আন্তর্জাতিক

শিশুরা টিকা পাওয়ার আগেই স্বাভাবিক জীবনযাত্রা কি সম্ভব?

করোনাপূর্ব পরিস্থিতি কত দ্রুত ফিরে আসবে তা নিয়ে অনেকেই দ্বিধায় রয়েছেন। বিশ্বের বেশিরভাগ জায়গায় দেখা দিয়েছে টিকাস্বল্পতা। করোনাভাইরাসের টিকা দেয়ার ক্ষেত্রে প্রাপ্তবয়স্কদের অগ্রাধিকার দিচ্ছে কর্তৃপক্ষ। ফলে এখনও টিকাবঞ্চিত শিশুরা। যুক্তরাষ্ট্রে আগামী মাসে ১২ থেকে ১৫ বছর বয়সীদের টিকা দেয়া শুরু হতে পারে। কিন্তু এর চেয়ে কম বয়সের যারা রয়েছে, তাদের কী হবে? এ ধরনের শিশুদের টিকা না দিয়েই কি স্বাভাবিক জীবনযাত্রা শুরু করা যাবে?

Advertisement

এ বিষয়ে শুক্রবার মার্কিন সংবাদপত্র দ্য নিউইয়র্ক টাইমসে লিখেছেন পুলিৎজারজয়ী সাংবাদিক ডেভিড লিওনহার্ট। শুধু প্রাপ্তবয়স্কদের টিকা দিয়েই জীবনযাত্রা স্বাভাবিক করতে গেলে কতটা ঝুঁকির মুখোমুখি হতে হবে সে বিষয়ে আলোকপাত করেছেন তিনি। লেখকের মতে, এই প্রশ্নের উত্তর সহজ নয়। পরিবারগুলো নিজ নিজ পছন্দ অনুসারে সিদ্ধান্ত নেবে, তারা শিশুদের টিকা না দিয়েই বাইরে বেরোতে দেবে কি না।

অনেক বাবা-মা সন্তানদের টিকা না দেয়া পর্যন্ত ঘরোয়া সামাজিক আয়োজন থেকে দূরে রাখতে চাইবেন। এক্ষেত্রে তারা যুক্তি দেখাতে পারেন, করোনাভাইরাসে বেশ কিছু শিশুর মৃত্যু হয়েছে, আরও কয়েক হাজার প্রদাহ জটিলতায় ভুগছে। তাছাড়া এই অসুখের অনেক বিষয় এখনও অজানা।

করোনার ভবিষ্যৎ ধরনগুলো শিশুদের জন্য আরও মারাত্মক হতে পারে, এর দীর্ঘমেয়াদী জটিলতার বিষয়ও এখনো পরিষ্কার নয়। সেক্ষেত্রে শিশুদের জন্য সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেয়া বিচক্ষণ সিদ্ধান্তই হবে।

Advertisement

তবে অন্য বাবা-মায়েরা টিকা না দিলেও সন্তানকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে দিতে বেশি আগ্রহী হতে পারেন। সেক্ষেত্রে তারা হয়তো এমন পদক্ষেপ নেবেন, যা বৈজ্ঞানিকভাবে আরও সতর্কতামূলক হিসেবে স্বীকৃত।

দুর্ভাগ্যজনকভাবে, আগামী কয়েক মাস বাবা-মায়েদের সামনে ঝুঁকিমুক্ত কোনও পথ নেই। বাচ্চাদের বাসায় রাখা, বন্ধুদের থেকে আলাদা, স্কুল, বর্ধিত পরিবারের সংস্পর্শবিহীন জীবন তাদের আরও বেশি ক্ষতি করতে পারে। একাধিক গবেষণায় তেমনটাই বলা হচ্ছে।

জনস হপকিন্স ইউনিভার্সিটির মহামারি বিশেষজ্ঞ ডা. আমেশ আদালজা বলেন, শুধু করোনার দৃষ্টিভঙ্গিতে না দেখে সন্তানের সামগ্রিক স্বাস্থ্যের দিকে তাকানো বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাছাড়া নিম্নআয়ের পরিবারগুলোর জন্য শিশুদের পৃথক রাখা আরও কঠিন।

ডেভিড লিওনহার্ট লিখেছেন, প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য করোনাভাইরাস এতটাই নৃশংস পরিসংখ্যান দেখিয়েছে যে, এতে তাদের দৈনন্দিন কাজের বেশিরভাগই বন্ধ করে দিতে হয়েছে। এই অসুখটি যুক্তরাষ্ট্রে এক বছরে ফ্লুতে যত মানুষ মারা যায়, তারচেয়ে অন্তত ১৬ গুণ বেশি মানুষের প্রাণ কেড়েছে।

