শহুরে জীবন-যাপনে যারা অভ্যস্ত, দিনে-রাতে একটা সময়ে হাঁটা তাদের নিত্য কাজের অংশ। গত ১৫ নভেম্বর ২০১৫ তারিখে হাঁটতে হাঁটতে গেরুয়া বাজারে গিয়ে সবজি কিনে দু’হাত ভারি হয়ে যাওয়ায় রিক্সা খুঁজতে হয়। গেরুয়া বাজারে ভোরে রিক্সা দুষ্প্রাপ্য বিষয়। এ বাজারে প্রবেশ পথে একটি রিক্সা গ্যারেজ আছে। সেই গ্যারেজে গিয়ে দেখি সবজির ব্যাগ হাতে কয়েকজন চালক রিক্সা নিয়ে বের হওয়ার অপেক্ষায়। আমার একটি রিক্সা জুটে যায়। রিক্সায় চড়ে বাসায় ফিরতে ফিরতে কথা হয় চালক রুবেল হোসেনের সঙ্গে। রুবেল হোসেন রিক্সা চালক হিসেবে একেবারে নবীন। তার রিক্সা ড্রাইভিং জীবনে আমি প্রথম যাত্রী। শুনে ভালো লাগে তবে চালক হিসেবে একেবারে আনাড়ির কথা শুনে আমি কিছুটা ভয় পাই। দুর্ঘটনা ঘটে কী না, তা নিয়ে একটু আধটু আতঙ্কে ছিলাম। বলা প্রয়োজন যে, সে আতঙ্ক ছিলো অমূলক। রুবেল আমাকে ভালোভাবে বাসায় নিয়ে আসে। রুবেল যে, জীবনে প্রথম রিক্সার হাতল ধরেছে, বিষয়টি আমাকে না জানালে বুঝবার উপায় ছিলো না। রুবেল হোসেনের বয়স ত্রিশের ঘরে। নওগা জেলার সাপাহার থানার শিরন্ডি গ্রামে তার বাড়ি। ২০০০ সালের এসএসসি পাস। যদিও রুবেল হোসেন বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন ২০০২ সালে এইচএসসি ফেল। রুবেলের কথা, দু’বছর লেখাপড়া করার মূল্য আছে না? এইচএসসি ‘পাস’ করলে যেমন পাস বলা যায়, তেমনি ফেল করলে ‘ফেল’ বলতে লজ্জা কী? কোনো পরীক্ষায় সবাই পাশ করে না-কি? একাধিক বিষয়ে ফেল করলেও সমস্যা নেই, পরের বছর ফেল করা বিষয়ে পরীক্ষা দিয়ে পাস করা যায়- এটা রুবেল হোসেনের জানা। এই সুযোগ থাকার পরও এইচএসসি ‘ফেল’ থাকার কী দরকার ছিলো? এমন প্রশ্নে রুবেল হোসেন জানান, ফেল করে আবার পাস করার সুযোগ আমি নিতে পারি নাই। মাথায় একটা অপারেশন করার প্রয়োজন হয়েছিলো। মাথা ঠিক না থাকার কারণে পড়ার টেবিলে আর বসা হয় নাই। বড় দুই ভাই লেখাপড়া করেছে। তারা চাকরি করে। রুবেল হোসেন বলেন, চাকরির পেছনে আমি ছুটি না। চাকরি একটি স্থায়ী বিষয়। যোগ্যতাও লাগে। এ দুইটার একটিও আমার নেই। রুবেল হোসেন বলেন, ‘আমাদের বাড়ির অবস্থা খারাপ না। নিজেদের জায়গা-জমি আছে। সারা বছর নিজের ঘরের চালের ভাত খাই। ধান বিক্রিও করি। কয়েক দিন আগে ধানকাটা শেষ হয়েছে। বাড়িতে এখন কোনো কাজ নেই। আগের বছরগুলোতে ধান গোলায় তোলার পর তিন-চার মাস কাজকর্ম ছাড়া বাড়িতেই কাটিয়েছি। এবার ভাবলাম একটা কিছু করি। শুধু শুধু বাড়িতে বসে না থেকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে রিক্সা চালানোর জন্য চলে আসলাম।’ অগ্রহায়ণে গ্রামাঞ্চলে নতুন ধানের পিঠা-পুলির আয়োজন হয়। আত্মীয়-স্বজনদের বাড়িতে বেড়ানোর পর্ব চলে এসময়ে। শহরে এ সময়টাতে ‘নবান্ন’ নামে উৎসব-অনুষ্ঠান হয়। আমন ধান ঘরে তোলার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয়ে যায় অনুষ্ঠানের ধুম। বাড়ি বাড়ি তৈরি হয় নানা মুখরোচক পিঠা-পুলি আর পায়েস। নতুন-পুরনো মেয়েজামাই থেকে শুরু করে নিকটাত্মীয়-স্বজনের আগমনে মুখর থাকে সারা বাড়ি। এই সময়ে গ্রাম ছাড়তে খারাপ লাগলো না? এ কথার জবাবে রুবেল হোসেন বলেন,‘ নবান্ন উৎসব বই-পুস্তক, পত্র-পত্রিকা আর শহরে আছে। আসলে পিঠা-পায়েস তো একদিন-ই খাওয়ার আইটেম না। এটা হয়তো শহরে একদিন ঘটা করে খাওয়ার বিষয়। গ্রামে এই কৃত্রিমতা দেখানোর