছে কোম্পানিগুলোর মুনাফার চিত্রেও। পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত আইটি খাতের কোম্পানি রয়েছে ১১টি। এর মধ্যে চলমান হিসাব বছরের প্রথম ছয় মাসের (২০২০ সালের জুলাই থেকে ডিসেম্বর) ব্যবসায় আগের বছরের তুলনায় মুনাফা কমে গেছে ৫টির। একটির মুনাফা অপরিবর্তিত রয়েছে। আর ৫টির মুনাফা আগের বছরের তুলনায় কিছুটা বেড়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চলতি হিসাব বছরের প্রথম ছয় মাসে মুনাফা কমে যাওয়ার পেছনে বড় ভূমিকা রয়েছে করোনাভাইরাসের। করোনাভাইরাসের কারণে কোম্পানিগুলো সঠিকভাবে তাদের সব কাজ পরিচালনা করতে পারেনি। যদি করোনার প্রকোপ না থাকতো তাহলে কোম্পানিগুলো আরও ভালো মুনাফা করতে পারতো।
Advertisement
তারা আরও বলছেন, আইটি খাতের ব্যবসায় করোনার নেতিবাচক প্রভাব ইতোমধ্যে দৃশ্যমান। সামনে এ খাতের ওপর আরও নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। এখই কার্যক্রম চালালেও অনেক কোম্পানি গ্রাহকের কাছ থেকে পাওনা অর্থ আদায় করতে পারছে না। আবার কিছু আইটি কোম্পানি আছে, যারা এই পরিস্থিতিতে ব্যবসায়িক কার্যক্রমই চালাতে পারছে না। সার্বিকভাবে আইটি খাতের কোম্পানিগুলোও করোনার কারণে সংকটের মধ্যে রয়েছে।
এদিকে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর আর্থিক তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ২০২০ সালের জুলাই থেকে ডিসেম্বর সময়ের ব্যবসায় প্রতিটি কোম্পানি মুনাফায় রয়েছে। তবে ছয় মাসের ব্যবসায় মাত্র তিনটি কোম্পানি শেয়ারপ্রতি এক টাকার ওপরে মুনাফা করতে পেরেছে। শেয়ারপ্রতি এক টাকার ওপরে মুনাফা করা কোম্পানিগুলোর মধ্যে একটির মুনাফা গত বছরের তুলনায় কমে গেছে। বিপরীতে একটির মুনাফা বেড়েছে এবং একটির মুনাফা অপরিবর্তিত রয়েছে।
করোনা মহামারির মধ্যে মুনাফায় কোনো হেরফের না হওয়া আইটি কোম্পানিটি হলো জিনেক্স ইনফোসিস। আগের বছরের মতো চলতি হিসাব বছরের প্রথম ছয় মাসেও এই প্রতিষ্ঠানটি শেয়ারপ্রতি ১ টাকা ৯০ পয়সা মুনাফা করেছে। তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর মধ্যে এই প্রতিষ্ঠানটিই শেয়ারপ্রতি মুনাফার দিক থেকে সবার ওপরে রয়েছে।
চলতি হিসাব বছরের ছয় মাসের ব্যবসায় মুনাফায় প্রবৃদ্ধি হওয়া কোম্পানিগুলোর মধ্যে রয়েছে- এডিএন টেলিকম, অগ্নি সিস্টেমস, বিডি কম, আইটি কনসালটেন্টস এবং ইনটেক লিমিটেড।
Advertisement
এর মধ্যে সব থেকে বেশি মুনাফ করেছে এডিএন টেলিকম। প্রতিষ্ঠানটি চলতি হিসাব ছয় মাসের ব্যবসায় শেয়ারপ্রতি মুনাফা করেছে ১ টাকা ২০ পয়সা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৮৯ পয়সা। এর পরেই রয়েছে আইটি কনসালটেন্টস। এই প্রতিষ্ঠানটি চলতি হিসাব বছরের ছয় মাসে শেয়ারপ্রতি মুনাফা করেছে ৭৮ পয়সা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৬৯ পয়সা।
মুনাফায় প্রবৃদ্ধি হওয়া বাকি তিন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে অগ্নি সিস্টেমস চলতি হিসাব বছরের প্রথম ছয় মাসে শেয়ারপ্রতি মুনাফা করেছে ৪৮ পয়সা, যা আগের বছরের এই সময়ে ছিল ৪৪ পয়সা। বিডি কমের শেয়ারপ্রতি মুনাফা ৩৮ পয়সা থেকে বেড়ে হয়েছে ৪৩ পয়সা। আর ইনটেকের শেয়ারপ্রতি মুনাফা হয়েছে ১৮ পয়সা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ১২ পয়সা।
অপরদিকে মুনাফায় সব থেকে বেশি নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে ইনফরমেশন সার্ভিসেস’র। প্রতিষ্ঠানটি চলতি হিসাব বছরের প্রথম ছয় মাসে শেয়ারপ্রতি মুনাফা করেছে মাত্র ২ পয়সা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ২৩ পয়সা। অর্থাৎ কোম্পানিটির মুনাফা কমে ১১ ভাগের একভাগের নিচে নেমে গেছে।