Advertisement

তারপরও ২০২০ সালে দেশটিতে অসুখে মৃত্যুর কারণ হিসেবে তিন নম্বরে ছিল করোনাভাইরাস। এর চেয়ে সেখানে হৃদরোগ ও ক্যান্সারে বেশি মানুষের প্রাণ গেছে। আর দুর্ঘটনা, আত্মহত্যার মতো বিষয়গুলো যোগ করলে তালিকার পাঁচে নেমে যাবে করোনা।

তবে শিশুদের ওপর করোনার মৌলিক প্রভাব প্রাপ্তবয়স্কদের থেকে বেশ আলাদা। বাচ্চাদের ক্ষেত্রে এর ঝুঁকি অনেকটা দীর্ঘকাল ধরে সমাজে বয়ে বেড়ানো ঝুঁকির মতোই দেখায়, যার কারণে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা থামিয়ে দিতে হয় না।

এক্ষেত্রে লেখক যুক্তরাষ্ট্রে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে শিশুমৃত্যুর পরিসংখ্যানটি উল্লেখ করেছেন। তিনি জানান, দেশটিতে করোনায় আক্রান্ত হয়ে ১৮ বছরের কম বয়সী ৪৫০ জনের মৃত্যু হয়েছে, যার চেয়ে সাধারণ ফ্লুতে প্রতি বছর অনেক বেশি মানুষ মারা যায়। করোনার কিছু ধরন হয়তো বেশি গুরুতর হতে পারে, তবে তাতে তুলনামূলক পার্থক্য খুব একটা কমবে না। এ বিষয়ে ইউনিভার্সিটি অব মিনেসোটার ডা. রেবেকা ওয়ার্টজ বলেন, [করোনায়] শিশুদের গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ার ঘটনা খুবই অস্বাভাবিক।

শিশুরা গত বছরের বেশিরভাগ সময় ঘরে কাটিয়েছে বলে তাদের করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা কম, শুধু এমনটাই নয়। যেসব শিশু এতে আক্রান্ত হয়েছিল, তাদের মধ্যে মৃত্যুহারও সাধারণ ফ্লুতে মৃত্যুহারের মতোই।

এই পরিসংখ্যানই বলছে, ইনফ্লুয়েঞ্জা একটি মারাত্মক অসুখ। প্রতি বছর গড়ে ৩৫ হাজার মার্কিনি এই রোগে মারা যান। প্রায় একই সংখ্যক লোক প্রাণ হারান বন্দুক সহিংসতার শিকার হয়ে।

এরপরও এসব ঘটনা শিশুদের জীবনযাত্রা স্তব্ধ করে দেয় না। ফ্লু সংক্রমণের মধ্যেই তারা স্কুলে যায়। মার্কিনিরা ধরেই নিয়েছে, শিশুদের ক্লাসরুম, ডে-কেয়ার সেন্টার, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়-স্বজন, এমনকি দোকানে বার্গার কিনতে যাওয়ার মতো কার্যকলাপ থেকে বিরত রাখলে ফ্লু থেকে রক্ষা করার চেয়ে বেশি মূল্য চোকাতে হবে।

হার্ভার্ড টি এইচ চান স্কুল অব পাবলিক হেলথের গবেষক স্টিফেন কিসলার বলেন, ১৮ বছরের কম বয়সীদের জন্য করোনাভাইরাস ততটা বড় ঝুঁকি নয়। আমি এটিকে ফ্লুর সমান ঝুঁকি মনে করি না।

করোনার সঙ্গে শিশুমৃত্যুর অন্য কারণগুলোরও তুলনা করা যেতে পারে। গত বছর যুক্তরাষ্ট্রে করোনায় যত শিশু মারা গেছে, প্রতি বছর তার চেয়ে দ্বিগুণ মারা যায় পানিতে ডুবে। আর পাঁচগুণ বেশি মারা যায় গাড়ি দুর্ঘটনায়। সুতরাং ‘ছোট কিন্তু মারাত্মক ক্ষতির সত্যিকারে ঝুঁকি’ থেকে শিশুদের বাঁচানোই যদি সমাজের লক্ষ্য হয়, তাহলে তাদের ঘরবন্দির তুলনায় পুকুর কিংবা গাড়ি থেকে দূরে রাখলে বেশি ভালো ফল পাওয়া যাবে।

তাহলে প্রাপ্তবয়স্কদের টিকা দেয়া হয়ে গেলে কী করবে আপনার পরিবার? সেক্ষেত্রে সবার টিকা নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। কারণ বাচ্চারাও সংক্রমণ ছড়াতে পারে। এমনকি টিকা নেয়ার পরেও বাইরে মাস্ক পরা, ঝুঁকিপূর্ণ স্থান এড়িয়ে চলার মতো সাধারণ সতর্কতা অনুসরণ করতে বলেছেন তারা।

কেএএ/এএসএম