কিছু নেই। গ্রামে যে বাড়িতে চাল-গুড় আছে, সে বাড়িতে নিয়মিতই পিঠা-পায়েস তৈরি করা হয়। শুধু বিশেষ একটা দিনেই আমরা পিঠা খাই না। আমার মনে হয়, শহরে নবান্ন উৎসব, একটা আনুষ্ঠানিকতা। গ্রামে এতো উৎসব আসবে কোথা থেকে? উৎসব আনন্দের বিষয়। আনন্দ করতে টাকা লাগে। আয়-রোজগার ভালো হলে মনে আনন্দ আসে। চালের দাম বেশি হলে পত্রিকায় বড় বড় লেখা হয়। আসলে অনেকেই জানেন না যে, এখন ধান চাষ করে কৃষক অনেক ক্ষতিগ্রস্ত। ধান চাষে লাভ নেই। ধান উৎপাদনে যে খরচ, ধান বিক্রিতে সে টাকা উঠে না। এরপরও আমরা ধান চাষ করি। নিজেদের তো খেতে হয়। আর জমি পতিত রাখা যায়? দেশের মানুষ খাবে কী? রুবেল হোসেনের কথার সত্যতা পাওয়া গেল সংবাদপত্রে। সংবাদপত্রে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ‘এবারের আমন ধান ফলাতে কেজিপ্রতি কৃষকের খরচ বেড়েছে ৫০ পয়সা। মণে বেড়েছে ২০ টাকা। কিন্তু বাজারে ধানের যে দাম তাতে খরচ তো উঠবেই না, বরং গত বছরের চেয়েও কম দাম পাওয়ার আশঙ্কা আছে। বড় বড় মিল মালিকদের কাছে এখনো রয়ে গেছে গত মৌসুমের আমন ও বোরো ধান। সেই শুকনো ধানের মণপ্রতি দর এখন সাড়ে ৫০০ টাকার কাছাকাছি। আর নতুন ওঠা আমন ধান বিক্রি হচ্ছে ৫৩০ থেকে ৫৪০ টাকা মণ দরে। অথচ সরকারের হিসাবেই এবার এক মণ ধানের উৎপাদন খরচ দাঁড়িয়েছে ৭৪২ টাকা। কৃষকরা বলছে, মণপ্রতি ৭০০ টাকা দর না পেলে তাদের কিছুতেই পোষায় না। কিন্তু বছরজুড়েই কখনো ধানের মণ এবার ৭০০ টাকার বেশি হয়নি, সেটা যে ধানই হোক। আমনে কৃষকের বিপদ আরো বেশি। কারণ, তাদের অনেকের ধানই অতিবৃষ্টি ও বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফলে মোটের ওপর খরচ আরো বেড়েছে।’ প্রকাশিত ওই প্রতিবেদন থেকে আরো জানাযায় যে, ‘২০১৪-১৫ অর্থবছরে দেশের কৃষকরা রেকর্ড পরিমাণ ধান ফলিয়েছে। বছর শেষে মোট উৎপাদন দাঁড়িয়েছে তিন কোটি ৪৭ লাখ টন। কিন্তু এত বেশি উৎপাদনের পরও দেশের বাজারে ঢুকেছে ভারতীয় চাল। আমদানি হয়েছে ১৪ লাখ ৯০ হাজার টন চাল। সব মিলিয়ে ব্যাপক সরবরাহের কারণে চালের দাম কমে গেছে। বছরজুড়ে দাম কমতির দিকে থাকায় গত আমনের পর বোরোতেও কৃষকরা লাভের মুখ দেখেনি। এবারের আমনেও তাদের মুখে হাসি ফোটার কোনো আশা নেই। কৃষকের মুখে ধানের দরে হতাশা কাটছেই না।’ রুবেলের সঙ্গে আমার আলাচারিতায় নবান্ন এবং ধানের প্রসঙ্গ আসায় লক্ষ করলাম রুবেলের মন খারাপ হয়ে গেছে। কামলার খরচ, নিজের অবিরত খাটুনি এবং অন্যান্য খরচের বিপরীতে ধানের দাম উঠে না আসায় চোখে-মুখে মন খারাপের অবয়ব ফুটে উঠেছে। কথা বলতে বলতে বাসায় চলে এসেছি। রুবেলকে বললাম, দাঁড়াও তোমার ছবি তুলি। রুবেল ছবির জন্য দাঁড়ালো। কিন্তু মুখে হাসি হাসিভাব নেই। আজব সস্তার কয়েকটি উদাহরণ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আছে। ক্যাম্পাস থেকে-ঢাকার গুলিস্তান পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসে শিক্ষার্থীদের যাওয়া কিংবা আসার ভাড়া মাত্র এক টাকা! আর রিক্সা ভাড়া, সেটাও দেশের অন্যান্য জায়গার তুলনায় কম। সর্বোচ্চ দশ টাকা। রুবেল হোসেনের জীবনের প্রথম যাত্রী আমি। বিশ টাকা ভাড়া দিলাম। এই বিশ টাকা ভিন্ন পেশায় রুবেলের প্রথম আয়। তাই, রুবেল টাকায় চুমু খায়। দেখে মনে হলো সে একটু খুশিই হয়েছে। ফিরে গেল অন্য যাত্রীর আশায়। লেখক : গবেষকএইচআর/এমএস
Advertisement