মঙ্গলবার। সময় তখন দুপুর ২টা। ঢাকার সিপাহীবাগের নবীনবাগে ওএমএসের (খোলা বাজারে বিক্রি) ৫ কেজি চাল হাতে পেলেন আকলিমা বেগম। সকাল ১১টায় চালের জন্য লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। সঙ্গে তার বিবাহিত এক মেয়েও। নিজের সংসারের জন্য তার ওই মেয়েও চাল নিয়েছেন। এতটুকু চাল পেয়ে যেন তারা হাতে চাঁদ পেয়েছেন।
Advertisement
চাল পাওয়ার আগে বেশ কিছুক্ষণ কথা হয় আকলিমা বেগমের সঙ্গে। তিনি বলেন, 'মা-মেয়ে দুজনেই ভিন্ন ভিন্ন বাড়িতে বুয়ার কাজ করেন। মেয়ে আজ এক বাড়িতে মাইনের টাকা পেয়েছে। তারপর তারা চাল কিনতে এসেছে। মায়ের চালের টাকাটা মেয়ের ধার দেয়া।'
আকলিমা বেগম জানান, তিনি এভাবে সরকারি চাল আগে কখনও কেনেননি। করোনায় কাজ হারিয়েছেন তার স্বামী। তিনি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে পিয়নের চাকরি করতেন। স্বামী চাকরি হারানোর পর থেকেই বাসা বাড়িতে বুয়ার কাজ করেন তিনি। সংসারের দায়িত্ব নিয়ে এখন লাইনে দাঁড়িয়ে পণ্যও কেনেন।
এর আগের দিন সোমবার প্রতিবেদকের কথা হয়েছিল এমন আরেকজন নিম্ন আয়ের মানুষ ফরিদ হোসেনের সঙ্গে। তিনি সকাল থেকে বেলা ৩টা পর্যন্ত বাড্ডা সরকারি স্কুলের সামনে টিসিবির পণ্য কেনার জন্য দাঁড়িয়ে ছিলেন। ট্রাক না আসায় খালি হাতে ফিরে যান।
Advertisement
এদিকে বুধবার (১৪ এপ্রিল) থেকে শুরু হওয়া এক সপ্তাহের জন্য সর্বাত্মক লকডাউনে উদ্বিগ্ন ফরিদ হোসেন। তিনি বলেন, 'রমজান শুরু হয়ে গেছে। কিভাবে সংসার চলবে। কি খেয়ে থাকব আমরা? চাইলে সরকার কাজ বন্ধ করে দিতে পারে, কিন্তু খাবার তো দিয়ে যায় না। না খেয়ে মরলেও তো গরিবের দেখার কেউই নেই। কারও কিছু যায় আসে না।'
আকলিমা বেগম বা ফরিদ হোসেনই নয়, কষ্টে আছে নিম্ন আয়ের প্রায় সব মানুষই। একদিকে রমজানে পরিবারের বাড়তি খাদ্যের চাপ। তারমধ্যে চালসহ প্রায় সব পণ্যের দাম আকাশ ছুঁইছুঁই। বাজারে মোটা চালের দাম বেড়েছে কেজিপ্রতি ৫ থেকে ৮ টাকা। যা গরিব ও স্বল্প আয়ের মানুষ বেশি খেয়ে থাকেন।
এদের খাবারের কষ্টের প্রমাণ মিলে সরকারের সাশ্রয়ী মূল্যে পণ্য বিক্রি কার্যক্রমে হুমড়ি খেয়ে পড়া মানুষ দেখলেই। গত কয়েকদিন ধরে খাদ্য অধিদফতরের ওএমএস কিংবা টিসিবির (ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ) সাশ্রয়ী মূল্যে পণ্য কিনতে শত শত মানুষ দাঁড়িয়ে ছিলেন দিনভর। খাবার কিনে ১০০-২০০ টাকা বাঁচানোর জন্য তারা যেন যুদ্ধ নেমেছেন। এমন অনেক মানুষকে এসব লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে যারা কখনও সাহায্য নেননি।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএসের সাবেক গবেষণা পরিচালক এম আসাদুজ্জামান জাগো নিউজকে বলেন, 'এই দেশে সকল ঘাত-প্রতিঘাত শুধু গরিবকে সহ্য করতে হয় বেশি। তারা কাজ হারিয়েছে, এখন না খেয়ে থাকার শঙ্কায় পড়েছে। এ কারণে অনেকে ঢাকা ছাড়ছে।'
