হঠাৎ করে বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণ সংখ্যায় বিস্ফোরণ ঘটে গেছে। যে গতিতে বেড়ে চলেছে তাকে কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে তা নিয়ে দিশেহারা সব মহলই। করোনা সংক্রমণের দ্বিতীয় ধাপে গত কয়েকদিন ধরে বাংলাদেশে মানুষের মৃত্যুর তালিকা লম্বা হয়ে যাচ্ছে। প্রতিদিন মৃত্যু পরোয়ানা নিয়ে মানুষের দুয়ারে হাজির হচ্ছে প্রাণঘাতী করোনা। দৈনিক মৃত্যু সংখ্যায় শতাধিক ছাড়িয়ে গেছে। আর সর্বমোট মৃত্যু দশ হাজার ছাড়িয়েছে। আঁতকে উঠেছে দেশের মানুষ। করোনা সংক্রমণে মৃত্যুর ভয় সবাইকে জড়োসড়ো করে ফেলেছে। পরিস্থিতি দিন দিন যতো এগুচ্ছে; ততোই জটিল হচ্ছে।
Advertisement
এবারের দ্বিতীয় ঢেউ তরুণ প্রজন্মের জন্য দুঃসংবাদ বয়ে এনেছে। সমাজের শৌর্য-বীর্যের প্রতীক তরুণ প্রজন্মকে এতদিন মোটামুটি সুরক্ষিত ভাবা হলেও এখন বাস্তবতা ভিন্ন। তরুণ জনগোষ্ঠী ব্যাপকভাবে আক্রান্ত হচ্ছে করোনায়। আগের তুলনায় বেশি হাসপাতালের সাপোর্ট লাগছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এবার করোনাভাইরাস আরও ব্যাপক শক্তিতে চাঙা হয়ে ফিরেছে। গতবারের করোনাভাইরাসের বদল ঘটেছে। আর সে পরিবর্তনের ফলে বর্তমানে তরুণ সমাজও করোনার মারণ কামড় থেকে নিরপদ নয়। পাল্টে যাচ্ছে করোনায় মৃত্যুর সমীকরণ। তরুণ প্রজন্মের মধ্যে বেশি হারে আক্রান্ত হওয়াকে এখন বিশ্বব্যাপী বিশেষ উদ্বেগের সাথে দেখা হচ্ছে। তরুণ প্রজন্ম সেকেন্ড ওয়েভ অর্থাৎ সংক্রমণ কমে আসার পর আবার ঊর্ধ্বগতিতে সংক্রমণ বৃদ্ধির জন্য দায়ী হতে পারেন কি-না সে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন বিশেষজ্ঞরা। আইইডিসিআর’র পর্যবেক্ষণ বলছে, বাংলাদেশে আক্রান্তদের মধ্যে প্রায় ৬৯ শতাংশই তরুণ-মধ্যবয়সী। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে ইউকে ভ্যারিয়েন্ট এবং সাউথ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্টের কারণে এমনটি হচ্ছে। আগে ১ জন থেকে ১০ জন সংক্রমিত হলেও এখন ভ্যারিয়েন্টের কারণে ১ জন থেকে ১৬ জন আক্রান্ত হচ্ছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও বলছে, ‘করোনা ভাইরাসের টার্গেট এবার তরুণ প্রজন্ম।’ তরুণ প্রজন্মের মধ্যে সংক্রমণ বাড়ার এই প্রবণতা অব্যাহত থাকলে সামনে বিপদের দিন আসছে বললে ভুল হবে না।
পরিসংখ্যান দিয়ে সতর্ক করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানায়, ‘এতদিন দেখা যাচ্ছিল বিশ্বে বয়স্ক ব্যক্তিরাই সবচেয়ে বেশি শিকার হচ্ছেন মারণ করোনাভাইরাসের সংক্রমণে। কিন্তু সাম্প্রতিককালে দেখা যায়, চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, ইতালি এবং ইউরোপের অন্যান্য দেশে যারা মারা যাচ্ছেন; তাদের মধ্যে বেশিরভাগই