ফিচার

নিভৃত পল্লিতে ১৮ লাখ টাকায় তৈরি হলো পাঠাগার

নওগাঁর নিভৃত এক পল্লিতে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দিতে গড়ে তোলা হয়েছে নান্দনিক ‘মুজিবুর রহমান স্মৃতি পাঠাগার’। প্রতিদিন পাঠাগারে জ্ঞান অর্জন করতে আসছেন শিক্ষার্থীরা। ইতোমধ্যে পাঠাগারটি এলাকায় বেশ সাড়া ফেলেছে। জেলার সীমান্তবর্তী ধামইরহাট উপজেলার আগ্রাদ্বিগুণ ইউনিয়নের আগ্রাদ্বিগুণ বাজারে পাঠাগারটি অবস্থিত। সীমান্তবর্তী এলাকার আগামী প্রজন্মকে মাদক থেকে বাঁচাতে এবং জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দিতে নিজ উদ্যোগে পাঠাগারটি তৈরি করেছেন আলমগীর কবির। বইপড়ার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি করতে এবং মানবিক মানুষ গড়ার লক্ষে তিনি এ উদ্যোগ গ্রহণ করেন।

Advertisement

তিনি আমেরিকান একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। পাশাপাশি নিজের একটি কনসালটেন্সি ফার্ম করেছেন। তিনি মুজিবুর রহমান ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও গ্রিন ভয়েস বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা পরিবেশবিদ হিসেবে সারাদেশে ব্যাপক সুনাম অর্জন করেছেন।

নওগাঁ শহর থেকে উত্তর-পশ্চিম দিকে প্রায় ৬৫ কিলোমিটার দূরে আগ্রাদ্বিগুণ ইউনিয়ন। আর ধামইরহাট উপজেলা থেকে প্রায় ১৪ কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত। ইউনিয়ন পরিষদের মূল ফটক বাজারে অবস্থিত আলমগীর কবির নিজ বাড়ির দ্বিতীয় তলায় প্রায় ১২শ বর্গফুট জায়গার ওপর গড়ে তুলেছেন এক আলোর শিখা। বর্তমান ইন্টারনেটের যুগে সবাই যেখানে ফেসবুক ও ইউটিউব নিয়ে ব্যস্ত; সেখানে আলমগীর কবরি নিভৃত পল্লিতে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দিতে গড়ে তুলেছেন পাঠাগার।

গতবছরের সেপ্টেম্বর থেকে পাঠাগার তৈরির কার্যক্রম শুরু করেছেন। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত পাঠাগারটিতে টেবিল, সেলফ ও আলমারিতে থরে থরে সুন্দর করে সাজানো রয়েছে বিভিন্ন বই। এখানে ইতিহাস, প্রবন্ধ, সাহিত্য, সংস্কৃতি, গল্প, উপন্যাস, ইসলাম, জীবনী, খেলাধুলা, শিশুতোষ, ঐতিহ্য এবং পাঠ্যবই আছে। আরও আছে মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টরের মাধ্যমে শিক্ষার ব্যবস্থা।

Advertisement

পাঠাগারটিতে প্রবেশ করলে এক নজরে যে কারো চোখ জুড়িয়ে যাবে। প্রতিদিন জ্ঞান অর্জনের জন্য সব বয়সীরা ছুটে আসছেন পাঠাগারে। যেখানে একসঙ্গে ৪০-৫০ জন বসে জ্ঞান অর্জন করতে পারবেন। আগামী ২ মাস পর পাঠাগার উদ্বোধন করা হবে। যেখানে বইপত্র ও ডেকোরেশনসহ আনুষঙ্গিক প্রায় ১৭-১৮ লাখ টাকার মতো ব্যয় হয়েছে। পাঠাগারটি দেখাশোনার জন্য একজন লাইব্রেরিয়ান ও একজন পরিচ্ছন্নতা কর্মী আছেন। প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত খোলা থাকে।

জানা গেছে, আলমগীর কবিরের বাবা মরহুম মুক্তিযোদ্ধা মুজিবুর রহমান টানা ১৭ বছর ইউপি চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১০ সালে তিনি মারা যান। তার মৃত্যুর পর চার ছেলে মুজিবুর রহমান নামে একটি ফাউন্ডেশন তৈরি করেন। তৃতীয় ছেলে আলমগীর কবির মুজিবুর রহমান ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান। ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে ২০১৫ সাল থেকে অসহায় শিক্ষার্থীদের বৃত্তি প্রদানের পাশাপাশি নানা সামাজিক কাজ করে প্রশংসনীয় ভূমিকা রাখছে। ওই ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে নতুন রূপে তৈরি করা হয়েছে ‘মুজিবুর রহমান স্মৃতি পাঠাগার’।

