দুই যুগ আগে রমনার বটমূলে ছায়ানটের বাংলা বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বোমা হামলার ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলাটি দীর্ঘদিন ঝুলে থাকার পর আপিল শুনানির জন্য হাইকোর্টের কার্যতালিকায় (কজলিস্ট) উঠেছিল গত ১৪ মার্চ। তবে রাষ্ট্রপক্ষের সময় আবেদনের পরে আবারও মামলাটির শুনানি পিছিয়েছে। ওইদিন শুনানি না করে আগামী ৩০ মে পরবর্তী দিন ঠিক করেছেন হাইকোর্ট।
Advertisement
রাষ্ট্রপক্ষের সময় আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ওইদিন হাইকোর্টের বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথ ও বিচারপতি এ এস এম আব্দুল মোবিনের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ মামলাটি শুনানির জন্য পরবর্তী দিন ঠিক করে আদেশ দেন।
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল শাহীন আহমেদ খান তখন জাগো নিউজকে বলেছিলেন, ‘সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে রোববারের (১৪ মার্চ) জন্য প্রকাশিত সংশ্লিষ্ট আদালতের মামলাটি শুনানির জন্য ছিল। কিন্তু আমরা রাষ্ট্রপক্ষ থেকে সময়ের আবেদন করি। তার কারণ তখন অ্যাটর্নি জেনারেল বেশ কয়েকদিন ধরে অসুস্থ ছিলেন। আদালতকে বিষয়টি জানিয়ে সময় আবেদন করলে আদালত রমজানের ঈদের পরে অর্থাৎ ৩০ মে দিন ঠিক করে দেন।’
এ মামলাটির ডেথ রেফারেন্স হাইকোর্টে আসার পর অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পেপারবুক তৈরি করা হয়েছিল। শুনানিও শুরু হয়। কিন্তু কয়েক দফা আদালত পরিবর্তন হওয়ায় গত সাত বছরেও শেষ হয়নি আপিল আবেদনটি।
Advertisement
২০ বছর আগে ২০০১ সালের ১৪ এপ্রিল রমনা পার্কের বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে ভয়াবহ বোমা হামলা চালিয়েছিল জঙ্গিরা। ঘটনাস্থলেই মারা যান নয়জন। হাসপাতালে আরও একজন মারা যান। নির্মম এ ঘটনায় হত্যা মামলা হাইকোর্টে আর বিস্ফোরকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে দায়ের করা অপর মামলা এখনো নিষ্পত্তি হয়নি।
হত্যা মামলাটি বিচারিক আদালতের রায়ের পর ডেথ রেফারেন্স নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে হাইকোর্টে। আর বিস্ফোরকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে করা মামলাটি থমকে আছে সাক্ষীর অভাবে। দীর্ঘ ২০ বছরেও মামলা দুটির বিচার শেষ না হওয়ায় হতাশা প্রকাশ করেছেন ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী অনেকে।
সুপ্রিম কোর্ট সূত্র জানায়, ২০১৪ সালে হত্যা মামলাটি বিচারিক আদালতের রায়ের পর ডেথ রেফারেন্স হিসেবে হাইকোর্টে আসে। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এ মামলার পেপারবুক (রায়সহ যাবতীয় নথি সংবলিত বই) তৈরি করা হয়। কয়েক দফা আদালতও পরিবর্তন হয়েছে। এরপর থেকে এ মামলার কার্যক্রম আর এগোয়নি।
তবে আদালতের কার্যক্রম স্বাভাবিকভাবে শুরু হলে চলতি বছরই ডেথ রেফারেন্স নিষ্পত্তির আশার কথা জানিয়েছেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী।মামলাটি আগামী মাসের ৩০ তারিখে হাইকোর্টের বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথ ও বিচারপতি এ এস এম আবদুল মোবিনের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চে শুনানির জন্য নির্ধারণ করা আছে।
Advertisement
এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট বেঞ্চের রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল শাহীন আহমেদ খান জাগো নিউজকে বলেন, ‘কয়েক দফা আদালত পরিবর্তন হয়েছে। এরপর আবার নতুন করে আদালত নির্ধারণ, আইনজীবীদের প্রস্তুতির জন্য সময় লাগছে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা এখন শুনানির জন্য প্রস্তুত রয়েছি। করোনা সংক্রমণ কমে আসলে এবং নিয়মিত আদালত শুরু হলে আশা করি চলতি বছরের মধ্যে মামলাটি শেষ হয়ে যাবে।’ রায়ে সর্বোচ্চ সাজাপ্রাপ্ত আসামিদের দণ্ড বহাল থাকবে বলেও আশা প্রকাশ করেন তিনি।
আদালত সূত্রে জানা গেছে,বিস্ফোরকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে দায়ের করা মামলাটির বিচার চলছে ঢাকার ১ নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে। মামলার মোট ৮৪ সাক্ষীর মধ্যে ৫৫ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে। এখনো ২৯ সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ বাকি। কিন্তু এক বছরেরও বেশি সময় ধরে এ মামলায় একজন সাক্ষীরও সাক্ষ্য গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি বলে জানা গেছে। সর্বশেষ ৫ এপ্রিল এ মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য দিন ঠিক থাকলেও চলমান করোনাভাইরাসজনিত চলমান লকডাউনের কারণে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়নি।