কম বয়সী তরুণ প্রজন্ম। তরুণ প্রজন্মই এখন সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির কারণ। এ মারণ ভাইরোসের সংক্রমণ থেকে তিরিশ, চল্লিশ এবং পঞ্চাশের কোঠায় থাকা ব্যক্তিরা আর নিরপদ নন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার টেকনিক্যাল প্রধান মারিয়া ভান কেরাখোভ জানিয়েছেন, ‘আমরা দেখতে পাচ্ছি বর্তমান সময়ে খুব বেশি করে অল্প বয়সীরা এই রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। ধীরে ধীরে আইসিইউতে তরুণদের সংখ্যা বাড়ছে।’ যুক্তরাষ্ট্রের জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা বলছেন, দেশটিতে তরুণ প্রজন্মের আক্রান্ত হওয়ার হার বাড়ছে। সেখানে ফ্লোরিডা, সাউথ ক্যারোলিনা, জর্জিয়া ও টেক্সাসসহ আরও কিছু অঙ্গরাজ্যে তরুণদের বেশি আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা দেখা যায়।
প্রশ্ন উঠেছে, তরুণ প্রজন্মের মধ্যে হঠাৎ করোনাভাইরাসের এই বাড়বাড়ন্তের নেপথ্য কারণ কী? বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিশেষজ্ঞরা জানান, তরুণ প্রজন্মের মধ্যে করোনা বেড়ে যাওয়ার জন্য একদিকে যেমন করোনাভাইাস প্রতিনিয়ত বদল হওয়া দায়ী, তেমনি তরুণ প্রজন্মের মধ্যে সচেতনতার অভাবের বিষয়টিও রয়েছে। গবেষকরা বলেন, করোনায় তরুণরা উদ্বিগ্ন বোধ করছেন না। কারণ তারা দেখছেন যে, আক্রান্ত হলেও তাদের উপসর্গগুলো খুব গুরুতর নয়। তরুণ প্রজন্মের মধ্যে এমন একটা ধারণা তৈরি হয়ে গেছে যে, তাদের উপর এ রোগের তেমন প্রভাব পড়বে না। অনেক সময় তাদের মধ্যে কোন উপসর্গই দেখা যায় না। তারা দেখছে যে, মূলত বয়স্করাই বেশি মারা যাচ্ছেন। সে কারণেই বিষয়টিকে হালকাভাবে নিচ্ছেন তরুণ প্রজন্ম। তরুণরা স্বাস্থ্যবিধি মানছেন কম। তারা যে অন্যদের জন্য ঝুঁকির কারণ, সে বিষয়ে আলাদা করে কোন প্রচারণা না থাকায় সংক্রমণ রোধে নিজেদের দায়িত্বটুকু তারা বুঝতে পারছেন না। এদিকে বাংলাদেশে রাস্তায় নামলে দেখা যায় অনেক তরুণ এখনো গা ঘেঁষাঘেঁষি করে আড্ডা দিচ্ছেন। ঢাকার শপিং মলে ঢোকার জন্য সব সময় দেখা যায় তরুণদেরই লম্বা লাইন। কারো মুখে হয়তো মাস্ক আছে। আবার কারো নেই। কেউ আবার মাস্ক গলায় ঝুলিয়ে রেখেছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তরুণ প্রজন্ম বাইরে বের হন বেশি। তাদের মধ্যে রেকলেস হওয়ার প্রবণতাও বেশি। এবার হয়তো তার ফল ভোগ করতে হচ্ছে।
Advertisement
