রাজধানীর পুরান ঢাকায় নামিদামি ব্র্যান্ডের লোগো নকল করে প্রসাধনী তৈরি ও বিক্রি হচ্ছে বহু বছর ধরেই। বছরের পর বছর ধরে চলে আসা এই অবৈধ ব্যবসাকে যেন ‘ঐতিহ্য’ হিসেবেই নিয়েছেন এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করলেও অসাধু ব্যবসায়ীরা জামিনে বেরিয়ে আবারও একই কাজে জড়িয়ে পড়ছেন।
Advertisement
পুরান ঢাকার নকল প্রসাধনী নিয়ে তৌহিদুজ্জামান তন্ময়ের দুই পর্বের বিশেষ প্রতিবেদনের আজ থাকছে প্রথম পর্ব।
বাজারে একটি ৫০০ এমএল জনসন বেবি লোশনের দাম প্রায় ৮৫০ টাকা। আমদানি হয়ে দেশে আসতেই এর দাম দাঁড়ায় প্রায় ৭২০ টাকা। পাইকারি বাজারে বিক্রি হয় ৭৮০ টাকা। কিন্তু জনসন বেবি’র লোগো বসিয়ে একটি নকল ৫০০ এমএল লোশন তৈরিতে ব্যয় হয় মাত্র ১৫০-১৬০ টাকা। এই নকল লোশন কারখানা মালিকরা ৪০০ টাকায় বিক্রি করলেও উৎপাদনের প্রায় তিনগুণ লাভ হয়। আর কিছু অসাধু খুচরা বিক্রেতাও অধিক লাভের জন্য বিক্রি করেন এসব নকল প্রসাধনী।
এসব নকল প্রসাধনীতেও বিভিন্ন কোম্পানির নকল লোগো, বারকোড এবং মনোগ্রাম নিখুঁতভাবে তৈরি করে বসিয়ে দেয়া হয়। ফলে দেখে বোঝার উপায় থাকে না, কোনটি আসল আর কোনটি নকল। অসাধু ব্যবসায়ীদের হাত ধরে এসব নকল পণ্য সহজেই ছড়িয়ে যাচ্ছে শহরের নামিদামি মার্কেট থেকে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে।
Advertisement
রাজধানীর পুরান ঢাকায় এমন অনেক নকল কারখানা রয়েছে যেখানে প্রতিদিনই তৈরি হচ্ছে বিপুল পরিমাণ নকল প্রসাধনী। পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কিছুদিন পরপর আবিষ্কার করছে নকল প্রসাধনীর কারখানা। এসব কারখানায় অভিযানের পর মালিককে গ্রেফতার করে কারাদণ্ড দেয়া এবং জরিমানা আদায় করা হচ্ছে। কিছুদিন পর কারাগার থেকে বের হয়ে একই ব্যক্তি কারখানার নাম কিংবা স্থান পরিবর্তন করে পুনরায় চালু করছেন সেসব অবৈধ কারখানা।
অভিযোগ রয়েছে, অবৈধ এই ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করছেন স্থানীয় প্রভাবশালীরা। এতে অন্যান্য ক্ষতির সঙ্গে প্রতি বছর শত শত কোটি টাকা রাজস্বও হারাচ্ছে সরকার।
পুরান ঢাকায় ঘুরে দেখা গেছে, অবৈধ এসব কারখানায় বেশি তৈরি হয় জনসন বেবি ব্র্যান্ডের নকল লোশন, শ্যাম্পু, পাউডার; ইউনিলিভারের পন্ডস, গ্লো এন্ড লাভলী; ভারতীয় প্যারাসুট, কুমারিকা, ডাবর আমলা, ফগ, সিগনেচার, হেবা গোল্ড, কোবরা, ব্লুলেডি ব্র্যান্ডসহ ভারতীয় ভিট হেয়ার রিমুভার ক্রিম ও পাকিস্তানের গ্লোরি ক্রিম।
র্যাব সদর দফতর সূত্রে জানা যায়, গত বছর র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালিত হয় ১ হাজার ৯২৯টি। এসব অভিযানে মামলা হয় সাত হাজার ৩২৮টি। মামলায় সর্বমোট জরিমানা করা হয় ৩৬ কোটি ৩১ লাখ ৬০ হাজার ২৮৯ টাকা এবং এক হাজার ৯৭৮ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারদণ্ড প্রদান করা হয়।
Advertisement
চলতি বছর এখন পর্যন্ত র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালিত হয়েছে ২৪৮টি। এসব অভিযানে মামলা হয়েছে ৬৬৫টি। মামলায় সর্বমোট জরিমানা করা হয় ১২ কোটি ৫৮ লাখ ১৫ হাজার ৮০৫ টাকা এবং ১১৫ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারদণ্ড দেয়া হয়।
