বিশেষ প্রতিবেদন

আনোয়ারা ও নাহারের জীবন থেমে গেছে তামাকে

না পুড়িয়ে যে তামাকজাত দ্রব্য সরাসরি সেবন করা হয়, সেটা মুখে রেখে দিয়ে, চিবিয়ে বা নাক দিয়ে গন্ধ শুঁকে খাওয়া হয় তা ধোয়াবিহীন তামাকজাত দ্রব্য নামে পরিচিত। ইংরেজিতে এটিকে (Smoke less Tobacco-SLT) বলা হয়। যেকোনো তামাকজাত দ্রব্যের মতোই ধোয়াবিহীন তামাকে নিকোটিন আছে এবং তা মুখের ভেতরের আস্তরণ দিয়ে শরীরে প্রবেশ করে।আমাদের দেশে সাধারণভাবে ধোয়াবিহীন তামাকদ্রব্যের মধ্যে রয়েছে সাদাপাতা বা আলাপাতা, জর্দা ও গুল অন্যতম। ১৫ বছর বয়স বা তার ঊর্ধ্ব বয়সের নারী ও পুরুষেররা এই ধোয়াবিহীন তামাকজাতদ্রব্য ব্যবহার করেন। জর্দা ও গুলের ব্যবহার বর্তমান শহরের চেয়ে গ্রামে খুব বেশি এবং ধনী ও মধ্যবিত্তের চেয়ে গরিবের মধ্যে বেশি বলে সাধারণভাবে ধারণা করা হয়।এই ধোয়াবিহীন তামাকজাতদ্রব্য সেবন করে আনোয়ারা নামের দরিদ্র এক নারীর জীবন থেমে গেছে। আনোয়ারা বেগমের বাড়ি মাগুরার হাজরাপুর ইউনিয়নের সাচানি গ্রামে। মাত্র ১৪ বছর বয়সে বিয়ে হয় তার। বিয়ের ৫ বছর পর অন্যকে দেখে নেশার বশবর্তী হয়ে পানের সঙ্গে জর্দা খাওয়া শুরু। এভাবে সে বাজারে প্রচলিত বিভিন্ন জর্দা কিনে পানের সঙ্গে নিয়মিত সেবন করেন। পানের সঙ্গে এই জর্দা খাওয়ার নেশা তার চলতে থাকে দিনের পর দিন। সকালে, দুপুরে, বিকেলে, এমনকি রাতেও তিনি জর্দা দিয়ে পান খান। এর কয়েক বছর পর তিনি গুল ব্যবহার শুরু করেন। জর্দা ও গুল ব্যবহার না করলে তার ভালো লাগে না। কেনোদিন এই দুটো জিনিস ব্যবহার না করলে তার কাছে অতৃপ্তি লেগে যায়। দু’বেলা দু’মুঠ ভাত না খেতে পারলেও তার পানের সঙ্গে জর্দা ও গুল লাগবেই।আনোয়ারার স্বামী বেঁচে থাকাকালীন তিনি বাজার থেকে এগুলো তার জন্য কিনে নিয়ে আসতেন। পরে তার স্বামী মারা গেলে তিনি নেশার কারণে এগুলো ছাড়তে পারেননি। আনোয়ারা বেগমের বয়স যখন ৩২ বছর তখন তার দাঁতের ডান পাশে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব করেন। এই ব্যথা রাত হলেই তীব্র আকার ধারণ করে। তার পর থেকে তার দাঁতের ডান পাশে পচন ধরতে শুরু করে। প্রথমে তিনি বুঝতে পারেননি যে, তার ডান পাশের সবগুলো দাঁত পচন ধরেছে। পরে তিনি চিকিৎসকের নিকট গেলে তারা পরীক্ষা নিরীক্ষা করেন।চিকিৎসকরা জানান, তার দাঁতের ডান পার্শ্বের সম্পূর্ণ অংশ পচে চোয়ালের হাড়ে পচন ধরতে শুরু করেছে। খুব তাড়াতাড়ি অপারেশন না করালে মুখের অনেকাংশ ক্ষতির সম্মুখীন হবে। আনোয়ারার কাছে থাকা ও অন্যের সহযোগিতায় কিছু টাকা যোগাড় করে তিনি অপারেশন করান। অপারেশনে তার মুখের ডান পার্শের কিছু অংশ কাটা পড়ে যায়। বর্তমানে আনোয়ারা বেগমের পূর্বের চেহারার সঙ্গে এখনকার চেহারার অনেক অমিল লক্ষ্য করা গেছে। তিনি এখন ভালো করে মুখ খুলতে পারেন না। খাবার খেতে পারেন না। বর্তমানে শুধু তরল খাবার খেয়েই তিনি বেঁচে আছেন।আনোয়ারা বেগম জাগো নিউজকে বলেন, একাধারে ১২ থেকে ১৩ বছর জর্দা ও গুল সেবন করায় শরীরের অনেক রোগব্যাধি বাসা বেঁধেছে। হাতে পায়ে ব্যাথা, শরীর অবশ হয়ে যাওয়া, মাথা ও ঘাড়ে ব্যাথা এবং মাঝে মাঝে বুকের ভিতরে জ্বালা-যন্ত্রণা করে। তাই সেসব নারীদেরকে আহ্বান করেন যাতে তার এতা কোনো নারী যেন জর্দা গুল ব্যবহার করে জীবনের ক্ষতি না ডেকে আনে।