বিশেষ প্রতিবেদন

বরগুনার আদালতে ২৪ হাজার মামলা : নিঃস্ব হচ্ছেন বিচারপ্রার্থীরা

বরগুনা সদর উপজেলার ফুলঝুড়ি ইউনিয়নের পশ্চিম গুদিঘাটা গ্রামের নব্বই বছরের বৃদ্ধ ইয়াসিন মৌলভী। জমি-জমা সংক্রান্ত একটি মামলার বিবাদী হওয়ায় সকালের ঠাণ্ডা বাতাস উপেক্ষা করে গায়ে চাদর মুরিয়ে সাত সকালে উপস্থিত হয়েছেন আইনজীবীর অফিসে। সেখান থেকে এসেছেন বরগুনা জেলা ও দায়রা জজ আদালত প্রাঙ্গণে।ইয়াসিন মৌলভীর আদালতে এটি প্রথম আসা নয়। জমি-জমা সংক্রান্ত এই দেওয়ানি মামলাটির কারণে বর্ষার প্রচণ্ড ঝড়-বৃষ্টি, গ্রীষ্মে খরতাপ আর শীতের হিমেল হাওয়াকে উপেক্ষা করে দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে মামলার প্রত্যেক তারিখেই আদালত প্রাঙ্গণে উপস্থিত হন তিনি।বৃদ্ধ ইয়াসিন মৌলভী জাগো নিউজকে জানান, বার্ধক্যজনিত কারণে তিনি এমনিতেই অসুস্থ। তার উপর এই মামলা যেন গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে।তিনি আরো জানান, জমি-জমা সংক্রান্ত এই মামলাটির কারণে তিনিসহ এই মামলার অন্য ১৭ জন বিবাদী এভাবেই গত ১৫ বছর ধরে মামলার প্রত্যেক তারিখে খুব সকালে হাজির হন আদালত প্রাঙ্গণে। তিনি জানান, ২০০১ সালে মামলাটি দায়ের করার নয় বছর পর ২০০৯ সালে মামলার বাদী জহিরুল হক সানু মৃত্যুবরণ করেন। বাদীর মৃত্যুর পর দীর্ঘ সাত বছর পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত মামলার কোনো কূল-কিনারা হয়নি। এসময় তিনি আক্ষেপ করে বলেন, তার জীবদ্দশায় এ মামলার রায়ও দেখে যেতে পারবেন না তিনি।শুধু ইয়াসিন মৌলভীই নয়, বরগুনার ছয়টি উপজেলার বিভিন্ন এলাকার লক্ষাধিক বিচারপ্রার্থী এভাবেই বছরের পর বছর ন্যায় বিচারের আশায় ঘুরে বেড়ান বরগুনার বিভিন্ন আদালত প্রাঙ্গণে।আদালত সূত্রে জানা গেছে, বরগুনার বিভিন্ন আদালতে ২৪ হাজারেরও বেশি মামলা বিচারাধীন আছে। এর মধ্যে দেওয়ানি মামলা রয়েছে আট হাজার ৯৮৬টি, দায়রা জজ আদালতে রয়েছে ৫৬১টি, অতিরিক্ত দায়রা জজ আদালতে রয়েছে ২৮৮টি, যুগ্ম জেলা জজ প্রথম আদালতে ১৩৮টি, যুগ্ম জেলা জজ ২য় আদালতে রয়েছে ১৫১টি মামলা।চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে রয়েছে ৬৫৪টি, অতিরিক্ত চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে রয়েছে ২৩৪টি, সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত-বরগুনায় রয়েছে দুই হাজার ৭১টি, সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত-আমতলীতে রয়েছে চার হাজার ১৬৪টি, সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত পাথরঘাটায় রয়েছে দুই হাজার ৫০৩টি মামলা। আর জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত বরগুনা-১ এ রয়েছে ৯৩৫টি, জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত বরগুনা-২ এ রয়েছে ৬৭৬টি, জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত বরগুনা-৩ এ রয়েছে ২৬০টি এবং জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত বরগুনা-৪ এ রয়েছে ১০৩টি মামলা।এছাড়াও, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইবুনালে রয়েছে দুই সহস্রাধিক মামলা। মামলার এমন জটের কারণে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে বিচারপ্রার্থীদের।