পাঠাগারের প্রতিষ্ঠাতা আলমগীর কবির বলেন, ‌‘জ্ঞান ভিত্তিক সমাজব্যবস্থা বা একজন মানুষকে মানবিক হিসেবে তৈরি করার ক্ষেত্রে পাঠাগারের বিকল্প নেই। আমাদের সমাজে ছেলেমেয়েরা পাঠ্য বইয়ের বাইরে খুব কমই জ্ঞান রাখে। ফলে একজন ভালো মানুষ বা মানবিক মানুষ তৈরি করতে চাইলে তাকে শিল্প-সাহিত্য চর্চা ও পড়াশোনা করতে হবে। তাই পড়ার কোনো বিকল্প নেই। মানুষ যদি বই পড়ে, তার মধ্যে বোধ এবং চেতনা জন্মগ্রহণ করবে। তার দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন হবে।’

তিনি বলেন, ‘জ্ঞানচর্চার অভাবে আমাদের সমাজে প্রগতিশীল চিন্তাধারার মানুষের বড়ই অভাব। আগামী সমাজব্যবস্থা হবে জ্ঞান নির্ভর। আর এ চিন্তাধারা থেকে আমার প্রত্যন্ত এলাকার ছেলেমেয়েদের মাঝে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দিতে এমন উদ্যোগ নিয়েছি।’

Advertisement

শিক্ষার্থীদের পড়ার প্রতি আগ্রহ বাড়ানো প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ইউনিয়নে ৪২টি গ্রাম আছে। পাঠাগারকে কেন্দ্র করে প্রতিটি গ্রাম থেকে ২-৩ জন ছেলেমেয়ে নিয়ে ১০৫ জনের একটি টিম গঠন করা হয়েছে। যা ‘পরিবেশ বন্ধু’ নামে পরিচিত। তাদের আবার ৭টি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। প্রত্যেক গ্রুপ থেকে প্রতি সপ্তাহে তারা পড়ার জন্য পাঠাগারে আসবেন। তারা কবি, সাহিত্যিকদের জীবনী ও সংস্কৃতিসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করবেন। এ ছাড়া জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী পালন করবে। নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা হবে। বিজয়ীদের মাঝে পুরস্কার দেওয়া হবে।’

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে তিনি বলেন, ‘উপজেলায় ১৩৯টি প্রাথমিক, ২৬টি মাধ্যমিক ও ১৪টি মাদরাসাসহ কলেজ রয়েছে। প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা প্রতিটি বিদ্যালয় থেকে ২২-২৫ জন ছাত্রছাত্রী বাছাই করে দেবেন। যাদের প্রতিমাসে সকালে বিদ্যালয়ে গিয়ে নিজস্ব পরিবহন দিয়ে লাইব্রেরিতে নিয়ে আসা হবে। এরপর তারা প্রজেক্টরের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক সিনেমা, ইতিহাস-ঐতিহ্য, সাহিত্য, সংস্কৃতি, ডকুমেন্টরি, জ্ঞান-বিজ্ঞান, বিনোদনের পাশাপাশি আঞ্চলিক, জাতীয় পত্র-পত্রিকাসহ ভিডিও দেখানো হবে। সেখান থেকে তারা কী অর্জন করলেন, তা লিখবেন। এরপর সেখান থেকে তিন জনকে পুরস্কৃত করা হবে। এ ছাড়া উপস্থাপন ও বক্তব্য চর্চা শেখানোর ব্যবস্থা থাকবে।’

আলমগীর কবির বলেন, ‘মুজিবুর রহমানের ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে গত ২০১৫ সাল থেকে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও মাদরাসার ৫০ জন শিক্ষার্থীদের মাঝে মাসিক বৃত্তি প্রদান করে আসছি। আল্লাহর রহমতে চলে যাবে। আর একটি এন্ডমেন্ড ফান্ড করা হবে। যেখানে সমাজের বিত্তবানদের কাছ থেকে অর্থ সহায়তা নেওয়া হবে।’

পাঠাগারের নিয়মিত পাঠক আগ্রাদ্বিগুণ বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র মোজাহিদ বাবু, ফাজবির আলম, ছাত্রী রওজাতুন খাতুন, আগ্রাদ্বিগুণ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্রী রাফিয়া আক্তার বলেন, ‘আমরা সত্যিই মুগ্ধ। একটি ইউনিয়ন পর্যায়ে এত সুন্দর পাঠাগার পাবো, তা কল্পনার বাইরে। করোনাকালীন সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। অবসর সময়ে আমরা পাঠাগারে এসে বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করছি।’

আগ্রাদ্বিগুণ এমএল উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বেনজির আহমেদ বলেন, ‘আমি নিজেও নিয়মিত পাঠাগারে যাই। একটি পাঠাগারে যে ধরনের পরিবেশ থাকা দরকার, তার সবগুলোই সেখানে বিদ্যমান। পাঠাগারটি সময়োপযোগী সময়ে তৈরি করা হয়েছে। আমার শিক্ষার্থীদের পাঠাগারে যাওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করেছি। এখন পাঠক সংখ্যা কম দেখছি। তবে আগামীতে প্রচার-প্রচারণা বাড়লে পাঠক সংখ্যা বাড়বে বলে মনে করছি।’

আব্বাস আলী/এসইউ/জিকেএস