অপরদিকে, মাগুরা পৌরসভাধীন দরি মাগুরার লুৎফুন্নাহার (৬৫) দীর্ঘদিন ধরে গুল ব্যবহার করে ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। তিনি একাধারে ১৭ বছর গুল ব্যবহার করে আসছেন। সখ করে বা অন্যের খাওয়া দেখে তিনি এ গুল ব্যবহার শুরু করেন। গুল ব্যবহারে তার মুখের ভেতরের উপর ও নিচের মাড়ির সবগুলো দাঁত পচন ধরেছে ও বিভিন্ন রোগ দেখা দিয়েছে। তিনি ঠিকমতো খেতে পারেন না।তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নেশার কারণেই তিনি গুল ব্যবহার করতেন। অনেক ছাড়তে চেষ্টা করেও তিনি এ গুল ব্যবহার ছাড়তে পারেনি। দাঁতের চিকিৎসকরা জানিয়েছেন- বয়স বেশি হওয়ার করণে এখন দাঁতের অপারেশন করানো সম্ভব নয়। দাঁতের বিভিন্ন অংশ ওয়াশ করে চিকিৎসকরা ওষুধ দিয়েছেন। তিনি আরও জানান, আমার দাঁতের ব্যথা দিন দিন বেড়েই চলেছে। কোনো ওষুধেই কাজ হচ্ছে না। নিজের ভুল স্বীকার করে তিনি বলেন, আমি গুল ব্যবহার করে যে ভুল করেছি তা যেন আর কোনো নারী না করেন।এ বিষয়ে মুখ ও দন্তরোগ বিশেষজ্ঞ সার্জন ডা. দিপায়ন বিশ্বাস দিপু জাগো নিউজকে জানান, জর্দা, গুল সাদাপাতা, সেবনে দাঁতের মারাত্মক ক্ষতি হয়। এগুলো ব্যবহারের ফলে শরীরে সরাসরি নিকোটিন প্রবেশ করে। আর এ নিকোটিন মুখের টিস্যুর মাধ্যমে শরীরে রক্তের সঙ্গে সরাসরি মিশে যায় এবং সেইসঙ্গে মাথার মগজেও প্রবেশ করে। এছাড়া এগুলো সেবনে মুখে ঘা, ক্যান্সার, খাদ্যনালীতে ক্যান্সার, প্যানক্রিয়াসের ক্যান্সারও হতে পারে। তিনি আরও বলেন, বিশেষ করে আমাদের দেশে পুরুষের চেয়ে নারীরা বেশি আক্রান্ত হয় এসব রোগে। তাছাড়া ধোয়াবিহীন তামাকদ্রব্যের মধ্যে এমন অনেক রাসায়নিক উপাদান আছে যা ক্যান্সার সৃষ্টি করতে সহায়তা করে থাকে।মাগুরা সদর হাসপাতালের গাইনি অ্যান্ড অবস কনসালটেন্ট ডা. শামসুন নাহার লাইজু জাগো নিউজকে বলেন, ধোয়াবিহীন তামাকজাতদ্রব্য জর্দা, সাদাপাতা, গুল এগুলো নারীরা গর্ভাবস্থায় সেবন করলে মা ও নবজাতক শিশুর গঠনে মারাত্মক ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে। বিশেষ করে এগুলো গর্ভাবস্থায় সেবন করলে নবজাতক শিশুর ওজন কম হওয়া, অপরিণত, মৃত ও প্রতিবন্ধীও হতে পারে।তিনি আরও জানান, এগুলোতে রয়েছে নিকোটিন নামক উপাদান। যার কারণে এগুলো সেবনে জন্মের আগেই নবজাতক শিশুর ব্রেইন ও শারীরিক বৃদ্ধি গঠনে নানা সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। এ জন্য এগুলো গর্ভাবস্থায় সেবন করা ঠিক নয়।ধোয়াবিহীন তামাকজাতদ্রব্য নিয়ে তামাকবিরোধী নারী জোট (তাবিনাজ) বাংলাদেশের ৫২টি জেলায় নারী সংগঠনের মাধ্যমে ২০১০ সাল থেকে কাজ করে আসছে। মাগুরা জেলায় তামাকবিরোধী নারী জোটের সংগঠন রুরাল ডেভেলপমেন্ট সেন্টার (আরডিসি) সংস্থা তাবিনাজের জন্মলগ্ন থেকে কাজ করে আসছে।এই সংগঠন জেলায় ধোয়াবিহীন তামাক ব্যবহার কমানো এবং ধোয়াবিহীন তামাকের ক্ষেত্রে আইন বাস্তবায়নে সহায়তা করে আসছে। ধোয়াবিহীন তামাকজাতদ্রব্য ব্যবহার সম্পর্কে জনসাধারণকে সচেতনা সৃষ্টি কাজও করে আসছে। তাছাড়া বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তামাক ব্যবহারের কুফল সম্পর্কে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সঙ্গে মতবিনিময় ও শহরের অফিস আদালত হাট-বাজারসহ বিভিন্ন স্থানে স্টিকার ও লিফলেট ব্যবহার করে জনসচেতনতা মূলক কাজ করে আসছে।আরাফাত হোসেন/বিএ

Advertisement