ইরানী বিশ্বাস
Advertisement
বিশ্বজুড়ে মহামারি করোনার তাণ্ডব চলছে। ডিসেম্বর ২০১৯ সালে সৃষ্ট এই করোনাভাইরাস এখনো তার তাণ্ডব চালিয়ে যাচ্ছে। উন্নত প্রযুক্তি, উন্নত মস্তিষ্ক থাকা সত্ত্বেও এখনো বিজ্ঞানীরা বের করতে পারেনি কিসে তার বিনাশ। কি তার প্রতিকার! কেবল এটুকুই বুঝছি, করোনার অন্যতম ওষুধ অক্সিজেন। যে অক্সিজেন আমরা নিজেরাই প্রতিনিয়ত নিঃশেষ করেছি। করোনা দ্বিতীয় ঢেউ আরো ভয়াবহতা নিয়ে ফিরে এসেছে। আবিষ্কৃত হয়েছে প্রতিষেধক টিকা। চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা বলেছেন, এই টিকা করোনার জন্য আংশিক ঝুঁকিমুক্ত। টিকার চেয়েও এই মুহূর্তে সবচেয়ে কার্যকরী মহাঔষধ অক্সিজেন।
১৬ কোটি মানুষের বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর অন্যতম। আয়তনের তুলনায় বাংলাদেশের জনসংখ্যা অধিক। যে কারণে বসতি স্থাপনের জন্য প্রতিনিয়ত বনভূমি উজাড় করা হচ্ছে। সবশেষ ২০১৭ সালে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের জন্য বাংলাদেশের বনভূমি নষ্ট করা হয়েছে। এছাড়াও লোকসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে মানুষের জন্য বসতি গড়তে যেমন বনভূমি ধ্বংস করা হয়েছে, তেমনি তাদের রান্নার কাজেও দ্বিগুণ পরিমাণ বনভূমি ধ্বংস হয়েছে। ফলে বাংলাদেশের বর্তমান চিত্র বিপদজনক।
বিশ্বের করোনার দ্বিতীয় ঢেউ বাংলাদেশেও এসেছে, যা ২০২০ সালের মার্চের শেষ সপ্তাহের করোনার চেয়ে দ্বিগুণ শক্তিশালী হয়ে ফিরে এসেছে। সরকারি হিসেব অনুযায়ী এখন বাংলাদেশে প্রতিদিন শতক ছুঁয়েছে মৃতু্যূর সংখ্যা। করোনা আক্রান্ত স্বজনদের কথা মনে পড়লে যে করুন চিত্র ভেসে ওঠে, তা হলো নিঃশ্বাস নেওয়ার আকুতি। একটি নিঃশ্বাস টেনে নিতে অক্সিজেনের জন্য কি মিনতি। সারা জীবনের সঞ্চয়ের বিনিময়েও মিলছে না জীবন রক্ষাকারী অক্সিজেন। হাসপাতালে চলছে অক্সিজেন চেয়ে মাতম। স্বজনের চোখে অসহায় দৃষ্টি এক সিলিন্ডার অক্সিজেনের জন্য। করোনা রোগীর শেষ পরিণতি মনে করিয়ে দেয় অর্থ-বিত্ত বৈভব আসলে কিছুই না। একটি নিঃশ্বাস পৃথিবীতে বেঁচে থাকার জন্য সবচেয়ে দামি। অথচ প্রকৃতির দান অক্সিজেন আমরা প্রতিনিয়ত নষ্ট করে চলছি। আমরা নিজেদের নিঃশ্বাসে নিজেরাই কার্বন দিচ্ছি প্রতিনিয়ত।
Advertisement
বিজ্ঞানীরা বলেছেন, এই পৃথিবী মোট ১৩ বার ধ্বংসের মুখোমুখি হয়েছে। এরপর আবার সেখানে জীববৈচিত্র্যে ভরে গিয়েছে। এতবার পৃথিবী ধ্বংস হওয়ার মূল কারণ হল জলবায়ু পরিবর্তন। জলবায়ু পরিবর্তন মানব সমাজের জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিক থেকে পৃথিবীর ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা ০.৩ থেকে ০.৬০ সেলসিয়াস বেড়ে গিয়েছে। এই বৃদ্ধির পরিমাণ আপত দৃষ্টিতে কম মনে হলেও এর ফলে বিপর্যয় ঘটার আশঙ্কা অনেক। পৃথিবী সূর্য থেকে শক্তি গ্রহণ করে যার দ্বারা ভূপৃষ্ঠ উত্তপ্ত হয়। এই শক্তি বায়ুমণ্ডলের মধ্য দিয়ে আসার সময় ৩০ শতাংশের মতো ছড়িয়ে যায়। এই শক্তির কিছুটা আবার ভূপৃষ্ঠ ও সমুদ্রতল থেকে প্রতিফলিত হয়ে আবার বায়ুমণ্ডলে ফিরে যায়। বায়ুমণ্ডলের কিছু গ্যাস পৃথিবীর চারপাশে কম্বলের মতো আঁকড়ে থেকে এই শক্তি শোষণ করে।
