উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়ে মাদরাসার শিক্ষার্থীদের মাঠে নামিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের চেষ্টা করেছিল হেফাজতে ইসলাম। হেফাজতের বর্তমান নেতাদের মধ্যে ৩০ ভাগ জামায়াত সংশ্লিষ্ট। আর ৩০ ভাগ আফগান মুজাহিদ এবং ৪০ ভাগ সত্যিকারের ধর্মীয় রাজনীতি করেন।
Advertisement
এই কথাগুলো পুলিশকে জানিয়েছেন হেফাজতে ইলামের কেদ্রীয় যুগ্ম-মহাসচিব মামুনুল হক, যিনি এখন বিভিন্ন মামলায় পুলিশের কাছে বন্দী অবস্থায় আছেন। মামুনুল এও জানিয়েছেন যে, ২০১৩ সালের ৫ মে ঢাকা তাণ্ডবের আগে তাদের এখনকার প্রধান জুনায়েদ বাবু নগরীর সাথে বেগম খালেদা জিয়া ও বিএনপি নেতা সাদেক হোসেন খোকার কথাবার্তা হয়েছিল। একবার শাপলা চত্বরে বসে যেতে পারলে বেগম জিয়ার নেতৃত্বে ২০ দলীয় জোটের নেতা-কর্মীরা এসে যোগ দিয়ে সরকার উৎখাত করবেন।
হেফাজতের র্শীর্ষ নেতারা কিছুটা বিপদে পড়লেই বলেন, তারা রাজনীতি করেন না বা হেফাজত কোন রাজনৈতিক সংগঠন নয়। কিন্তু মামুনুলের বক্তব্য প্রমাণ করে এটি একটি রাজনৈতিক সংগঠন যার রাজনৈতিক আদর্শ উগ্রবাদী ও জঙ্গী। ২০১০ সালে নারী নীতির বিরোধিতা থেকে জন্ম নেওয়া হেফাজত বারবার রাজনৈতিক কর্মসূচি দিয়েই পথে নেমেছে। ২০১৩ সালে তারা নেমেছিল যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিরোধিতা করতে আর এবার নেমেছে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর রাষ্ট্রীয় কর্মসূচির বিরোধিতা করে।
১৯৭৫-এ বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হবার পর থেকে সাম্প্রদায়িকতার বিষটি একাত্তরের পরাজিত শক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশের রাজনীতির মেরুকরণের অন্যতম নির্ধারক হয়ে ওঠে। সেখান থেকে আর বের হয়ে আসতে পারেনি বাংলাদেশের রাজনীতি। বরং দেখা গেছে আওয়ামী লীগসহ যারা উদারনৈতিক রাজনীতি করবার কথা, তারাও এই রাজনীতির সাথে আপস করেই পথ চলছে।
Advertisement
২০১৩ সালে ৫ মে মতিঝিলের শাপলা চত্বর থেকে এদের বলপূর্বক সরিয়ে দেওয়া সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু এরপর এদের কদরও করা হয়েছে। এদের কওমী ডিগ্রীকে মাস্টার্স সনদ দেওয়া, এদের কথায় স্কুল পাঠ্য বইয়কে সাম্প্রদায়িক করে তোলা হয়েছে। এরা একে একে নিজেদের সব দাবি আদায় করেছে শেখ হাসিনা তথা বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার থেকে, কিন্তু আওয়ামী লীগ, বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করার দর্শন থেকে একচুলও সরেনি।
বলতে গেলে আরও বেশি আওয়ামী লীগ, বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের প্রতি ঘৃণা ছড়িয়েছে। এর নেতারা মাদ্রাসার ছাত্রদের বাংলাদেশ বিরোধী জঙ্গী মানসিকতায় গড়ে তোলায় সফল হয়েছে। হেফাজত এমন এক ধর্মীয় উগ্রবাদী, প্রতিক্রিয়াশীল তথা প্রগতি বিরোধী রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, এদের কারণে সামাজি পরিসরে মানুষের মুক্তচিন্তা, স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়াই কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত ২৬, ২৭ ও ২৮ মার্চ হেফাজত ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়, হাটহাজারিতে এবং এরপর ফরিদপুরের সালতায় দেখিয়েছে গণতন্ত্র, স্বাধীনতা এবং স্বাভাবিক জীবনের জন্য তারা কত বড় হুমকি।
