মতামত

শঙ্খ ঘোষের প্রয়াণ এবং ‘জার্নাল’ প্রসঙ্গ

প্রিয় কবি শঙ্খ ঘোষকে একবারই দেখেছিলাম ঢাকায়, একটি অনুষ্ঠানে। শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেটের দোতালায়। কাব্যানুরাগীদের বিভিন্ন কৌতূহল আর জিজ্ঞাসার নানা কথার উত্তর দিচ্ছিলেন। দেশভাগ নিয়ে গভীর ক্ষত ছিল তাঁর।

Advertisement

আমার প্রথম প্রকাশিত বই - গর্ভস্থ ভ্রূণকে লেখা দিনলিপি ‘‘আমার মেয়ে : আত্মজার সাথে কথোপকথন’ প্রকাশের পর শিশু সাহিত্যিক, সম্পাদক আখতার হোসেন আমাকে শঙ্খ ঘোষের জার্নাল পড়তে বলেছিলেন।

শঙ্খ ঘোষ ‘জার্নাল’ যখন লেখেছিলেন তখন এসব লেখা প্রকাশের চিন্তা তার মাথায় ছিল না। ১৯৭৮ সালে একবছরের শান্তিনিকেতন- বাসের সময়, প্রতিরাতে কিছু-না-কিছু লিখে রাখতেন নিভৃর্তে । এ কারণেই সম্পূর্ণ নির্ভার হয়ে নিজের একান্ত ব্যক্তিগত অনুভূতি প্রকাশ করেছেন সেসব ‘টুকরো’ লেখায়। যেসব অনুভূতিকে তাঁর বিভিন্ন কবিতাতেও পাওয়া সম্ভব হয় না, সেসব অনায়াসে লিখে যেতে পেরেছিলেন জার্নালে।

বিচ্ছিন্ন মুহূর্তের বিভিন্ন ব্যক্তিগত অনুভূতির পাশাপাশি এইসব দিনলিপির পাতায় পাতায় ছড়িয়ে আছে বিভিন্ন লেখক-কবিদের সম্পর্কে তার অভিমত, মূল্যায়ন। ব্যক্তিগত অনুভূতি, লেখক-কবিদের নিয়ে আলোচনা ছাড়াও বাংলা সাহিত্য, বিশ্ব সাহিত্য, লেখালেখি, রবীন্দ্রনাথ, শান্তিনিকেতন, জীবনদর্শন নিয়ে টুকরো সেসব লেখা।

Advertisement

ভেবেছিলেন কবি, ছিন্ন ছিন্ন লেখাগুলো পাঠকের কাছে তুচ্ছ মনে হবে। ধারাবাহিকতা আর ঘনতার অভাবে পড়ার আগ্রহ হবে না অনেকেরই। কিন্তু কবির অনুমান নিভুর্ল ছিল না। আমি পড়েছিলাম ২০১০ সালে কলকাতার দে’জ পাবলিশিং থেকে প্রকাশিত ৬ষ্ট মুদ্রণ। ইতিমধ্যে আরোও অনেকবার মুদ্রিত হয়েছে। এ যুক্ত হয়েছে জার্নাল নয় এমন কিছু লেখাও। শঙ্খ ঘোষ সেসব লেখাকে অভিহিত করেছেন, প্রবন্ধ নয়, প্রবন্ধের বীজ মাত্র।

এই সংকলনে শঙ্খ ঘোষের দূরদৃষ্টিতা, চিন্তার গভীরতা, অনুভবের মানবিকতা পাঠককে বিস্মিত করে; গভীর ভাবনায় বিমুগ্ধ করে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রায় ৪০ বছর আগে লেখা কবির এই বিশ্লেষণ এখন তো বটেই, আরোও অনেক বছর পরেও একইভাবে প্রাসঙ্গিক থাকবে- স্থান-কাল-পাত্র ভেদে, সীমানা পেরিয়ে। গতকাল ২১ এপ্রিল, ২০২১ এ শঙ্ঘ ঘোষের ‘জার্নাল’ থেমে যায়। পরিণত বয়সেই প্রয়াত হলেন কবি । বাংলার কবিতার এক যুগের অবসান হলো। বাংলা কবিতার এক বড় শক্তি; আরেক কিংবদন্তী - বিদায় কবি শঙ্খ ঘোষ!

‘‘একলা হয়ে দাঁড়িয়ে আছিতোমার জন্য গলির কোণেভাবি আমার মুখ দেখাবমুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে।’’।

শঙ্খ ঘোষ জন্মেছিলেন আমাদের এ বাংলায়- চাঁদপুরে। পৈতৃক বাড়ি ছিল বরিশালের বানারীপাড়ায়। হার্ডিঞ্জ ব্রিজের শহর পাবনার পাকশীতে বেড়ে উঠেছিলেন। বাংলাদেশের প্রতি টান ছিল সহজাত। হয়তো একারণেও এদেশের কবি-সাহিত্যিকদের মনে করতেন নিজেদের একজন। সংযোগও রেখেছিলেন নিয়ম করেই।

Advertisement

পাঠকের ভালোবাসা ছাড়াও তাঁর প্রাপ্তি - ‘বাবরের প্রার্থনা’ কাব্যগ্রন্থের জন্য সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার। তিনি ১৯৭৭ সালে দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ এ সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছিলেন। ১৯৯৯ সালে কন্নড় ভাষা থেকে বাংলায় ‘রক্তকল্যাণ’ নাটকটি অনুবাদ করেও সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার পান। এ ছাড়াও রবীন্দ্র পুরস্কার, সরস্বতী সম্মান, জ্ঞানপীঠ পুরস্কার পেয়েছেন। ২০১১ সালে তাঁকে পদ্মভূষণে সম্মানিত করে তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকার।

১৪ এপ্রিল, শঙ্ঘ ঘোষ কোভিড-১৯ এ সংক্রমিত হয়েছিলেন। করোনা সংক্রমণের পর বাড়িতেই নিভৃতবাসে ছিলেন। শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে একসময় তাঁকে কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাস দেয়া হয়। করোনার করাল গ্রাসে পড়ে আমাদের শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি অঙ্গন থেকে আলোকস্তম্ভস্বরূপ অনেক ব্যক্তিত্ব হারিয়ে গেলেন। কারো কারো চলে যাওয়া শুধু হারিয়ে যাওয়া নয়, যেন নক্ষত্রপতন।

জীবনানন্দ দাশ পরবর্তী বাংলা কবিতার এই পাঁচ নক্ষত্র- শক্তি-সুনীল-শঙ্খ-উৎপল-বিনয় এরপর চার জনই চলে গিয়েছিলেন আগেই। গতকাল চলে গেলেন আরেক নক্ষত্র শঙ্খ ঘোষ। ৮৯ বছর বয়সে নক্ষত্র পতন। যদিও কবিতার নক্ষত্রসভায় চলতে থাকবে সে নামের পৌরহিত্য। শঙ্খ ঘোষের শক্ত শেকড় থেকে যাবে আমাদের সাহিত্য- জমিনে।

লেখক : গবেষক, পরিবেশবিদ।

এইচআর/জেআইএম