মতামত

কোনো মৃত্যুই কি হৃদয়ে পৌঁছায়?

নূর সাফা জুলহাজ

Advertisement

মৃত্যু নিয়ে সাংবাদিকতা হয়, ফেসবুক স্ট্যাটাস হয়, কিন্তু ঝড় শেষে কি মনে থাকে মৃত্যুর জয়ধ্বজা? রিফাত সুলতানা থেকে কবরী, আপাত মিল নেই, মাধ্যম আলাদা, তবু মিল আছে! হয়তো একজন জমিনের নাড়া, আরেকজন আসমানের তারা! তবু দুজনেই ছিলেন ভিজ্যুয়াল ইন্ডাস্ট্রির! দৃশ্য নিয়ে ছিলো তাদের কাজ। এবং দুজনের ঘরেই এসেছে করোনা!

যদি রিফাত করোনা আক্রান্ত না হতেন, হয়তো কবরীর মৃত্যু সংবাদ তার হাতেই প্রস্তুত হতো। তিনিই কবরীর সংবাদের দৃশ্যায়ন করতেন। দুই মৃত্যুই মানুষের মৃত্যু। তবু শ্রেণি আলাদা! কবরীর মতো চলচ্চিত্রের নক্ষত্র, যার মুখ না দেখা বাঙালির আয়না খুঁজে পাওয়া কঠিন, সেই প্রবাদপ্রতিমকেও একটি আইসিইউ বেড পেতে লড়তে হয়েছে! যেমন আইসিইউ বেড পেতে লড়তে হয়েছে রিফাত পরিবারকে! মৃত্যুর কয়েক ঘন্টা আগে রিফাত জন্ম দিয়েছে এক কন্যা সন্তানের, যে সন্তানের মুখ সে দেখে যায়নি, সন্তানেরও দেখা হবে না মায়ের মুখ!

স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দুর্বলতা যে শ্রেণি বা ক্ষমতাকেও অসহায় করে তোলে তা কি আমরা বুঝতে পারছি? নাকি কোনো মৃত্যুই আমাদের হৃদয়ে পৌঁছাচ্ছে না? কর্তৃপক্ষ একবছর ধরে বলছেন, আমরা কেন, আমেরিকা-বৃটেন-ইটালিওতো পারছেনা। তাদের জন্য বলি,পারার জন্য দূরে যেতে হয় না, কাছের ভিয়েতনাম আর কেরালাকে দেখলেই হয়। কথায় কথায় আমরা যে মুক্তিযুদ্ধকে ব্যবহার করি, সেটা জনযুদ্ধ হয়েছিলো কারণ, আমাদের 'অন্তরে ডাক পাঠানো' বা 'জীবন জয়ে'র ডাক উঠেছিলো বলে। সে মুক্তিযুদ্ধ এখন আমাদের শাসনের অস্ত্র হয়েছে বটে, কিন্তু তার রাজনৈতিক মর্মটা শিখিনি। শিখলে এই করোনা আমরা রাজনৈতিক যুক্ততায়-প্রজ্ঞায় মোকাবেলা করতাম, আমলাতান্ত্রিক অফিস আদেশে নয়।

Advertisement

যেমন উগ্রবাদ মোকাবেলায় ব্যবহার করছি কেবল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, মানুষকে যুক্ত করার রাজনীতি নয়! এসব বলছি, ব্যক্তিগত কিছু বোধ থেকে। সাধারণত ব্যক্তিগত বিষয় আমি লেখায় বলিনা, তবু আজ বলি! টেলিভিশনে আমার কাজ সংবাদ আর সংবাদভিত্তিক অনুষ্ঠান পরিকল্পনা করা, কনটেন্ট ডেভেলপ করা, উপস্থাপনা বা অ্যাংকরিং নয়। অ্যাংকরিং করি অনেকটা দায়ে পড়ে, কখনো আগ্রহে, কখনো অনাগ্রহে। এ এক রোলার কোস্টার অভিজ্ঞতা। কিন্তু এ থেকে আমার শিক্ষা হলো ভাইসভার্সা। পরিকল্পনা ছাড়া যোগাযোগ দুর্বল, যোগাযোগ ছাড়া পরিকল্পনা অকার্যকর!