এটাই গ্রিন হাউস গ্যাস। প্রথম গ্রিন হাউস এফেক্ট আবিষ্কার করেন ফরাসি বিজ্ঞানী জঁ ব্যপ্টিস্টে ফুরিয়ার। ধীরে ধীরে পৃথিবীতে মানুষ বাড়ছে। চাহিদা মেটাতে নানান ধরনের কাজ করছে। ফলে পৃথিবীর সৃষ্টির সময়ের এই গ্রিন হাউস গ্যাসের চাদর ক্রমশ মোটা হচ্ছে এবং স্বাভাবিক গ্রিন হাউস এফেক্টের পথে বাধা সৃষ্টি করছে। কয়লা, তেল এবং প্রকৃতিক গ্যাস পোড়ালে কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গত হয়। যত বেশি গাছ কাটা হয়, ততই গাছে জমে থাকা কার্বন বাতাসে মিশে যায় কার্বন ডাই অক্সাইড হিসেবে। ক্রমবর্ধমান কৃষিকাজ, ভূমি ব্যবহারের ধরণ ও অন্যান্য ক্রিয়াকাণ্ড আমাদের পরিবেশে মিথেন ও নাইট্রাস অক্সাইডের মাত্রা ক্রমশ বাড়িয়ে দিচ্ছে। শিল্প সংক্রান্ত সিএফসির মতো কৃত্রিম গ্রিন হাউস গ্যাস বাতাসে ছড়িয়ে দিচ্ছে। গাড়ির ধোঁয়া থেকে বাতাসে ওজোনের পরিমাণও বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশ্ব উষ্ণায়ন এবং জলবায়ুর পরিবর্তনের অন্যতম কারণ এই ক্রমবর্ধমান গ্রিন হাউস এফেক্ট।
দুই.খাদ্যের চাহিদা ক্রমশ বাড়ছে। ফলে প্রকৃতিক সম্পদের উপর ক্রমশ চাপ বাড়ছে। অধিক ফসলের আশায় কৃষিকাজে ব্যবহৃত হচ্ছে কীটনাশক, রাসায়নিক সার। ফলে জলবায়ুর উপর পরোক্ষ প্রভাব পড়ছে। জলবায়ুর এই পরিবর্তন বৃষ্টিপাতের ধারা পরিবর্তন করে বন্যা ও খরার প্রকোপ বাড়াচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে, গ্লেসিয়ার ও মেরুর বরফ-চাদর আরও বেশি করে গলে যাবে। ফলে সমুদ্রের জলস্তর বাড়বে। বিগত কয়েক বছরের সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছাস জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব।
বিশ্বায়নের এই যুগে মানুষ এবং প্রকৃতি যেন একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী। মানুষ নিজেকে আধুনিক জীবনে অভ্যস্থ করতে ব্যস্ত প্রতিনিয়ত। অনুন্নত দেশগুলির মানুষও এখন ফ্রিজ, এসি ছাড়া জীবন কল্পনা করতে পারছে না। এছাড়াও আছে উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার ও আবিষ্কার। আধুনিক চিকিৎসা এখন মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে অনেকদিন। অতীতের তুলনায় মানুষের মৃত্যুহার কমেছে। সৃষ্টির অন্যতম সেরা আবিষ্কার হিসেবে, মানুষের শরীরের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আবিষ্কৃত হয়েছে। আবিষ্কারের ঝুলিতে প্রতিনিয়ত সংযোজন হচ্ছে কঠিন থেকে কঠিনতম বিষয়। মানুষের বিকল্প রোবট তৈরি করা হয়েছে। একটি যন্ত্র দিয়ে প্রত্যহিক জীবনের সকল চাহিদা পূরণ করছে। এ সবই মানুষের অকৃত্রিম প্রচেষ্টার ফসল। আবিষ্কারের নেশায় যেন মেতে উঠেছে মানুষ।