Advertisement
সরকারের বর্তমান ব্যবস্থাপনার সমালোচনা করে এই গবেষক বলেন, 'তারা (সরকার) কি করেছে এমন পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য। এখনও কোনো সহায়তা ঘোষণা করা হয়নি। গত বছর ভালো ব্যবস্থাপনা ছিল। এক বছরে আমরা কিছুই শিখি নাই।'
নিম্ন আয়ের আরও বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত বছর থেকে করোনার আঘাতে যারা সংকটে পড়েছে, তারা এখনও সংকট কাটিয়ে উঠতে পারেনি। যেসব মানুষ কাজ হারিয়েছিল তারা কেউ কেউ কেবল কাজ পেতে শুরু করেছিল। এরমধ্যে শুরু হলো নতুন সংকট। এছাড়া যাদের পরিবারে কারও করোনা হয়েছে তাদের সঞ্চয় শেষ হয়ে গেছে চিকিৎসা করাতে গিয়ে। এছাড়া অনেকে গ্রামে ফিরে গেছেন। আর এমন মানুষও প্রচুর রয়েছে যাদের গ্রামেও কোনো সহায় সম্বল নেই।
এদিকে সম্প্রতি এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম এক জরিপ পরিচালনা করেছে। সেখানে দেখা যায়, করোনা মহামারির এই সময়ে ৬০ দশমিক ৮ শতাংশ প্রান্তিক পরিবারের ঋণ বেড়েছে। অর্থাৎ একদিকে যেমন তাদের আর্থিক অবস্থার অবনতি হচ্ছে, তেমনি ভারী হচ্ছে ঋণের বোঝা।
ওই জরিপে গরিব মানুষের দুরবস্থার একটি চিত্র ছিল। মহামারি চলাকালীন প্রান্তিক মানুষের স্বাস্থ্য, আর্থিক ও জীবনধারণের ওপর প্রভাব নিয়ে এ জরিপে দেখা গেছে, চলতি বছরের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রায় ৭৮ দশমিক ৮ শতাংশ আর্থিক সমস্যার মুখোমুখি হয়েছিল। যার ৭৮ দশমিক ৫ শতাংশই এখনও পুনরুদ্ধার হয়নি।
এছাড়া করোনাভাইরাসের সময়কার কষ্টের মধ্যে টিকে থাকতে পরিবারগুলো সুষম খাবার বাদ দেয়ার চেষ্টা করেছে। এরপর খাদ্যবহির্ভূত পণ্য কেনাও বাদ দিয়েছে। এরপরও ৬০ দশমিক ৫ শতাংশ পরিবার বলেছে তারা ঋণগ্রস্ত হচ্ছে।
ওই জরিপে অংশ নেয়াদের মধ্যে ২৯ দশমিক ৪ শতাংশ পরিবার সরকারি ও বেসরকারি উৎস থেকে আর্থিক সহযোগিতা পেয়েছিল গত বছর। এর মধ্যে ২৩ দশমিক ৫ শতাংশ পরিবার সরকারি আর্থিক সহায়তা পেয়েছে। ২৬ দশমিক ৪ শতাংশ পরিবার সঞ্চয় ভেঙেছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে জরিপে। অন্যদিকে ৮ দশমিক ৪ শতাংশ পরিবার আর্থিক অনটনে পড়ে গবাদিপশু বিক্রি করেছে। ২ দশমিক ৯ শতাংশ পরিবার জমি বা স্বর্ণ বন্দক দিয়ে অর্থের সংস্থান করেছে।
এমন পরিস্থিতিতে লকডাউনে কর্মহীন শ্রমজীবী মানুষের খাবার ও চিকিৎসার দায়িত্ব কিছুটা হলেও সরকারকে নেয়ার আহ্বান জানিয়ে আসছে বেশকিছু সামাজিক সংস্থা ও সংগঠন। তারা বলছে, করোনায় সরকারের শত শত কোটি কোটি টাকা ব্যয় হলেও সাধারণ মানুষ বঞ্চিত হচ্ছেন। আর পণ্যের মূল্য তো বেড়েছে। ফলে রেশনিং ব্যবস্থা চালুর মাধ্যমে তাদের সহায়তার কথা বলা হচ্ছে।
এনএইচ/জেডএইচ/জেআইএম