কথাটি ব্যক্তিগত এ কারণে বললাম, যেহেতু সংবাদকর্মী, তাই আমাদের রাগ-অনুরাগের সুযোগ নেই, হতে হবে নির্মোহ, তবু কাল রাতে জার্নাল করতে গিয়ে সহকর্মীদের ঝুঁকি মাথায় কাজ করছিলো, কাজ করছিলো ডাক্তার-স্বাস্থ্যকর্মী-পুলিশ সকল ফ্রন্টলাইনার্স, ১০১ পরিবারের মৃত্যু!

বার বার মনে হচ্ছিলো, এই দেশের বিপন্ন কোটি মানুষ, কোটি তবু এক নয়! বিপন্ন তবু বিচ্ছিন্ন! বিচ্ছিন্নরা কি ভালো বাঁচে? রিফাতের মৃত্যু আলাপ হতে না হতেই হাজির কবরীর মতো নক্ষত্রের মৃত্য সংবাদ! আহা জীবনানন্দ, নক্ষত্রেরও মৃত্যু হয়! আমি সেই ব্রেকিং বলছি আর ভাবছি- আমরা সবাই এখানে কাম্যুর আউটসাইডার, যারা আছি আরশোলা হয়ে, কী এক সময়ে, কী এক অর্থহীনতায়, `মা মারা গেছেন আজ। হয়তো গতকাল, আমি ঠিক জানি না।’অথচ আমাদের আরশোলা নয়, মানুষ হওয়ার কথা ছিলো! কথা ছিলো অর্থহীনতাকে অর্থময় করা।

এক অন্ধকার থেকে এসেছি, আরেক অন্ধকারের দিকে যাত্রা। মাঝখানে এই আলোর পৃথিবী, আরো আলোকময় করার কথা। কিন্তু এখানেও আমরা অন্ধকারই আবাদ করছি! কোভিড-১৯ আমাদের শেখায়নি কিছু। আমরা এখনো ভ্যাকসিনের টিকার ফর্মুলা ধরে রেখেছি, বিশ্বজুড়ে উম্মুক্ত করিনি, ব্যবসা করবো বলে! যারা ভালো আছি তারা চাই সর্বাত্মক লকডাউন, কিন্তু বিশ্বের ৭০ ভাগ মানুষ একদিনের লকডাউনে সর্বস্বান্ত!

Advertisement

এমনই সভ্যতা বানিয়েছি আমরা! এমনই আমাদের রাজনীতি, এমনই আমাদের সংস্কৃতি! অথচ অহংকারে মাটিতে পা পড়েনা! আর তাই বোধহয় মৃত্তিকায় আমাদের আর অধিকার নেই! অধিকার ফিরে চাইলে রাজনীতি বদলাতে হবে, ৫০ বছর আগে সংস্কৃতির যে গাছটি বোনার কথা, সেটি বুনতে হবে এখনই! না হয়, 'সুবিধাবাদিতার মন' নিয়ে আর যাই হোক, মানুষের গল্প হবে না। অতিকায় হস্তি লোপ পাইয়াছে, মানুষ আর আরশোলা টিকিয়া থাকিবে, কিছু বিন্দু হয়ে কিছুকাল, মহাবিশ্বের কি যায় আসে? কোনো মৃত্যুই কি হৃদয়ে পৌঁছায়? মৃত্যু হৃদয়ে পৌঁছালে আমরা মানুষ হতাম। আমরা না ত্রিশ লক্ষ শহীদের দেশ! এতো মৃত্যু কি আমাদের মানুষ করেছে?

লেখক : গণমাধ্যমকর্মী|

এইচআর/এমএস