দেশজুড়ে

মসজিদে সশস্ত্র হামলাকারীরা জেএমবির ক্যাডার

বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার হরিপুরে শিয়া মসজিদে হামলাকারীরা নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জেএমবির ক্যাডার বলে ধারণা করছেন গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) কর্মকর্তারা। সাম্প্রতিক সময়ে এই এলাকায় শিয়াদের বিস্তৃতি এবং জঙ্গি বিরোধী সরকারের নানা পদক্ষেপের প্রতিশোধ স্বরুপ এ হামলা বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করছেন তারা। বৃহস্পতিবার ভোরে পুলিশের হাতে গ্রেফতারকৃতদের মধ্য আনোয়ার হোসেন (৩৫) জেএমবির সাবেক ক্যাডার বলে জানা গেছে। এর আগে ২০১০ সালের জুলাই মাসে নিজ গ্রাম আলিয়ারহাট থেকে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করেছিল। জেএমবির এহসার সদস্য হিসেবে স্থানীয় একটি মসজিদে সে সময় অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ দিতো। আর শিয়া মসজিদে হামলার পর অস্ত্রধারীরা যে জমির ভেতর দিয়ে পালিয়েছে সেই পথটিও আলিয়ার হাটে গিয়ে শেষ হয়েছে। প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা এবং বিভিন্ন ঘটনার যোগসূত্র মিলিয়ে পুলিশ মোটামুটি নিশ্চিত যে এটি জেএমবির কাজ। এখন এই বিষয়টিকে সামনে রেখেই তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। নাম প্রকাশ না করা শর্তে বগুড়া পুলিশের একজন পদস্থ কর্মকর্তা জানান, আগে শিবগঞ্জের কিছু এলাকা নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জেএমবির বিরচন ক্ষেত্র ছিল। এখানে অতীতে বিভিন্ন সময় মসজিদ ও মাদরাসায় গোপনে সদস্য সংগ্রহসহ অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ দেয়া হতো। তবে সেটি এখন আর নেই। নতুন করে কেউ সংগঠিত হবার চেষ্টা করলে সেটি গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের অগোচরে রয়েছে। বৃহস্পতিবার মসজিদে হামলার পরবর্তী তদন্তে প্রাথমিকভাবে আবারো জেএমবির উত্থানের বিষয়টিই উঠে এসেছে। এ কারণে তারা অনেকটাই নিশ্চিত যে সশস্ত্র হামলাকারীরা জেএমবির ক্যাডার। একই ধরনের মনোভাব ব্যক্ত করে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে আসা শিয়া সম্প্রদায়ের শীর্ষ নেতা ইসলামী শিক্ষা কেন্দ্র খুলনার অধ্যক্ষ সৈয়দ ইব্রাহীম খলীলী রাজাবী জানান, এটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। শিয়াদের উপর কোনো হুমকি ছিল না। কারণ আমাদের কোনো কর্মকাণ্ডই ইসলামের সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়। তবে ঢাকায় তাজিয়া মিছিলে হামলার পরপরই বগুড়ায় মসজিদে সশস্ত্র হামলার ঘটনায় তিনি নিশ্চিত যে যারা দেশের বিভিন্ন স্থানে একের পর এক হামলা চালিয়ে দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে, এটি তাদেরই কাজ। এ কারণে বগুড়ায় হামলার পর শিয়া সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে তাদের সেন্টারগুলোতে (পাঠাগার) নিরাপত্তা দিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে আবেদন জানানো হয়েছে।সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে চারিদিকে থমথমে পরিস্থিতি। বাসাবাড়ি ও দোকানঘরসহ শিয়াদের পাঠাগারে উড়ছে কালো পতাকা। হামলার কারণে শুক্রবার শিয়াদের ওই মসজিদে জুম্মার নামাজ হয়নি। তদন্ত এবং নিরাপত্তার স্বার্থে ঘটনার পর থেকেই র্যাব ও পুলিশ ও পিবিআই সদস্যরা মসজিদটি ঘিরে রাখায় সেখানে জুম্মার নামাজ আদায় হয়নি বলে জানিয়েছেন স্থানীয় মুসল্লীরা। তবে মসজিদের উত্তর পার্শ্বে হরিপুর গ্রামে শিয়া সম্প্রদারে ইমামবাড়ি পাঠাগারে মুসল্লিরা জুম্মার নামাজ আদায় করেছেন। শিয়া নেতা মোজাফফর হোসেন নামাজে ইমামতি করেন। স্থানীয় মুসল্লি রজমান আলী, আলী আহম্মেদ, জাহাঙ্গীর হোসেন জানান, এই ঘটনার পর থেকে তারা আতঙ্কে রয়েছেন। শুক্রবার ফজরের নামাজের সময় ওই মসজিদে মাত্র দুইজন নামাজ আদায় করেছেন। আতঙ্কে লোকজন মসজিদে আসছেন না। গত রাতকে কালোরাত আখ্যায়িত করে ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী আব্দুর রশিদ জানান, অন্যান্য দিনের সন্ধায় তিনি নামাজ আদায়ের জন্য মসজিদে যান। মসজিদে তখন আরো ১৫-১৬ জন মুসল্লি ছিলেন। তাদের বিধানমতো মাগরিব এবং এশার নামাজ একসঙ্গে আদায় করো হয়। সেভাবেই মাগরিব শেষ করে এশার নামাজের জন্য সবাই কাতারে দাঁড়িয়ে ছিলেন। এমন সময় হঠাৎ করেই গুলির শব্দ ভেসে আসে। চোখের সামনেই মসজিদের মুয়াজ্জিনকে গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়তে দেখেন তিনি। এরপর ইমাম শাহিনুর, তাহের মিস্ত্রি এবং আফতাবও গুলিবিদ্ধ হন। হুড়োহুড়িতে পড়ে আসলাম ও মনির নামে আরো দুইজন আহত হন। প্রত্যক্ষদর্শী উকিল মিয়া নামের আরো একজন জানান মসজিদে প্রবেশের প্রধান দরজা বন্দুকধারীরা বন্ধ করে দিয়ে তারা মসজিদের দক্ষিণ পার্শ্বে অজু খানার প্রাচীর টপকীয়ে মাঠের মধ্যে দিয়ে দৌঁড়ে পালিয়ে যায়। অস্ত্রধারীদের পালাতে দেখেছেন হরিপুর গ্রামের সাবিনা আকতার। তিনি বলেন, ওই তিন যুবক আসরের নামাজের সময় থেকে মোটরসাইকেল নিয়ে তাদের পাড়ার রাস্তা দিয়ে ঘোরা ফেরা করছিল। সন্ধ্যার আগেও তাদের মসজিদের পিছনে মাঠে এক সঙ্গে দেখা গেছে। সন্ধ্যার পর মসজিদে গুলি করে দৌঁড়ে পালানোর সময় তিনিসহ অন্যান্য মহিলারা ধর-ধর বলে চিৎকার করলেও কোনো পুরুষ মানুষ না থাকায় তাদের ধরা যায়নি। সাবিনা আকতার ছাড়াও অন্যান্য প্রত্যক্ষদর্শীরা মহিলারা জানান, ওই তিন যুবক মসজিদের পিছনের মাঠ দিয়ে দৌঁড়ে আলিয়ারহাটের দিকে পালিয়ে গেছে। এদিকে, বৃহস্পতিবার হামলার ঘটনায় রাতে মসজিদ কমিটির কোষাধ্যক্ষ সোনামিয়া বাদী হয়ে অজ্ঞাত তিনজনের বিরুদ্ধে শিবগঞ্জ থানায় মামলা দায়ের করেছেন। রাতেই পুলিশ শিবগঞ্জ থানার কিচক ইউনিয়নের হরিপুর গ্রামের আব্দুল মান্নানের ছেলে জুয়েল মিয়া (২৫) ও মাঝিহট্ট ইউনিয়নের মৃত তোজাম্মেল হোসেনের ছেলে সাবেক সেনাসদস্য আনোয়ার হোসেনকে (৩৫) গ্রেফতার করে।