চলতি বছরে কেরানীগঞ্জ, মোহাম্মাদপুর এবং পুরান ঢাকার চকবাজার, মৌলভীবাজার, লালবাগ, ইসলামবাগ, ইমামগঞ্জ ও নবাবপুরে বেশ কিছু কারখানা বন্ধ করে সিলগালা করে দিয়েছে র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। এ সময় জরিমানা করা হয়েছে ৫৮ লাখ টাকারও বেশি। এছাড়া জব্দ করে ধ্বংস করা হয়েছে কয়েক কোটি টাকার নকল পণ্য।
গত ১১ মার্চ কেরানীগঞ্জের আটিবাজার এলাকায় ৩টি নকল ও ভেজাল প্রসাধনী তৈরির কারখানায় ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেন র্যাবের সিনিয়র নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. সারওয়ার আলম। অভিযানে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠিত ব্র্যান্ডের নাম ব্যবহার করে নকল ও ভেজাল প্রসাধনী তৈরির অভিযোগে ৩টি কারখানায় অভিযান চালিয়ে ১৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। এ সময় আনুমানিক ১০ লাখ টাকা মূল্যের নকল ও ভেজাল প্রসাধনী ধ্বংস করা হয়।
এর আগে ৪ মার্চ রাজধানীর চকবাজার ও লালবাগ এলাকায় নকল প্রসাধনীর কারখানায় অভিযান চালান মো. সারওয়ার আলম। এ সময় চারটি কারখানার মালিককে ১২ লাখ ৭৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয় এবং প্রায় ২৫ লাখ টাকা সমমূল্যের নকল ও ভেজাল প্রসাধনী ধ্বংস এবং ১৩ লাখ টাকার প্রসাধনী তৈরির মেশিনারি জব্দ করা হয়।
এসব কারখানায় বিএসটিআইয়ের অনুমোদনহীন, মেয়াদোত্তীর্ণ কাঁচামাল দিয়ে প্রসাধনী তৈরি করা হচ্ছিল। এছাড়া বিভিন্ন প্রতিষ্ঠিত ব্র্যান্ডের নাম ব্যবহার করে নকল ও ভেজাল প্রসাধনী তৈরি করে বাজারজাত করে আসছিল প্রতিষ্ঠানগুলো।
১১ ফেব্রুয়ারি সকাল থেকে রাত পর্যন্ত রাজধানীর চকবাজার ও কামরাঙ্গীরচর থানা এলাকায় মো. সারওয়ার আলমের নেতৃত্বে ৩টি কারখানায় অভিযান পরিচালনা করা হয়। সেখানে প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ টাকা মূল্যের নকল প্রসাধনী জব্দ ও তিন প্রতিষ্ঠানকে ১৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।
কারখানাগুলো মেয়াদোত্তীর্ণ কাঁচামাল দিয়ে প্রসাধনী তৈরি, প্রতিষ্ঠিত ব্র্যান্ডের নাম ব্যবহার করে ভেজাল প্রসাধনী তৈরি ও মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্যের মেয়াদের তারিখ পরিবর্তন করে বাজারজাত করছিল।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব নকল পণ্য ব্যবহারের কারণে অনেকেই বড় ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছেন। ক্ষতিকর কেমিক্যাল দিয়ে তৈরি এসব প্রসাধনী ব্যবহারে এমন কিছু জটিল রোগ হচ্ছে যার চিকিৎসায় বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করেও কোনো কাজ হচ্ছে না। নকল প্রসাধনী ব্যবহার করে অনেকেই নানান ধরনের চর্মরোগ এবং ক্যানসারে আক্রান্ত হচ্ছেন। এছাড়া শিশুদের কোমল শরীরে এসব নকল প্রসাধনী ব্যবহারের ফলে অনেকের অঙ্গহানির মতো ঘটনাও ঘটছে।
