বিশেষ প্রতিবেদন

রমজান তবুও নিরানন্দে বিএনপি

চলে এসেছে রমজান। রমজান এলে মুসলিমরা যেমন খুশি হন তেমনি রাজনৈতিক মহলেও এক ধরনের উৎসব তৈরি হয়। কিন্তু করোনার সঙ্কটের কারণে রমজানে তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য কর্মসূচি নেই দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপির। গতবছরও করোনা সঙ্কটের কারণে কোনো কর্মসূচি ছিল না। এ বছর যোগ হয়েছে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার করোনা আক্রান্তের বিষয়টি। এমনিতেই বেগম খালেদা জিয়ার রয়েছে নানা রকমের জটিল অসুস্থতা। বয়সও হয়েছে অনেক। এর মধ্যে করোনা আক্রান্ত হওয়া অনেকটা আতঙ্কের।

Advertisement

অন্যদিকে দলের অনেক সিনিয়র নেতাই করোনা আক্রান্ত আছেন। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে কেউ সুস্থ হয়েছেন, আবার কেউ কেউ এখনও করোনায় আক্রান্ত অবস্থায় বাসা ও বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। তাদের মধ্যে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর শারীরিক অবস্থা এখন অনেকটাই স্থিতিশীল হলেও পঞ্চম বারের মতো টেস্টে করোনা পজিটিভ রিপোর্ট এসেছে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন ও তার স্ত্রী বিলকিস আক্তার হোসেন। তারা রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি আ ছেন। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য বেগম সেলিমা রহমান রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতাল ভর্তি। বাসায় চিকিৎসা নিচ্ছেন দলের ভাইস চেয়ারম্যান ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন ও স্ত্রী রিফাত হোসেন। বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য ডা. এ কে এম আজিজুল হক করোনা আক্রান্ত হয়েছেন। বাসায় থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন তিনি। দলের সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক মো. সেলিমুজ্জামান সেলিম ও তার স্ত্রী সাবরিনা শুভ্রা আগের চেয়ে কিছুটা সুস্থ হয়েছেন। চেয়ারপারসন উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য ডা. ফরহাদ হালিম ডোনার ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। রাজধানীর হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন দলের যুগ্ম মহাসচিব ও ঢাকা দক্ষিণ মহানগর বিএনপির সভাপতি হাবিবুন নবী খান সোহেল।

এ ছাড়াও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট আহমেদ আযম খান করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন দলের প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী।

অন্যদিকে এরই মধ্যে মৃত্যুবরণ করেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য, প্রবীণ রাজনীতিক ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ। বয়সের ভারে নুহ্য হয়ে আছেন আরো তিন শীর্ষ নেতা ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার, ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া ও লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান।

Advertisement

এর মধ্যে রমজানের শুরুতেই দেশ আছে সরকারঘোষিত লকডাউনের আওতায়। নানা সমস্যায় জর্জরিত বিএনপির এবারের রমজান কাটাতে হবে নিরানন্দে। সারাক্ষণই উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার মধ্যেই দলের নেতা-কর্মীদের সময় কাটবে। কখন কোন দুঃসংবাদ আসে এই ভাবনায়। দলের সিনিয়র নেতৃত্বসহ সকল স্তরের নেতা-কর্মীরা সবচাইতে বেশি চিন্তিত বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে নিয়েই। তারা মনে করেন তার যথেষ্ট বয়স হয়েছে। শরীরে বাসা বেঁধেছে নানা জটিল রোগ। অন্যদিকে তিনি শর্তসাপেক্ষে মুক্ত থাকলেও আসলে এখনও বন্দি অবস্থাতেই আছেন। স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারেন না। হাসপাতালের পরিবর্তে বাসায় বন্দিজীবন অতিক্রম করছেন। দলের বিষয়ে কার্যকর কোনো ভূমিকাও পালন করতে পারেন না।

বিএনপি চেয়ারপারসনের প্রেস উইংয়ের সদস্য শায়রুল কবির খান জাগো নিউজকে বলেন, প্রতিবছর দলের পক্ষ থেকে ইফতার মাহফিলের আয়োজন করা হয়। এতে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে দলের নেতাকর্মীদের সম্মিলন হয়। কিন্তু গত বছরের এই সম্মিলন অর্থাৎ ইফতার মাহফিল হয়নি করোনাভাইরাসের কারণে। এবারও পরিস্থিতির উপর নির্ভর করবে। যদি পরিস্থিতি ভালো থাকে তাহলে চারটি ইফতার মাহফিল আয়োজন করা হতে পারে। বিশেষ করে এতিম ও ওলামা-মাশায়েখদের সম্মানে, রাজনীতিবিদদের সম্মানে, পেশাজীবীদের সম্মানে এবং কূটনীতিবিদদের সম্মানে। আর যদি পরিস্থিতি সেরকম না থাকে তাহলে এবার কোনো আয়োজন নেই। মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সারাদেশে নেতাকর্মীদের এই মুহূর্তে যার যার সামর্থ্য অনুযায়ী জনগণের পাশে থাকার আহ্বান জানিয়েছেন।

বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত দফতর সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স বলেন, করোনাভাইরাসের সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতির কারণে আমাদের দলের সাংগঠনিক কর্মসূচি স্থগিত রয়েছে অনির্দিষ্টকালের জন্য। যে কারণে দলের পক্ষ থেকে এবার রমজানে আমাদের কোনো কর্মসূচি নেই।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, একজন রাজনীতিবিদের খোরাক হচ্ছে রাজনীতি। আর তিনি যদি সেটা থেকে বিচ্ছিন্ন থাকেন তাহলে হতাশায় ভোগেন। বেগম খালেদা জিয়ার মতো একজন ব্যক্তিত্ব, সাবেক প্রধানমন্ত্রী দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দলের প্রধান। নিজ দলের বিষয়ে সিদ্ধান্ত দিতে পারেন না বা তার সিদ্ধান্ত এখন আর কার্যকর নয় বা তিনি সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে অংশ নিতে পারছেন না, এটা তার জন্য যেমন হতাশার ঠিক তেমনই তার সমর্থকদেরও হতাশ করছে।

Advertisement

করোনা আক্রান্ত দলের অনেক নেতা

অন্যদিকে দলের একটি বৃহৎ অংশ মনে করছে, বেগম খালেদা জিয়া যেমন সরকারের শর্তের বেড়াজালে বন্দি, ঠিক তেমনই দলের তারেক রহমানপন্থী অংশও এখন আর চাচ্ছেন না তিনি সক্রিয় হন। বরং তারেক রহমানের সমর্থকরা মনে করেন তার নেতৃত্বেই যেহেতু ভবিষ্যতে দল পরিচালিত হবে, তাই এখন থেকেই তার নেতৃত্ব দলে পরিপূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। অন্যদিকে দলে খালেদা জিয়ার সমর্থক হিসেবে পরিচিতরা এখন অনেকেই নিষ্ক্রিয় ও কোণঠাসা।

তৃণমূলের সমর্থকদের কাছে এখনও বেগম খালেদা জিয়াই হচ্ছেন দলের প্রাণশক্তি। তারা তাকে নিয়ে চিন্তায় আছেন। তারা মনে করেন, খালেদা জিয়ার চিকিৎসাও সঠিকভাবে হচ্ছে না। তার ব্যক্তিগত চিকিৎসকরাও সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করছেন না। সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করলে এত নিরাপত্তার মধ্যে থেকেই কিভাবে বেগম খালেদা জিয়া ও তার বাসার সকলে কিভাবে করোনায় আক্রান্ত হন?

রোগমুক্তি কামনায় দলের দোয়া

শুধু তিনি একাই নন, গুলশান এভিনিউয়ে তার ‘ফিরোজা’ বাসভবনের ৯ সদস্যের সবাই করোনায় আক্রান্ত। বাসাটি এখন একটি ‘মিনি হাসপাতালে’ পরিণত হয়েছে। দলের নেতা-কর্মীসহ রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের প্রশ্ন, ফিরোজা বাসভবনে করোনায় আক্রান্ত ৭৫ বছর বয়সী বয়োবৃদ্ধ বেগম খালেদা জিয়া কেমন আছেন?

বাড়তি সতর্কতার অংশ হিসেবে এরই মধ্যে গুলশানের আশপাশের এলাকায় একটি বেসরকারি হাসপাতালে আইসিইউসহ একটি কেবিন বুকিং দিয়েও রাখা হয়েছে।

বেগম জিয়ার চিকিৎসা টিমের একজন বলেন, করোনা একটি জটিল রোগ। এ ছাড়া ম্যাডামেরও বয়স হয়েছে। তার আরও বেশকিছু জটিল রোগ আছে। এটাই ভয়ের কারণ। যেকোনো সময় অবস্থার অবনতি হলে যেন মুহূর্তেই হাসপাতালে নেওয়া যায় সে জন্যই কেবিন খালি রাখা হয়েছে।

কেএইচ/এসএইচএস/এএসএম