রাজধানীর পুরান ঢাকায় নামিদামি ব্র্যান্ডের লোগো নকল করে প্রসাধনী তৈরি ও বিক্রি হচ্ছে বহু বছর ধরেই। বছরের পর বছর ধরে চলে আসা এই অবৈধ ব্যবসাকে যেন ‘ঐতিহ্য’ হিসেবেই নিয়েছেন এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করলেও অসাধু ব্যবসায়ীরা জামিনে বেরিয়ে আবারও একই কাজে জড়িয়ে পড়ছেন।
Advertisement
পুরান ঢাকার নকল প্রসাধনী নিয়ে তৌহিদুজ্জামান তন্ময়ের দুই পর্বের বিশেষ প্রতিবেদনের আজ থাকছে শেষ পর্ব।
অনুমোদনহীন, লেভেলবিহীন ও খোলাবাজার থেকে নেয়া অনিরাপদ কাঁচামালের সঙ্গে অ্যাসিড ও অন্যান্য কেমিক্যাল মিশিয়ে তৈরি করা হয় ত্বক ফর্সা করার নকল ক্রিম। অনিরাপদ পরিবেশে অনুমোদহীন স্কিন ক্রিম তৈরির অভিযোগে রাজধানীর পুরান ঢাকায় বিপাশা কসমেটিকস এন্টারপ্রাইজ নামের একটি প্রতিষ্ঠানে অভিযান চালায় র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত।
পরিবেশ অধিদফতর ও বিএসটিআই থেকে লাইসেন্স না নিয়েই অবৈধভাবে বিএসটিআইয়ের লোগো ব্যবহার করে নকল পণ্য বাজারজাত করছিল প্রতিষ্ঠানটি। এসব অভিযোগে কারখানার কারিগরসহ প্রতিষ্ঠানের ২ জনকে গ্রেফতার করে র্যাব। এরপর নকল প্রসাধনী জব্দ করে কারখানাটি সিলগালা করে দেয়া হয়।
Advertisement
অভিযান সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, কারখানায় তাদের ছিল না কোনো কেমিস্ট। কারখানার ভেতরে ছোট একটি ‘ল্যাবরেটরি’ বানিয়ে সেখানে কিছু জিনিসপত্র সাজিয়ে রেখেছিল। কিন্তু সেগুলোর ব্যবহার সম্পর্কে কিছুই জানতেন না তারা।
এমন আরও অনেক কারখানা রয়েছে পুরান ঢাকায়। যারা বিএসটিআইয়ের লাইসেন্স নিয়ে আবার অনেকে না নিয়েই ত্বক ফর্সাকারী এসব ক্রিম তৈরি করছে। বিভিন্ন সংস্থার নিয়মিত অভিযানে জরিমানা, মামলা ও কারখানা সিলগালা করে দেয়া হলেও অসাধু ব্যবসায়ীদের এসব কার্যকলাপ থামানো যাচ্ছে না। জামিনে বেরিয়ে তারা আবারও একই ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ছে।
পুরান ঢাকার এসব নকল পণ্য তৈরিকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর বাজারজাত করার নেটওয়ার্কও শক্তিশালী। ফলে উৎপাদিত পণ্যগুলো দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও ছড়িয়ে যাচ্ছে খুব সহজেই।
গত ১৮ জানুয়ারি পুরান ঢাকার লালবাগের হায়দার বক্স লেনের একটি বাড়িতে দীর্ঘদিন ধরে অবৈধভাবে চলা একটি কারখানায় অভিযান চালান র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট পলাশ কুমার বসু। এই কারখানাটি অনুমোদনহীন, লেভেলবিহীন ও খোলাবাজার থেকে নেয়া অনিরাপদ কাঁচামালের সঙ্গে অ্যাসিড মিশিয়ে তৈরি করতো ত্বক ফর্সাকারী ক্রিম। পরিবেশ অধিদফতর ও বিএসটিআই থেকে লাইসেন্স না নিয়েও অবৈধভাবে লোগো ব্যবহার করে নকল পণ্য বাজারজাত করছিল প্রতিষ্ঠানটি। এসব অভিযোগে কারখানার কারিগরসহ প্রতিষ্ঠানের ২ জনকে গ্রেফতার, নকল কসমেটিকস জব্দ ও কারখানাটি সিলগালা করে দেয় র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত।
Advertisement
অভিযান সম্পর্কে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট পলাশ কুমার বসু বলেন, ‘কারখানাটিতে গরম পানির সঙ্গে ভ্যাসলিন, স্টারিক এসিড, বোরাস ও পালম্যাকসহ বিভিন্ন কেমিক্যাল মিশিয়ে ত্বক ফর্সাকারী ক্রিম তৈরি করত। কারখানায় তাদের কোনো কেমিস্ট ছিল না। কারখানার ভেতরে ছোট একটি ল্যাবরেটরি বানিয়ে সেখানে কিছু জিনিসপত্র সাজিয়ে রাখা হয়েছিল কিন্তু সেগুলোর ব্যবহার সম্পর্কে কিছুই জানতেন না তারা।’
