করোনাভাইরাস সংক্রমিত রোগীদের চিকিৎসার জন্য রংপুরে এক বছরেও তেমন একটা বাড়েনি আইসিইউ (ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট) বেড। শুরুতে ২৬টি বেড দিয়ে বিভাগের আট জেলার করোনা আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসাসেবা চললেও দ্বিতীয় টেউ মোকাবিলায় মাত্র ১৩টি বেড বাড়ানো হয়েছে।
Advertisement
তবে, রোগীর স্বজনসহ বিশিষ্টজনরা বলছেন, একটা বিভাগে করোনা আক্রান্ত মুমূর্ষু রোগীদের চিকিৎসা সেবার জন্য এই সংখ্যা একেবারেই অপ্রতুল। দ্রুত আইসিইউ বেড বাড়ানোর দাবি জানিয়েছেন তারা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, গতবছরের এপ্রিলে রংপুর নগরীর পুরাতন সদর হাসপাতাল সংলগ্ন ডেডিকেটেড করোনা আইসোলেশন হাসপাতালে ১০টি এবং ওই সময়ে দিনাজপুর এম. আব্দুর রহিম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১৬টি বেড স্থাপনের মধ্যদিয়ে করোনা রোগীদের আইসিইউ সুবিধা দেয়া শুরু হয় এই বিভাগে। স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে রংপুরের ডেডিকেটেড করোনা আইসোলেশন হাসপাতালে ৫০টি আইসিইউ বেড স্থাপনের বরাদ্দ দিলেও প্রথম পর্যায়ে ১০টি স্থাপনের পর থেমে যায় বাকিগুলোর কাজ। একবছর পর আবার করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ায় আইসিইউ বেড বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। ফলে মাত্র ১৩টি বেড বাড়ানো হয় নগরীতে। এদিকে, বিভাগে প্রতিদিন করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। সংক্রমণের সঙ্গে বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যাও। যতই দিন যাচ্ছে ততই করোনার চিকিৎসা সেবা নিয়ে শঙ্কিত হচ্ছেন আক্রান্ত রোগীরা।
স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, বিভাগের আট জেলার করোনা রোগীদের জন্য ৩৯টি আইসিইউ বেড রয়েছে। এরমধ্যে দিনাজপুরের এম. আব্দুর রহিম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১৬টি, রংপুর ডেডিকেটেড করোনা আইসোলেশন হাসপাতালে ১০টি, রংপুরের কমিউনিটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে একটি ও প্রাইম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দুইটি এবং রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১০টি বেড রয়েছে। এছাড়া পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, নীলফামারী, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধায় সরকারি বা বেসরকারিভাবে করোনো রোগীদের চিকিৎসায় কোনো আইসিইউ সুবিধা নেই। বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালকের কার্যালয় সূত্র জানায়, রংপুর বিভাগের আট জেলায় বিশেষায়িত ১২টি হাসপাতাল রয়েছে। এসব হাসপাতালে করোনা আক্রান্ত রোগীদের জন্য আইসোলেশন ওয়ার্ডে ৫০৬টি বেড রয়েছে। ৫০৬ শয্যার মধ্যে রংপুর ডেডিকেটেড করোনা আইসোলেশন হাসপাতালে ১০০টি, রংপুর বক্ষব্যাধি হাসপাতালে ২০, হারাগাছ হাসপাতালে ৩১টি, দিনাজপুরে এম আব্দুর রহিম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৫০টি, পঞ্চগড় আধুনিক সড়ক হাসপাতালে ২০, নীলফামারীর ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালে ১০০টি, কুড়িগ্রামে ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে ৫০টি, ঠাকুরগাঁও আধুনিক সদর হাসপাতালে ৫০টি, গাইবান্ধা জেনারেল হাসপাতালে ২০টি, লালমনিরহাট নার্সিং কলেজে ১২টি, লালমনিরহাট রেলওয়ে হাসপাতালে ১৫ এবং লালমনিরহাট সরকারি কলেজের মহিলা হোস্টেলে ৬৪টি বেড রয়েছে।
Advertisement
বিভাগের ৫৮ উপজেলার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোকে করোনা রোগীর প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়ার জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এরমধ্যে রংপুর ডেডিকেটেড করোনা আইসোলেশন হাসপাতালে বেড সংখ্যা ১০০ থেকে বাড়িয়ে ১৫০টি করা হচ্ছে।