গত মঙ্গলবার আদালত পাড়ায় গিয়ে দেখা যায়, বিভিন্ন এলাকার শত শত বিচারপ্রার্থীর ভিড়। অনেকে আবার আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলছেন রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে। মামলার জট ও বিচারক না থাকার কারণে অনেকে আবার পরবর্তী তারিখ জেনে তরি-ঘরি করে ফিরছেন বাড়িতে। বরগুনার আমতলী উপজেলার কুকুয়া ইউনিয়নের হরিমৃত্যুঞ্জয় গ্রামের বাসিন্দা মো. সোবাহান পেয়াদা (৬০) জাগো নিউজকে জানান, একটি মিথ্যা চাঁদাবাজির মামলায় গত চার বছর ধরে মামলার প্রত্যেক তারিখে হাজিরা দিতে হরিমৃত্যুঞ্জয় গ্রাম থেকে খরস্রোতা পায়রা নদী পাড়ি দিয়ে দীর্ঘ ২০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে আদালতে হাজিরা দিচ্ছেন তিনি। এসময় তিনি বলেন, একবার হাজিরা দিতে এলে যাতায়াত ভাড়া ও আইনজীবীসহ দেড় হাজার টাকা খরচ হয় তার।তালতলী উপজেলার নিদ্রাসখিনা গ্রামের বাসিন্দা কাসেম আলী (৫০) জাগো নিউজকে জানান, নিদ্রাসখিনা থেকে সকালে রওনা দিয়ে আদালতে যথা সময়ে উপস্থিত হওয়া যায় না। তাই মামলার তারিখের আগের দিন বিকেলে বরগুনা শহরে এসে হোটেলে থাকতে হয় তাকে। তিনি আরো বলেন, হোটেলে থাকা-খাওয়া এবং যাতায়াত খরচসহ প্রত্যেক তারিখে তার দুই হাজার টাকারও বেশি খরচ হয়। এসময় তিনি বলেন, এক মাস পর তাকে আবার হাজিরা দিতে আসতে হবে।গত সাড়ে চার বছর ধরে তার এই আসা যাওয়া চলছে। কিন্তু তার এই মামলা অল্প সময়ের মধ্যে নিষ্পত্তির কোনো লক্ষণ দেখছেন না বলেও জানান তিনি।বরগুনার একাধিক আইনজীবী ও বিচারপ্রার্থীরা জাগো নিউজকে জানান,বিচারক সঙ্কট এবং মামলার জটের কারণে সাক্ষ্যগ্রহণ না হওয়ায় শত শত মামলার বিচারপ্রার্থীদের আদালতে হাজিরা দিয়ে ফিরে যেতে হচ্ছে। এতে একদিকে যেমন বিচার প্রার্থীরা হয়রানির শিকার হচ্ছেন। পাশাপাশি তারা অর্থিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।আদালতগুলোতে দেওয়ানি মামলার জট সম্পর্কে বরগুনা পৌরসভার সাবেক মেয়র ও জেলা বার অ্যাসোসিয়েশনের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী অ্যাডভোকেট মো. শাহজাহান জাগো নিউজকে জানান, বিচারক সঙ্কটসহ দেওয়ানি মামলায় যথাযথভাবে নোটিস জারি না করার কারণে বরগুনার আদালতগুলোতে মামলার জট বেঁধেছে।এ কারণে একটি মামলার বিচার কাজ দীর্ঘদিন চলার পরও যদি মামলার বিবাদীদের মধ্য থেকে একজন বিবাদী আদালতে দাবি করেন, যে তার বিরুদ্ধে নোটিস জারি হয়নি।তাহলে শুরু থেকে আবার এই মামলার বিচার কাজ শুরু করতে হয়।এসময় তিনি উদাহারণ টেনে বলেন, একটি দেওয়ানি মামলা দায়ের করার পরে আদালতে প্রোসেস সার্ভেয়ার মামলার বিবাদীদের বিরুদ্ধে নোটিস জারি করেন। নোটিস জারির পর প্রোসেস সার্ভেয়ারের কাজ হচ্ছে, ওই মামলায় প্রত্যেক বিবাদীর বাড়িতে গিয়ে তাদের বিরুদ্ধে যে নোটিস জারি হয়েছে তা জানানো এবং মামলার একটি কপি দিয়ে প্রত্যেক বিবাদী যে নোটিস জারির খবর পেয়েছেন, এই মর্মে তাদের প্রত্যেকের কাছ থেকে স্বাক্ষর নেওয়া হয়।