এ বিষয়ে এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী আবু আবদুল্লাহ ভূঁইয়া বলেন, ‘করোনাভাইরাসজনিত কারণসহ নানা কারণে গত এক বছরে একজন সাক্ষীরও সাক্ষ্য গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। ৫ এপ্রিল এ মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণের দিন ঠিক ছিল। লকডাউনের কারণে সেদিনও শুনানি হয়নি। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আবার নতুন করে দিন ঠিক করা হবে।’
দীর্ঘদিনেও বিচার শেষ না হওয়ায় ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ও সাবেক ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোতাহার হোসেন সাজু আক্ষেপ করে জাগো নিউজকে বলেন, ‘চোখের সামনে মানুষ মারা গেল, রক্তে ভিজে গেল আমার গায়ের পোশাক, সেই ঘটনার বিচার আজও দেখতে পারলাম না, এটাই আফসোস। ’
তিনি বলেন, ‘বিস্ফোরক মামলাটি দ্রুত নিষ্পত্তি করতে সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতর, সংশ্লিষ্ট আইন কর্মকর্তা এবং বিচারককে আরও বেশি তৎপর হতে হবে। প্রয়োজনে সপ্তাহে দু-তিন দিন করে তারিখ নির্ধারণ করে বিচার শেষ করতে হবে।’ হাইকোর্টেও দ্রুত ডেথ রেফারেন্স শুনানির উদ্যোগ গ্রহণের দাবি তার।
মামলার বিবরণ থেকে জানা যায়, পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠান ‘ইসলামবিরোধী’ বিবেচনা করে ২০০১ সালের ১৪ এপ্রিল রমনা বটমূলে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বোমা হামলা চালানো হয়। এ ঘটনায় নীলক্ষেত পুলিশ ফাঁড়ির সার্জেন্ট অমল চন্দ্র ওই দিনই রমনা থানায় হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দুটি মামলা করেন। ঘটনার প্রায় আট বছর পর ১৪ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।
আলোচিত এ মামলায় তদন্ত কর্মকর্তা বার বার পরিবর্তন, সম্পূরক অভিযোগপত্র দাখিল, বার বার তাগিদ দেয়া সত্ত্বেও তদন্ত কর্মকর্তাদের আদালতে সাক্ষ্য দিতে না আসার কারণে বিচার শুরু হতে দেরি হয়। পর্যায়ক্রমে থানা, ডিবি, সিআইডি পুলিশে মামলার তদন্ত যায়। মামলার অষ্টম তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির পরিদর্শক আবু হেনা মো. ইউসুফ ২০০৮ সালের ৩০ নভেম্বর আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। দুটি মামলারই অভিযোগপত্র একসঙ্গে দাখিল করা হয়।
পরে বিচারের জন্য মামলা দুটি ২০০৯ সালের ১ জানুয়ারি ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে যায়। ওই আদালতে একই বছরের ১৬ এপ্রিল পৃথক মামলা দুটিতে আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মনিটরিং সেলের সিদ্ধান্তে হত্যা মামলাটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-৩ ও বিস্ফোরকদ্রব্য আইনের মামলাটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১-এ পাঠানো হয়।
২০১৪ সালের ২৩ জুন বহুল আলোচিত রমনা বটমূলে বোমা হামলা মামলার রায় ঘোষণা করেন ঢাকার দ্বিতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক রুহুল আমিন।
রায়ে নিষিদ্ধ ঘোষিত হরকাতুল জিহাদের (হুজি) শীর্ষ নেতা মুফতি আবদুল হান্নান, বিএনপি নেতা ও সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুর ভাই মাওলানা তাজউদ্দিনসহ আটজনের ফাঁসি ও ছয়জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ দেন আদালত।
রায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত প্রত্যেককে ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানাও করা হয়। অনাদায়ে আরও এক বছর করে কারাদণ্ডাদেশ দেন আদালত। এই রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করেন আসামিরা।
মুফতি হান্নান ছাড়াও মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত অন্যরা হলেন- মাওলানা তাজউদ্দিন, মাওলানা আকবর হোসেন, মুফতি আব্দুল হাই, হাফেজ জাহাঙ্গীর আলম বদর, মাওলানা আবু বকর ওরফে হাফেজ সেলিম হাওলাদার, মুফতি শফিকুর রহমান ও মাওলানা আরিফ হাসান সুমন। এর মধ্যে মুফতি আবদুল হান্নানের পৃথক একটি মামলায় মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।
যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন- হাফেজ মাওলানা আবু তাহের, মাওলানা সাব্বির ওরফে আব্দুল হান্নান সাব্বির, হাফেজ মাওলানা ইয়াহিয়া, মাওলানা শওকত ওসমান ওরফে শেখ ফরিদ, মাওলানা আব্দুর রউফ ও শাহাদত উল্লাহ ওরফে জুয়েল।
২০০১ সালের ১৪ এপ্রিল পহেলা বৈশাখে সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান চলাকালে নিষিদ্ধ ঘোষিত হরকাতুল জিহাদের (হুজি) জঙ্গিদের বোমা হামলায় ১০ জন নিহত হন ও অনেকে আহত হন। এ ঘটনায় থানায় হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে পৃথক দুটি মামলা হয়। তার পরে ২০০৮ সালের ২৯ নভেম্বর হরকাতুল জিহাদ (হুজি) নেতা মুফতি আবদুল হান্নানসহ ১৪ জনকে অভিযুক্ত করে সিআইডি হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দুটি সম্পূরক অভিযোগপত্র দেয়। পরে দীর্ঘ শুনানি নিয়ে হত্যা মামলাটি বিচারিক আদালতে রায় ঘোষণার মাধ্যমে শেষ হয়।
এ মামলায় ১৪ আসামির মধ্যে চারজন শুরু থেকেই পলাতক। এরপর ডেথ রেফারেন্স এবং আসামিদের জেল আপিল ও ফৌজদারি আপিলের শুনানির জন্য মামলাটি হাইকোর্টে আসে।
এফএইচ/এমআরআর/এমকেএইচ