মতামত

জানি আপনি কে!

 

আমাদের সঙ্গে যে অণুজীবটি এক সঙ্গে একই দেহে বাস করতে আসে, তার চরিত্রে বড় রকমের এক দুষ্টুমি আছে। ষড়যন্ত্রও আছে বলা যায়। অণুজীব আমাদের স্মৃতি বিভ্রাট ঘটায়। অনেক আগের স্মৃতি যেমন মুছে দেয়। তেমনি এই মূহুর্তেও আমাকে ভুলভুলিয়ার মধ্যে ফেলে দিতে পারে। ভুলে যেতে পারি আমি কে, কি করছিলাম, কাকে চাইছিলাম ফোনে?

Advertisement

ফোন হাতে নিয়েও তার নামটি হয়তো আর মনে করতে পারছি না। আমার ডাকে যে এসে পাশে দাঁড়াল, তাকেই কি একটু আগে আমি চাইছিলাম? আমি, আমরা হয়তো ভুলে যাই আমাকেই। তবে এই রোগটি আমাদের পুরেনো নয়। বাঙালির সঙ্গে বা মস্তিষ্কে এই রোগ হয়তো জন্মসূত্রেই একত্রে বসবাস করে যাচ্ছে। কারণ আমরা প্রায়শ: নিজেদের ভুলে যাই। তাই অন্যের কাছে জানতে চাই জানো আমি কে?

গণমাধ্যমে একটি চা পাতার একটি বিজ্ঞাপন বাঙালির এই অসুখটিকে উপজীব্য করেই তৈরি হয়েছে। দেখা যায় একজন যাত্রী নিজেকে যতো উচ্চতায় ভাবছেন, বিমান সংস্থার কর্মী তাকে সেভাবে দেখছেন না। সকল যাত্রীর মতোই তার সেবা দিচ্ছেন। ব্যাপারটি ঐ যাত্রীর মনঃপুত হলো না বলে চিৎকার করে বিমান সংস্থার কর্মীর কাছে ধমকের সুরে জানতে চাইলেন জানো আমি কে?

এই কাজটি আমরা সকলেই করে যাচ্ছি। সকলেই আমরা নিজেকে পরিবারে, সমাজে, রাষ্ট্রে অতি গুরুত্বপূর্ণ মনে করছি। কোনভাবেই সাধারণ থাকতে চাইছি না। রিকশা, অটোরিকশা, উবার, ট্রেন, বাস,রেস্টুরেন্ট, সিনেমা হল, মার্কেট, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, গণমাধ্যম, প্রার্থনাকেন্দ্র, ব্যাংক, হাসপাতাল, আদালত, সরকারি কোন সেবা সংস্থা এমনকি ফুটপাতে, পথে সারাক্ষণ নিজেকে বিশেষ ভাবতে ভালোবাসি। সারাক্ষণ অন্যের কাছে আমার উপস্থাপিত শারীরিক ভাষা হচ্ছে– জানো আমি কে?

Advertisement

যিনি সেবা নিতে চান তিনি যেমন এই মানসিক রোগে আক্রান্ত, তেমনি যিনি দেবেন তিনিও একই অহং রোগে আক্রান্ত। আমাদের পারিবারিক বচসা এবং বিচ্ছিন্নতার বড় কারণ অহং। ভাইবোন, বাবা-মায়ের সঙ্গে সন্তানদের, অন্যান্য পরিজন , প্রতিবেশিদের মধ্যকার সম্পর্কের টানাপোড়েন এবং স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক ছিন্ন হবার কারণ হয়ে দাঁড়ায়- সকলে এক কাতারে এসে দাঁড়াতে না পারা। কেউ বিনয়ী বা সাধারণ হতে রাজি নন। তখনই আর সেখানে মীমাংসা ফর্মুলা চলে না। পেশাগত জীবনেও বিষয়টি প্রকট। প্রধান নির্বাহীর সঙ্গে একজন অফিস সহকারীরও এমন অহং বিরোধ তৈরি হতে পারে। বাস্তবেতো হচ্ছেই। ফল অফিসের আবহাওয়াও ঘোলাটে হয় পড়ে। নষ্ট হয় কাজের পরিবেশ।

সেবা নিতে গিয়ে কম বেশি সকলেই আমরা অগ্রাধিকার পেতে চাই। আমাদের এই অহং রোগের কথা ভেবেই সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান গুলো নানা শ্রেণি বিন্যাসও করেছে। ইকোনমি, বিজনেস, স্টার, ফাস্টক্লাস, প্লাটিনাম, শোভন, ডিলাক্স, ভিসা আরো কতো কি! তারপরও আমাদের অহং এর উপযোগ মেটেনা। আরো খাতির চাই। যখন পাই না. তখন নিজের পরিচয় ও অবস্থান নিয়ে সংশয়ে পড়ে যাই। তবে কি আমি স্থান চ্যুত হলাম। আমার গুরুত্ব কমে গেল?

মানসিক এই পীড়ার বিস্ফোরণ ঘটে পরিবারে, অফিসে, বাজারে, হাসপাতালে, টার্মিনালে বা ট্রাফিক সিগন্যালে। এই রোগে আক্রান্ত রোগীদের আমরা নিত্য পথে ঘাটে দেখি। সময় থাকলে দাঁড়িয়ে উপভোগ করি। কখনো মীমাংসার জন্য এগিয়ে যাই। নিজেরাও যে কখনও কখনও সেই রোগী হয়ে উঠি না তা নয়। কারণ অহং আক্রান্ত মানুষ নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। সারাক্ষণ ভাবে কেউ না কেউ তার দিকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিচ্ছে।

ফেসবুক, ইউটিউবের ভাইরাল রোগের কারণে অংহ আক্রান্ত রোগীদের আরো বেশি দেখার সুযোগ ঘটেছে। কারণ ভাইরাল ভিডিওতে তো এক দুইজন দেখলাম। তাঁদের ভিডিও নিয়ে যারা মন্তব্য করছেন, তাদের অহং এর বহিঃপ্রকাশও কম নয়। করোনাকালে হয়তো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে রোগীরা একটু বেশি বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন, এর বেশি কিছু নয়। তাই এখন যাকে বা যাদের সঙ্গে দেখা হয়, ফোনে কথা হয়, চ্যাটিং হয়, আগে থেকেই তাকে বুঝিয়ে দেই যে আমি জানি তিনি কে। তাই পথে বা সামাজিক পরিমণ্ডলে আপাতত ভালো আছি।

Advertisement

লেখক : গণমাধ্যমকর্মী।

এইচআর/এমএস