তিনি বলেন, নোটিস জারির খবর বিবাদীদের কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্য সরকার কর্তৃক দেয়া নামেমাত্র খরচে সংকুলান করতে পারেন না একজন প্রোসেস সার্ভেয়ার। এ কারণেই তিনি অসৎ উপায় অবলম্বন করে, যথাযথভাবে নোটিস জারি না করার কারণে, একটি মামলার বিচার কাজ দীর্ঘদিন চলার পরও মামলার বিবাদীদের মধ্য থেকে যদি একজন বিবাদী আদালতে আবেদন করেন, যে তার বিরুদ্ধে নোটিস জারি করা হয়নি, তাহলে ওই বিবাদীর আবেদনের প্রেক্ষিতে এই মামলার বিচার কাজ আবার শুরু করতে হয়। মামলার জটের ক্ষেত্রে এই কারণটিকে তিনি বিশেষভাবে দায়ি করেন।অ্যাডভোকেট শাহজাহান আরো বলেন, বরগুনার সিনিয়র সহকারী জজ আদালতে গত পাঁচ বছর ধরে কোনো বিচারক ছিলেন না। কিন্তু অন্য আদালতের বিচারক এই আদালতের ভারপ্রাপ্ত বিচারক হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন। কিন্তু নিজের আদালতের কোর্টের বিচার কাজ পরিচালনা করে তার পক্ষে ওই আদালতের বিচার পরিচালনা করা সম্ভব হয়না। এছাড়াও বরগুনার যুগ্ম জেলা জজ আদালতে দুটি পদ থাকা সত্বেও দীর্ঘদিন ধরে সেখানে কোনো বিচারক ছিলেন না। তবে সম্প্রতি  একজন বিচারক যোগদান করেছেন। দীর্ঘদিন ধরে বিচারক না থাকার কারণে মামলার জট বেঁধেছে বলেও মনে করেন তিনি।তিনি আরো বলেন, দেওয়ানি মামলার ক্ষেত্রে মামলার বাদী-বিবাদী এবং আইনজীবীদের মধ্যেও ত্রুটি রয়েছে।তিনি বলেন, দেওয়ানি মামলার ক্ষেত্রে আইনজীবীদের যেভাবে প্রস্তুতি গ্রহণ করে মামলা পরিচালনা করা উচিত তারা সেভাবে মামলা পরিচালনা করেন না।এজন্য একটি দেওয়ানি মামলায় দীর্ঘ সময় লেগে যায়।এছাড়াও একজন আইনজীবীর একই সময় আদালতে দুটি মামলা থাকার কারণে, দেওয়ানি মামলায় তিনি সময় প্রার্থনা করেন।এ কারণে মামলাগুলো পিছিয়ে পড়ে।আর এসব কারণেও দেওয়ানি মামলাগুলোতে জট বেঁধেছে বলে মনে করেন তিনি।আদালতগুলোতে ফৌজদারি মামলার জট সম্পর্কে বরগুনা জেলা বার অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট মো. কামরুল আহসান মহারাজ জাগো নিউজকে জানান, নিজস্ব ভবন, এজলাস ও জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট সঙ্কট, কিছু কিছু আইনজীবীর আন্তরিকতার ঘাটতি, সময় মতো সাক্ষী হাজির না করা, তদন্তকারী কর্মকর্তা ও চিকিৎসকদের বদলি অথবা তাদের অবসরে যাওয়া ও আন্তরিকতার অভাবসহ নানা কারণে এ জট কমছে না বলে মনে করেন তিনি। মামলার জট দ্রুত সময়ের মধ্যে কমিয়ে আনার ব্যাপারে অ্যাডভোকেট মো. শাহজাহান বলেন, বরগুনায় বিচারকদের শূন্য পদগুলো দক্ষ এবং মেধাবী বিচারক দ্বারা পূরণের পাশাপাশি দক্ষ আইনজীবী তৈরি করা গেলে মামলার জট দ্রুত সময়ের মধ্যে কমিয়ে আনা সম্ভব। এছাড়াও বিচার প্রার্থনার ক্ষেত্রে মামলার বাদী-বিবাদী-সাক্ষী প্রত্যেকে স্বচ্ছ হলে, বিচারাধীন মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পতি করা সম্ভব বলে মনে করেন তিনি।বরগুনার সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট সঞ্জীব দাস জাগো নিউজকে জানান, বরগুনার আদালতগুলোতে ৩১ জনের মতো পিপি ও এপিপি রয়েছে। কিন্তু তাদের মধ্যে কোনো সমন্বয় নেই। তিনি আরো বলেন, জমি নিয়ে বিরোধ এবং নারী নির্যাতন নিয়ে মামলা বেশি হচ্ছে। কিন্তু সেই হারে বিচারক নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে না। এতে মামলার জট হচ্ছে বলে তিনি মনে করেন।এমএএস/আরআইপি

Advertisement