পরিসংখ্যান বলছে, দক্ষিণ কোরিয়ায় মৃতদের মধ্যে প্রতি ৬ জনের একজনের বয়স পঞ্চাশের কম। বাংলাদেশেও অপেক্ষাকৃত কম বয়সীরাই করোনাভাইরাসে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন। সরকারি সংস্থা রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট আইইডিসিআরের তথ্যমতে, বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে এ পর্যন্ত শনাক্ত ব্যক্তির ৫০ শতাংশেরই বয়স ২১ থেকে ৪০ বছর। স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিসংখ্যান বলছে, দেশে এ পর্যন্ত মারা যাওয়াদের মধ্যে ৬ হাজার ৭৭৪ জনই পুরুষ এবং ২ হাজার ২২০ জন নারী। তাদের মধ্যে ৫ হাজার ৩০ জনের বয়স ৬০ বছরের বেশি। এছাড়া ২ হাজার ২২৭ জনের বয়স ৫১ থেকে ৬০ বছরের মধ্যে। ১ হাজার ১১ জনের বয়স ৪১ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে। ৪৪৪ জনের বয়স ৩১ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে। ১৭৭ জনের বয়স ২১ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে। ৬৭ জনের বয়স ১১ থেকে ২০ বছরের মধ্যে। ৩৮ জনের বয়স ১০ বছরের কম।
গবেষকরা বলেন, ‘তরুণ প্রজন্মের মধ্যে করোনাভাইরাসের যে ঢেউ আজ বয়ে যাচ্ছে, তার জন্য ভাইরাস নয়, তরুণ প্রজন্মই দায়ী। এর আগে আমাদের দেশে যখন করোনাভাইরাসের সংক্রমণ কমে যায়, তখন প্রয়োজন ছিল স্বাস্থ্যবিধি মানার বিষয়ে জোর দেয়া। তখন আমরা সবাই মিলে প্রতিরোধমূলক কার্যক্রমগুলো কমাতে শুরু করি। তরুণ প্রজন্ম এমনিতেই অসতর্ক। করোনা নিয়ে এক ধরনের অবহেলা ও শৈথিল্য তরুণ প্রজন্মের বেশি দেখা গেছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার দাবিও জানিয়ে আসছিলো তরুণ প্রজন্ম। খুলে দিলে কী ভয়াবহ অবস্থা হতো ভাবা যায়? এদিকে লকডাউন ঘোষণা করার পরও খোলা ছিলো তরুণ প্রজন্মের আড্ডাস্থল বইমেলা। ওদিকে যখনই আমাদের দেশের এয়ারপোর্টে টিকা এসেছে, তখনই তরুণরা আরও বেশি সাহস পেয়ে উতলা হয়ে উঠেছে। মনে করেছে যে, কিসের করোনা? তাদের শতভাগ প্রতিরোধ তৈরি হয়ে গেছে। তারা যা ইচ্ছা তাই করতে পারবে। দলবেঁধে কক্সবাজারসহ বিভিন্ন স্থানে বেড়াতে গেছে তরুণ প্রজন্ম। পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে লাখ লাখ তরুণ প্রজন্মের ঢল নামে। কে না জানে, এবার অধিকাংশ সংক্রমণ হয়েছে কক্সবাজার থেকে। দেখে-শুনে মনে হয়, দেশজুড়ে তরুণদের মধ্যে চলমান করোনাভাইরাসের উচ্চ মাত্রার সংক্রমণ নিয়ে কারও তেমন কোনো মাথাব্যথা নেই। করোনা চলছে করোনার মতো করে। তরুণ প্রজন্ম চলছে তাদের মতো খুড়িয়ে খুড়িয়ে। আমরা সবাই মিলে করোনাকে তার নিজের মতো করেই চলতে দিচ্ছি। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ যেন আপন মনে নিজ থেকেই কমে যাবে। এভাবে দেশের তরুণ প্রজন্মের অবহেলা, সরকারের শিথিলতায় করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বাড়ছে তো বাড়ছেই। যার অনিবার্য ফল হিসেবে বর্তমানে একটা ভয়াবহ বিপদের মুখে দাঁড়িয়ে তরুণ প্রজন্মসহ সবাই।