চিকিৎসাধীন গুলিবিদ্ধ মাওলানা শাহিনুর জানান, তিনি শিয়া মসজিদের ইমামতি করেন। পাশাপাশি হরিপুর বাসস্ট্যান্ডে একটি দোকানে হোমিও চিকিৎসা করে থাকেন। এলাকার সব শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে তার সু-সম্পর্ক রয়েছে। তবে কিছুদিন যাবৎ কিছু অপরিচিত কিছু মানুষ ধর্মীয় বিষয়ে জানতে এখানে আসতো। বিশেষ করে তরুণ বয়সের অপরিচিত অনেকেই শিয়া সম্প্রদায়ের ধমীর্য় বিশ্বাস নিয়ে তার সঙ্গে কোরআন হাদিসের আলোকে বাহাস করতো। এছাড়াও মসজিদের পাশেই শিয়াদের ইমামবাড়ি ও পাঠাগার অবস্থিত। এখানে মাঝে মাঝে ইসলামী বিষয়ে আলোচনা সভা হয়। অপরিচিত ওইসব তরুণদের বিভিন্ন সময় এসব আলোচনা সভায় অংশগ্রহণ করতে দেখা গেছে।  জানা গেছে, স্বাধীনতার পর ১৯৮২ সালের পর থেকে শিবগঞ্জের চককানু গ্রামে প্রথম শিয়াদের আর্বিভাব ঘটে। শিয়া নেতা আবু জাফর মন্ডল গ্রামের লোকজনকে তাদের ধর্মীয় নীতি নৈতিকতা সম্পর্কে বুঝিয়ে নিয়ে আসেন। এখন শিবগঞ্জের চককানু, রামকান্দি, আলাদিপুর, হরিপুর, চল্লিশছত্র ও গুপিনাথপুরের ১৩০টি পরিবারের পাঁচ শতাধিক মানুষ শিয়া সম্প্রদায়ের অর্ন্তভুক্ত। সাধারণ সুন্নিদের সঙ্গে কোনো বিরোধ নেই তাদের। এলাকায় একে অপরের সঙ্গে সৌহাদ্য ও ভাতৃত্বও রয়েছে যথাযথ। এমনকি শিয়াদের মসজিদের সুন্নিরা যেমন নামাজ আদায় করেন, আবার সুন্নিদের মসজিদের কখনো কখনো শিয়ারা নামাজ আদায় করে থাকেন। এই এলাকায় স্থাপিত বাংলাদেশ ইমামিয়া জনকল্যাণ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান শিয়া নেতা আবু জাফর মন্ডল জানান, এ ধরনের হামলা আমাদের আতঙ্কিত করেছে। এ ঘচনার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই আমরা।অপরদিকে, এই ঘটনার পর থেকে শুধু হরিপুরে নয় বগুড়ার সাতটি স্থানে শিয়া সম্প্রদায়ের লোকজন নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন বলে জানিয়েছেন শিয়া সম্প্রদায় পরিচালিত আল মাহাদি শিক্ষা কেন্দ্রের পরিচালক মাওলানা মোজাফফর হোসেন। তিনি আরো জানান, বগুড়া শহরের সবুজবাগে দুইটি, মহাস্থান গড় এলাকায় একটি, শিবগঞ্জের কিচক হরিপুর এবং বেলাই গ্রামে তিনটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে শিয়া সম্প্রদায়ের। এসব প্রতিষ্ঠানে এখন পর্যন্ত কোনো নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেননি স্থানীয় প্রশাসন।এ ব্যাপারে বগুড়ার পুলিশ সুপার (এসপি) আসাদুজ্জামান জানান, ঘটনা তদন্তে পুলিশ কাজ করছে। ইতোমধ্যেই জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দুইজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। হরিপুর এলাকায় পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। পাশাপাশি শিয়া সম্প্রদায়ের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানেও নিরাপত্তা দেয়া হচ্ছে বলেও জানান তিনি।এআরএ/এমএস

Advertisement