বিএনপি ও এরশাদের জাতীয় পার্টি এদেশের ক্ষমতা দখল করে সাম্প্রদায়িকতার তাস ব্যবহার করেছে বারবার। এটা এমনভাবে করেছে যে, সংবিধানকেও তারা ছাড়েনি। ধর্মীয় মেরুকরণের ভিত্তিতে ভোটের রাজনীতিতে বিএনপি ও জাতীয় পার্টির সহযোগী হয়ে জামায়াতে ইসলামী ও অন্যান্য মৌলবাদী দল আরও সুসংহত করতে পেরেছে নিজেদের। যুদ্ধাপরাধের বিচারে কিছুটা পর্যুদস্ত নিবন্ধনহীন জামায়াত আগে থেকেই আছে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটে। এখন জঙ্গি কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে জুটেছে হেফাজতে সাথে। হেফাজতের ভেতরে আছে আরও কিছু রাজনৈতিক দল যারা আনুষ্ঠানিকভাবেই বিএনপি ও জামাতের জোটসঙ্গী।
তাই হেফাজতের মুখ নতুন করে চেনার প্রয়োজন নেই। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ এদের মোকাবেলা করবে কি করে? সহিংসতায় মদদ দেওয়ায় এখন হেফাজতের শীর্ষ নেতারা গ্রেফতার হচ্ছেন। কিন্তু রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে এদের মোকাবেলার আয়োজনটা কোথায়?
Advertisement
দেশে স্বাভাবিক রাজনীতি বলতে কিছু নেই এখন। আসলে রাজনীতিই নেই। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ সংগঠনগুলো গত একযুগ ধরে ক্ষমতা চর্চায় ব্যস্ত। ক্ষমতায় থাকার কলাকৌশল শিখে আওয়ামী লীগ এখন রাজনীতিকেই রাজনীতির দৃশ্যপট থেকে সরিয়ে দয়েছে। ক্ষমতায় থাকার জন্য প্রশাসন আর পুলিশ ভরসা হয়ে যাওয়ায় দলও রাজনীতি কোনটা সেটা ধরতে পারছে না। আর চলছে ব্যবসায়ীদের দলে ঢোকানোর আয়োজন। এমনকি দলে ভীড়ছে মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক মানসিকতার লোকজনও।
এই হল আওয়ামী লীগের অবস্থা। অন্যদিকে তারেক রহমানের নেতৃত্বে বিএনপি জিয়া পরিবার ভিত্তিক রাজনীতি করতে গিয়ে আইসিউতে চলে গেছে্। বিএনপির কাছে রাজনীতি মানেই ক্ষমতা। ক্ষমতা নেই, তাই রাজনীতিও নেই। যা আছে তা হল সাম্প্রদায়িক রাজনীতির দর্শনটুকু। আর এজন্যই মির্জা ফখরুলের কাছে জ্বালাও পোড়াও-এর আভিযোগে আটক হেফাজত নেতারা ‘শ্রদ্ধার পাত্র’ এবং তাদের মুক্তি দাবি করতে হয় তাকে। খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না বামেদের। রাজনীতির বড় মাঠে তারা এখন ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর। কণ্ঠহীন, উত্তাপহীন বাম রাজনীতির কোন আওয়াজই আসলে নেই এখন। এদের আওয়াজ যেটুকু আছে, সেটুকু হল নিজেদের ভেতরকার বিভেদ ও বিভাজন।
হেফাজত এক সহিংস সাম্প্রদায়িক রূপ নিয়ে আজ বাংলাদেশকে খামছে ধরেছে। মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশকে বাঁচিয়ে রাখতেই হবে। বাংলাদেশের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ- দুটোই আজ ধর্মের গোঁড়ামির শিকার। এদেশের মননের মধুতে আছে পারস্পরিক সহিষ্ণুতা। সঙ্কীর্ণ ধর্মীয় রাজনীতির হাত থেকে আমাদের সেই উদারতাকে বাঁচাতেই হবে। দেশটাকে বাঁচাতে হলে চাই স্বাভাবিক রাজনীতি ও সংস্ক্রতি চর্চা, তবেই এরা একাত্তরের মতো হারবে আবার।
লেখক : প্রধান সম্পাদক, জিটিভি।
এইচআর/এমএস