গবেষকরা বলেন, বাংলাদেশে পরিবারের কাঠামোর জন্যও তরুণ প্রজন্মের এতো বেশি হারে সংক্রমণ ঝুঁকির কারণ। বাংলাদেশে কয়টি পরিবার সবার জন্য আলাদা রুমের ব্যবস্থা করতে পারে? বাংলাদেশে এখনো পরিবারগুলোতে বাবা-মা, ভাই-বোন হয়তো অন্য কোন আত্মীয় সবাই মিলে একসাথে থাকেন। হয়তো দুই ভাই বা দুই বোন একরুমে থাকেন। স্বভাবতই তরুণদের কেউ বাইরে আক্রান্ত হলে সে বাড়ি গিয়ে নিজের পরিবার, প্রতিবেশী, আত্মীয়দের সংক্রমিত করছেন। পরিবারে আগে থেকেই কারো হার্ট, কিডনির সমস্যা বা ডায়াবেটিস রয়েছে তাদেরকেও বড় ঝুঁকিতে ফেলছেন। তরুণ প্রজন্ম নিজেরা আক্রান্ত হয়ে করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরীক্ষা ব্যবস্থার উপর চাপ তৈরি করছেন। তাদের কারণেই হয়তো একজন বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিকে আক্রান্ত হয়ে গুরুতর পরিস্থিতিতে হাসপাতালে যেতে হচ্ছে। এতে হাসপাতাল ব্যবস্থার উপরেও চাপ পড়ছে।
যেকোনো মৃত্যুই বেদনার। এর মধ্যে তরুণ বয়সীদের মৃত্যু আরও গভীর ক্ষত সৃষ্টি করে। করোনায় আক্রান্ত হয়ে তরুণদের মৃত্যুর সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে। পরিস্থিতির ভয়াবহতা অনুধাবন করে তরুণ প্রজন্মের আরও সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি। নিজে সুরক্ষিত থেকে পরিবারকেও সুরক্ষা দেবেন তারা। করোনাভাইরাসের রাশ টেনে ধরতে তাই যেকোন কিছুর বিনিময়ে তরুণ প্রজন্মকে ঘরমুখী করা জরুরি। প্রতিবছর প্রায় ২০ লাখ তরুণ-তরুণী বাংলাদেশের চাকরির বাজারে যোগদান করে। এছাড়াও চাকরির বাজারে জড়িয়ে থাকা বিপুল জনগোষ্ঠী এই তরুণ প্রজন্ম। করোনাভাইরাস সংকটে কর্মক্ষেত্রে যাতায়াতে সংক্রমণ নিয়ে উদ্বেগ ও হতাশায় আক্রান্ত এই তরুণ প্রজন্ম। তরুণ প্রজন্মের মধ্যে ব্যাপক হারে সংক্রমণ ও মৃত্যু ঠেকাতে লকডাউনের পরও চাকুরিরত তরুণ প্রজন্ম যাতে বাসায় বসে আগের মতো অনলাইনে কাজের সুযোগ পায়, সেজন্য ডিজিটাল সরকারের স্পষ্ট নির্দেশনা প্রত্যাশিত।
Advertisement
তরুণদের মধ্যে করোনাভাইরাসকে সহজভাবে নেওয়ার কোনো অবকাশ নেই। করোনা প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে তরুণ প্রজন্মের ঢিলেঢালা ভাব ও অসচেতনতার ফলে যেকোনো সময় করোনার সংক্রমণ হু হু করে আরও বেড়ে ভয়াবহ পরিণতি বয়ে আনবে। দ্বিতীয় ধাপে করোনা ভয়, তরুণরা নিরাপদ নয়। এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে করোনাভাইরাসকে এখনই কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাতে হবে। অদৃশ্য শত্রু করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে তরুণ প্রজন্মকে সচেতনতার দুর্গ গড়ে তুলতে হবে। সম্মিলিত শক্তি দিয়ে প্রতিহত ও পরাজিত করতে হবে প্রাণঘাতী করোনাকে।
লেখক: বিজ্ঞান লেখক ও গবেষক, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
এসইউ/এমএস