Advertisement
কিন্তু মানুষ একবারও ভাবেনি, আধুনিক জীবনযাত্রাই, সবচেয়ে বড় কাল হয়ে দাঁড়াবে। প্রযুক্তির ব্যবহার প্রতিনিয়ত পৃথিবীর বাতাসে ক্ষতিকারক গ্যাস জমা করছে। ফলে কোন ঠাসা হয়ে পড়ছে জীবন রক্ষাকারী অক্সিজেন। আধুনিক জীবন গড়তে গিয়ে মানুষ নিজেদের জীবনকে সংকটময় করে তুলছে। পৃথিবীতে তিনভাগ জল আর একভাগ স্থল। এই স্থল ভাগের দুইভাগ ছিল বনভূমি আর একভাগে পাহাড়-পর্বত-উপত্যকা। লক্ষ লক্ষ বছর আগে এক জরিপে দেখা গেছে, পৃথিবীতে এই অংশ কমে ষাট শতাংশে নেমে এসেছে। বর্তমানে মানুষের নির্দয়তার জন্য জীবনরক্ষাকারী বনভূমি কেটে উজাড় করে দিচ্ছে। ফলে জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে। পৃথিবী তার স্বাভাবিক নিয়ম হারাচ্ছে। প্রকৃতিতে বিরূপ প্রভাবের ফলে হারাচ্ছে নিজস্ব রূপ।
উন্নত অনেক দেশের কথা বাদ দিলাম। বাংলাদেশের মোট আয়তনের সাড়ে ১৩ শতাংশ বনভূমি।ঋতু বৈচিত্র্যের বাংলাদেশ। অথচ কয়েক বছর ধরে নাতিশীতোষ্ণ এই দেশে ঋতু পালাবদল হচ্ছে না। শীতের দিনে শীত নেই, বৃষ্টির সময় নেই বৃষ্টি। বসন্তে এখন আর শীতল পরশ নেই। শীত শেষে প্রচণ্ড গরমে অতিষ্ঠ মানুষ। প্রকৃতি তার অসামাঞ্জস্য রূপ আমাদের বার বার সতর্ক করেছিল। আমরা বুঝতে পারিনি, প্রকৃতি মানুষের প্রতি রুষ্ঠ। প্রকৃতিকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে বারবার নিজেদের অপ্রতিরোধ্য প্রমাণের চেষ্টা করেছে মানুষ। অপরাজেয় শক্তি হিসেবে প্রমাণ করতে চেষ্টা করেছে সবসময়। প্রকৃতি শ্বাশ্বত। সে কাউকে ক্ষমা করে না। বিজ্ঞানীরাই আবিষ্কার করেছিল বিশ্ব উষ্ণায়ন মানুষের স্বাস্থ্যে সরাসরি প্রভাব ফেলবে।
প্রতিদিন খবরের কাগজ থেকে শুরু করে টেলিভিশন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সবখানে মৃত্যুর খবর। এত মৃত্যুর শোক, প্রিয়জন হারানোর ভয় প্রতিনিয়ত তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে সকলকে। চারপাশে মানুষের মরণ যন্ত্রণা আমাকে কেবলই বিবেক যন্ত্রণা দিচ্ছে। মনে হচ্ছে আমরা সভ্যতার নামে প্রকৃতির সাথে রূঢ় আচরণ করেছি। হয়তো হাজার বছরের মানুষের কর্মফল, প্রকৃতি প্রতিশোধ নিচ্ছে। আসুন নিজের ক্ষতির কথা, প্রিয়জনের কথা ভেবে, আগামী প্রজন্মের জন্য একটি সুন্দর পৃথিবী গড়ে যাবো এই প্রতিজ্ঞা করি। প্রিয়জনের নিঃশ্বাসের প্রতিদানে প্রকৃতিকে সবুজে ভরিয়ে দেই। ফেরত দেই প্রিয়জনের প্রিয়জনের নিঃশ্বাসের প্রতিদান।
লেখক : সাংবাদিক, নাট্যকার ও নাট্যপরিচালক।
এইচআর/এমকেএইচ