করোনার দ্বিতীয় টেড শুরুর পর চলতি বছরের মার্চ মাসের শেষ দিকে সংক্রমণের হার বাড়তে থাকে এই বিভাগে। স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, গত ছয় দিনে (১৫ এপ্রিল-২০ এপ্রিল) করোনায় আক্রান্ত হয়ে রংপুর বিভাগে আটজন মারা গেছেন। এরমধ্যে শুক্রবার একদিনেই মারা গেছেন চারজন। এ ছয় দিনে আক্রান্ত হয়েছেন ৩৮৫ জন।
মঙ্গলবার (২০ এপ্রিল) পর্যন্ত দিনাজপুরে সবচেয়ে বেশি পাঁচ হাজার ২৩১ এবং রংপুরে ৪ হাজার ৪৭৮ জন আক্রান্ত হয়েছেন। আক্রান্তের সংখ্যার দিক থেকে সবচেয়ে কম লালমনিরহাট। এ জেলায় আক্রান্ত হয়েছেন এক হাজার ২৭ জন।
গতবছরের ৮ এপ্রিল থেকে চলতি বছরের ২০ এপ্রিল পর্যন্ত বিভাগের আট জেলায় করোনা শনাক্ত হয়েছে ১৭ হাজার ৪৩০ জন। এখন পর্যন্ত মারা গেছেন ৩৩১ জন। সুস্থ হয়েছেন ১৬ হাজার ৮০ জন। স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, গত ২৪ ঘণ্টায় (মঙ্গলবার ২০ এপ্রিল) একদিনে ৩৮৩ জনের নমুনা পরীক্ষা করে নতুন করে ৬৩ জন করোনা আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছেন।
Advertisement
বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক কার্যালয় সূত্র আরও জানায়, মঙ্গলবার পর্যন্ত দিনাজপুুর জেলায় পাঁচ হাজার ২৩১ জন আক্রান্ত ও ১১৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। রংপুর জেলায় চার হাজার ৪৭৮ জন আক্রান্ত ও ৭৭ জনের মৃত্যু হয়েছে এবং ঠাকুরগাঁও জেলায় এক হাজার ৬১৭ জন আক্রান্ত হয়েছেন, মারা গেছেন ৩৫ জন। গাইবান্ধা জেলায় এক হাজার ৬৫৪ জন আক্রান্ত ও ২১ জনের মৃত্যু, নীলফামারী জেলায় এক হাজার ৪৯৪ জন আক্রান্ত ও ৩৩ জনের মৃত্যু। কুড়িগ্রাম জেলায় এক হাজার ১০৭ জন আক্রান্ত ও ১৭ জনের মৃত্যু, লালমনিরহাট জেলায় এক হাজার ২৭ জন আক্রান্ত ও ১২ জনের মৃত্যু, পঞ্চগড় জেলায় ৮২২ জন আক্রান্ত এবং ২০ জনের মৃত্যু হয়েছে।
এ ব্যাপারে রংপুর ডেডিকেটেড করোনা আইসোলেশন হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. এস.এম নূরুন নবী জানান, এখানে ১০টি আইসিইউ বেড রয়েছে। মঙ্গলবার পর্যন্ত সেখানে সাতজন এবং সাধারণ বেডে ৪৫ জন রোগী চিকিৎসাধীন রয়েছেন। এছাড়া রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১০টি করোনা আইসিইউ বেড প্রস্তত রাখা হয়েছে।
তিনি বলেন, পরিস্থিতি মোকাবিলায় আইসিইউ বেড বাড়ানোর বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।
রংপুর করোনা প্রতিরোধ কমিটির আহ্বায়ক অধ্যক্ষ ফখরুল আনাম বেঞ্জু বলেন, রংপুর বিভাগে করোনা রোগীদের সংখ্যা বাড়ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যা। এজন্য আইসিইউ সুবিধা বাড়ানো প্রয়োজন। বর্তমান সংকট মোকাবিলার জন্য বিভাগীয় নগরীতে ২৩টি আইসিইউ বেড পর্যাপ্ত না। রংপুর বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. আহাদ আলী জানান, গতবছর রংপুর ডেডিকেটেড করোনা আইসোলেশন হাসপাতালে ৫০টি আইসিইউ বেড বরাদ্দ দেয় স্বাস্থ্য বিভাগ। প্রাথমিকভাবে ১০টি বেড প্রস্তুত করা হয়। তবে করোনা সংক্রমণ ও ঝুঁকি বেশি একটা না থাকায় বাকি বেডগুলো স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়নি। তিনি বলেন, সম্প্রতি করোনা আক্রান্তের সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। অনেক আক্রান্ত রোগী আসছেন হাসপাতালগুলোতে। ফলে আইসিইউ বেডের সংকট সৃষ্টি হচ্ছে। আইসিইউ বেডের বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।
রংপুর ডেডিকেটেড করোনা আইসোলেশন হাসপাতালে শয্যা ১০০ থেকে বাড়িয়ে ১৫০ করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে বলেও জানান স্বাস্থ্য পরিচালক।
জিতু কবীর/এসআর/জিকেএস