মতামত

করুণার ভরসায় করোনা!

চরিত্র দ্রুত পাল্টে ফেলে যে, তার সঙ্গে সংসার করাই মুশকিল। এক বছরে ধরেই নিয়েছিলাম এই জগৎ সংসারে যতদিন আছি, করোনার সঙ্গেই তাল মিলিয়ে চলতে হবে। তার যে চরিত্র সেটা মাথায় রেখে নিজে নিতে হবে খাপ খাইয়ে। কিন্তু দশ দিকের গবেষণা ও ধারণা থেকে অদৃশ্য অণুজীবটির যে চরিত্র পাওয়া যাচ্ছে, তাতে নিজেকে কিংবা এই জীবন সংসারকে কীভাবে তার সঙ্গে চলার মতো করে তৈরি করব, এ এক মহাবিভ্রান্তির মধ্যে ঘুরপাক খেতে হচ্ছে।

Advertisement

শুরু থেকে জেনে আসছিলাম অদৃশ্য অণুজীব বাহকের মুখ থেকে নিঃসৃত জলকণা বা ড্রপলেট কোথাও পড়লে, সেখানে যদি আমার হাত পড়ে, সেই হাত নাক বা মুখমণ্ডল দিয়ে আমার ভেতরে প্রবেশ করে। অতএব সাবান দিয়ে কিছুক্ষণ পরপর হাত ধোও, কোথাও কিছু স্পর্শ করলে স্যানিটাইজার দাও হাতে বা ড্রপলেট পড়েছে এমন সন্দেহজনক জায়গা জীবাণুমুক্ত করো। বাইরে থেকে এসে শরীর ধুয়ে নেয়া, কোনো পণ্য এনে কিছু সময় বাইরে রাখা, এই নিয়মগুলো অনুসরণ করে আসা হচ্ছিল।

ধীরে ধীরে বিজ্ঞানী বা গবেষকরা এখানে এসে পৌঁছালেন যে- মাস্ক ঠিকভাবে পরা, দূরত্ব বজায় রাখা এবং নিয়মিত হাত পরিষ্কার রাখলে করোনাকে দূরে রাখা অনেকটাই সম্ভব। কিন্তু এখন এসে একাধিক গবেষক দল দাবি করছে- করোনা বাতাসে ঘুরে বা উড়ে বেড়ায়। কোথাও ড্রপলেট পড়ে করোনা ছড়ানোর সম্ভাবনা কম। এখন আমরা যাই কোথায়?

সঙ্গনিরোধ কিংবা বাড়িতে বসে থেকেও লাভ হচ্ছে না। দরজা, জানালা খোলা রাখতে হচ্ছে সুস্বাস্থ্যের জন্যই। এছাড়া এতদিন জেনে আসছিলাম বদ্ধ জায়গায় করোনার সংক্রমণ হয় বেশি। তাই খোলামেলা পরিবেশে থাকার চেষ্টা করে আসছিলাম। এখন অণুজীবটি যদি বাতাসেই ভাসে তাহলে ঘরে বসে থেকেও আমরা কেউ নিরাপদ নই। কারণ জীবনের প্রাত্যহিকতায় ঘরে সার্বক্ষণিক মাস্ক রাখা সম্ভব নয়। অতএব করোনার বিস্তার এক প্রকার অপ্রতিরোধ্যই হয়ে উঠল।

Advertisement

করোনাকে প্রতিরোধ করার জন্য পুরো গোলকেই নানা আয়োজন ছিল। এরমধ্যে লকডাউনকে মনে করা হয় অপেক্ষাকৃত কার্যকর। বিশেষ করে এই কর্মসূচির মাধ্যমে মানুষকে ঘরে রাখা সম্ভব হয়। বাংলাদেশে লকডাউনে সফলতার নিদর্শন নেই। প্রথমবার বলা হয়েছিল সাধারণ ছুটি। সেই ছুটি নিয়েও কতো তুঘলকি কাণ্ড। কারখানা বন্ধ ও খোলা রাখার লুকোচুরি খেলা। তারপর আবার ছিল ঈদে বাড়ি যাওয়ার সুযোগ। সুতরাং জনসমাগম ও ভার ঠেকানো যায়নি।

এবার ১৮ দফা নির্দেশনা দিয়ে শুরু। পরে প্রথম লকডাউন দেয়া হলো অনেক ছাড়ের অফারসহ। পরে অবশ্য বলা হয়েছে ওটা লকডাউন নয়, নিষেধাজ্ঞা ছিল। সত্যি যখন আনুষ্ঠানিক লকডাউন এলো, তখন শুরু হলো তামাশা। লকডাউনের তারিখ আগে ঠিক করে দেয়াতে গ্রামমুখী জনস্রোত তৈরি হলো। ব্যবসায়ীরা লকডাউনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু করলেন, ব্যাংক ও সেবা সংস্থার কর্মী ও কারখানার শ্রমিকদের কাজে যাওয়ার পরিবহন ব্যবস্থা নিশ্চিত না করাতে শুরু হলো বিশৃঙ্খলা।

মুভমেন্ট পাসকেও সাধারণ মানুষ বিনোদনের অংশ ভেবে নিল। মাঠপর্যায়ের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিজেদের মতো করে লকডাউন বাস্তবায়ন শুরু করল। সংক্রমণ ও মৃত্যুহার ঊর্ধ্বমুখী হচ্ছে যত, লকডাউন ততটাই দুর্বল বা অকার্যকর হয়ে পড়ছে। জীবন ও জীবিকার পাটিগণিত সহজ নয়। এই গণিত মেলাতে না পারা পর্যন্ত লকডাউন সফল করাও মুশকিল।

চিকিৎসার সংকট কাটেনি। অক্সিজেন, আইসিইউ নিয়ে হাহাকার আছেই। সরকারি হাসপাতালে পর্যাপ্ত চিকিৎসা ও শয্যাসংখ্যা নিশ্চিত না করা গেলে হাহাকার থাকবেই। বেসরকারি হাসপাতালে করোনার এই সংকটকালেও ব্যবসা চলছে। বলা যায় করোনা তাদের জন্য শাপেবর। শুধু রাজধানীতেই নয়, প্রতিজেলার সরকারি হাসপাতালে আইসিইউ এবং অক্সিজেন সুবিধা বাড়াতে হবে।

Advertisement

আজ ঢাকায় উত্তর সিটি করপোরেশনে করোনার সবচেয়ে বড় হাসপাতাল চালু হচ্ছে, এটি স্বস্তির খবর। এ কথাও সত্যি করোনা প্রতিরোধ ও চিকিৎসায় আন্তঃবিভাগীয় সমন্বয়ের ঘাটতি মেটেনি। বিমানবন্দরে পড়ে থাকা চিকিৎসাসামগ্রী তার প্রমাণ। মাঠপর্যায়েও রয়েছে সমন্বয়হীনতা ও দৃশ্যমান নির্দেশনা পালনের চাতুরী। এই বাস্তবতায় করোনা প্রতিরোধ ও চিকিৎসায় আমরা প্রকৃতির করুণার ওপরই নির্ভরশীল থেকে যাব।

লেখক : গণমাধ্যমকর্মী।

এইচআর/এমকেএইচ