মুনাফায় বড় নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে ভালো ব্যবসা করা ড্যাফোডিল কম্পিউটারেরও। প্রতিষ্ঠানটির মুনাফা কমে গত বছরের অর্ধেকের নিচে নেমে গেছে। চলতি হিসাব বছরের প্রথম ছয় মাসের ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানটি শেয়ারপ্রতি মুনাফা করেছে ৩৪ পয়সা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৮০ পয়সা।
মুনাফা কমে যাওয়া অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ই-জেনারেশনের শেয়ারপ্রতি মুনাফা ১ টাকা ৮ পয়সা থেকে কমে ৮১ পয়সায় দাঁড়িয়েছে। আমরা টেকনোলজি শেয়ারপ্রতি মুনাফা করেছে ৭১ পয়সা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ১ টাকা। একই গ্রুপের আর এক প্রতিষ্ঠান আমরা নেটওয়ার্ক শেয়ারপ্রতি মুনাফা করেছে ১ টাকা ১৫ পয়সা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ১ টাকা ৬৯ পয়সা।
অগ্নি সিস্টেমস’র কোম্পানি সচিব মোহাম্মদ শরিফুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, করোনার কারণে আমরা বড় ধরনের সমস্যার মধ্যে আছি। আমাদের বড় কাস্টমার (গ্রাহক) গার্মেন্টস। এই পরিস্থিতি আমাদের অভ্যন্তরীণ অফিসিয়াল কার্যক্রম চলছে। গ্রাহককেও আমরা সেবা দিচ্ছি। কিন্তু গ্রাহকের কাছ থেকে পাওনা আদায় করার ক্ষেত্রে বড় সমস্যা হয়ে যাচ্ছে। আমরা ঠিকমতো অর্থ আদায় করতে পারছি না।
তিনি বলেন, চলতি হিসাব বছরের ব্যবসায় আমাদের মুনাফায় প্রবৃদ্ধি হয়েছে। মহামারি করোনাভাইরাস না থাকলে এই মুনাফার প্রবৃদ্ধি আরও বেশি হতো। নানা সমস্যার মধ্যে আমরা ব্যবসা টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছি।
তিনি আরও বলেন, বাইরে থেকে মানুষ মনে করে আইটি কোম্পানিগুলো প্রচুর মুনাফা করছে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। ব্যবসা পরিচালনার ক্ষেত্রে আইটি কোম্পানিগুলোকে নানা প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। করোনা মহামারি সমস্যা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
ড্যাফোডিল কম্পিউটারে কোম্পানি সচিব মো. মনির হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, আইটি কোম্পানিগুলো সবাই একই ধরনের ব্যবসা করে না। করোনাভাইরাসের বর্তমান পরিস্থিতিতে এক এক আইটি কোম্পানি এক এক ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে। আমরা সফটওয়্যার সরবরাহ করি। বর্তমানে আমাদের ব্যবস্থা বন্ধ।
করোনার কারণে আপনাদের ব্যবসায় কী ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে এবং আপনারা কী পরিমাণ গ্রাহক হারিয়েছেন? এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, করোনার কারণে ব্যবসায় নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। যে কারণে আমাদের মুনাফা কমে গেছে। তবে আমরা কী পরিমাণ গ্রাহক হারিয়েছি, এটা এখন বলা সম্ভব না।
আমরা টেকনোলজি এবং আমরা নেটওয়ার্ক’র কোম্পানি সচিব সৈয়দ মনিরুজ্জামান জাগো নিউজকে বলেন, করোনাভাইরাস অবশ্যই আমাদের ব্যবসায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। আমাদের অফিসিয়াল কর্যক্রম চললেও গ্রাহকের কাছ থেকে ঠিকমতো অর্থ আদায় করতে পারছি না। তবে সার্বিকভাবে আমরা কী ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছি তা এই মুহূর্তে বলা সম্ভব না।
এমএএস/এসএইচএস/এমএস