বিশিষ্ট চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) চর্ম ও যৌনরোগ বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. শহীদুল্লাহ সিকদার জাগো নিউজকে বলেন, ‘সব ধরনের প্রসাধনী ত্বকের জন্য ক্ষতিকারক। আর নকল প্রসাধনী বহুগুণে ক্ষতিকারক। কেউ যদি কোনো প্রসাধনী ব্যবহার না করে তাহলে তার ত্বকে কোনো সমস্যা হবে না। অনেক মেয়েরা মুখের অনাকাঙ্ক্ষিত দাগ দূর করতে অনেক ধরনের প্রসাধনী ব্যবহার করে থাকে। দাগ দূর হওয়ার পর থেকে ত্বকে বিভিন্ন সমস্যার সৃষ্টি হয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের অনেক ডাক্তার রয়েছেন যারা লেজার চিকিৎসার নামে অপচিকিৎসা করে উল্টাপাল্টা জিনিস ব্যবহার করে। এতে করে দেহের বিভিন্ন স্থানে দাগের সৃষ্টি হয়। কসমেটিকসের বিক্রিয়ার কারণে এসব দাগ তৈরি হয়। বিশেষ করে এই কসমেটিকস যখন সূর্যের আলোর সঙ্গে প্রতিক্রিয়া ঘটায়, তখন এগুলো বেশি সমস্যা তৈরি করে এবং একাধিক কসমেটিকস ব্যবহার করলে বেশি হয়।’
নকল কসমেটিকস ব্যবহারে স্কিন ক্যানসারের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘বেশিরভাগ কসমেটিকসে পারদ, ক্রোমিয়ামসহ অনেক ক্ষতিকারক উপাদান থাকে। সেগুলো শরীরের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ। দীর্ঘদিন ধরে এসব নকল কসমেটিকস ব্যবহারে স্কিন ক্যানসার হতে পারে।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউটের (বিএসটিআই) উপ-পরিচালক মো. রিয়াজুল হক জাগো নিউজকে বলেন, ‘গত একবছরে বিএসটিআই প্রায় ১০ কোটি টাকার নকল প্রসাধনী জব্দ করে ধ্বংস করে। নকল প্রসাধনী যতবারই তৈরি করবে আমরা তাদের ধরবো এবং শাস্তির আওতায় আনবো। বিভিন্ন এলাকায় আমাদের সোর্স রয়েছে। বিএসটিআইয়ের নিজস্ব ম্যাজিস্ট্রেটও রয়েছে। নকল প্রসাধনীর বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বিএসটিআই পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানিয়েছে, কোনো ধরনের কসমেটিকস জাতীয় পণ্য তৈরি করার জন্য যারা বাসা ভাড়া দেবেন, তাদের অবশ্যই দেখতে হবে কোম্পানিটির বিএসটিআইয়ের অনুমোদন আছে কি না। অন্যথায় বাড়িওয়ালার বিরুদ্ধেও আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে বিএসটিআই।’
র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনাকারী একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট জাগো নিউজকে বলেন, ‘পুরান ঢাকার রাসায়নিক গুদামের মতোই ভয়ঙ্কর এসব নকল পণ্য এবং অবৈধ কারখানাগুলো। এসব নকল প্রসাধনী রাজধানীর নামিদামি মার্কেটসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিক্রি হয়। এদের বিরুদ্ধে অনেক অভিযান চালানো হয়েছে। কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। কিন্তু জামিনে বের হয়ে আবার তারা আগের ব্যবসায় ফিরে যায়।’
তিনি বলেন, ‘পরিত্যক্ত মোড়ক ও কৌটাতে নকল প্রসাধনী ঢুকিয়ে পাইকারি ও খুচরা বিক্রি করে তারা। তাছাড়া অবৈধ পথে ভারত, চীন, মালয়েশিয়া থেকে নিয়ে আসা হচ্ছে ব্র্যান্ডের প্যাকেট, বোতল, কৌটা। এরপর মোড়কজাত করে ভেজাল প্রসাধনী ভরে বিক্রি করা হচ্ছে আসল নামে, দামে।’
টিটি/এমএইচআর/এসএইচএস/এমএস