গত ২৯ জানুয়ারি রাজধানীর কেরানীগঞ্জ ও মোহাম্মদপুর থানা এলাকায় একটি প্রসাধনী তৈরির কারখানায় অভিযান চালায় র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। এ সময় কারখানা থেকে প্রায় দুই কোটি টাকা মূল্যের নকল ও ভেজাল পণ্য জব্দ করে কারখানাটি সিলগালা করা হয় এবং কারখানাটির প্রোডাকশন ম্যানেজার ও ডেলিভারিম্যানকে আটক করে পুলিশে হস্তান্তর করা হয়।
৪ মার্চ পুরান ঢাকার সাতরওজা এলাকার একটি আবাসিক ভবনে অভিযান চালায় র্যাব। সেখানে নামিদামি ব্র্যান্ডের নকল মোড়কের আড়ালে ভেজাল পণ্য তৈরি করে আসছিল নুরুজ্জামান কসমেটিকস নামের একটি প্রতিষ্ঠান। ভারতীয় প্যারাসুট, কুমারিকা ও ডাবর আমলা আর দেশি ব্র্যান্ড কিউট নারিকেল তেল কিংবা মেরিল গ্লিসারিন সবই তৈরি হচ্ছিল প্রতিষ্ঠানটিতে। আর সেসব পণ্য শুধু ঢাকায় নয়, সারা দেশেই ডিলারের হাত ধরে চলে যাচ্ছিল গ্রাহকের হাতে। নকল প্রসাধনী সামগ্রী তৈরি ও অনুমোদন না নিয়ে বাজারজাতকরণের অভিযোগে বাড়ির মালিকসহ দুজনকে ৬ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়।
এছাড়া ওই কারখানা থেকে প্রায় ৩৫ লাখ টাকা সমমূল্যের ভেজাল পণ্য জব্দ করে বিএসটিআই কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে ধ্বংস করা হয়।
এসব প্রসাধনীর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়ে চর্ম ও যৌনরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মো. শহীদুল্লাহ বলেন, ‘নকল প্রসাধনীগুলোয় ইচ্ছামতো রাসায়নিক ব্যবহার করা হয়। এসব রাসায়নিক বেশিমাত্রায় প্রয়োগের ফলে মানবদেহে ক্যানসার, অ্যালার্জি, ত্বকের প্রদাহ, কিডনির ক্ষতিসহ বিভিন্ন রোগের সৃষ্টি হয়। আর শিশুদের জন্য এসব প্রসাধনীর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আরও বেশি মারাত্মক।’
অভিযানের পরও কেন কমছে না নকল প্রসাধনীর দাপট, এ বিষয়ে জানতে চাইলে র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট পলাশ কুমার বসু জাগো নিউজকে বলেন, ‘নকল প্রসাধনী কারখানায় নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। সিলগালা করে দেয়ার পর কিছু কারখানা একেবারেই বন্ধ হয়ে গেছে। আর কিছু কারখানা উচ্চ আদালত থেকে সিলগালার আদেশ তুলে নিয়ে এসে বাসাটি ভাড়া দিয়ে দেয়া হয়েছে। শুধু সিলগালাই নয়, বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলাও দেয়া হয়েছে। নিয়মিত র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার কারণে অনেকেই এসব অসাধু ব্যবসা থেকে সরে এসেছে। সরে না এলে দেশ নকল প্রসাধনীতে ছেয়ে যেত।’
তিনি আরও বলেন, ‘তবে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী জেল থেকে বেরিয়ে এসে আবারও একই ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ছে। কারণ নকল প্রসাধনী তৈরি করে বাজারজাত করতে পারলেই ব্যাপক মুনাফা করা সম্ভব। তাদের নকল পণ্য বাজারজাত করার নেটওয়ার্কও শক্তিশালী। ফলে উৎপাদিত পণ্যগুলো দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের পাশপাশি রাজধানীসহ সারা দেশের মার্কেটগুলোতেও বিক্রি হয়। যার ভুক্তভোগী আমাদের সমাজের সবাই।’
তবে এসব ক্ষেত্রে র্যাবের গোয়েন্দা নজরদারি রয়েছে বলেও তিনি দাবি করেন।
টিটি/এমএইচআর/এসএইচএস/জিকেএস