মতামত

একদিন হয়তো করোনা থাকবে না, কিন্তু রাজনীতি তো থাকবেই

করোনাভাইরাস তার হামলা অব্যাহত রেখেছে। আক্রান্ত এবং মৃতের সংখ্যা কেবলই বাড়ছে। কোনো দেশে একটু কম, আবার কোনো দেশে বেশি। মৃত্যুর সংখ্যায় শীর্ষে আছ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, তারপর ব্রাজিল, ভারত এবং রাশিয়া। দক্ষিণ এশিয়ায় পাকিস্তানের পরে বাংলাদেশ।

Advertisement

বাংলাদেশে নতুন করে মৃত্যুহার এবং সংক্রমণ উদ্বেগজনকভাবে বাড়তে শুরু করেছে। দেশে দেশে কোটি কোটি মানুষ চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে আছে। অনিশ্চয়তা জীবন নিয়ে, অনিশ্চয়তা জীবিকা নিয়ে। করোনায় মরবে, নাকি না- খেয়ে মরবে সেই জিজ্ঞাসা এখন অনেকের মধ্যেই। স্বল্পতম সময়ে করোনার ভ্যাকসিন বা ওষুধ আবিষ্কারে সাফল্য পাওয়া গেলেও এটা মনে রাখতে হবে যে, ওষুধ আবিষ্কার হওয়া মানেই করোনা-অধ্যায়ের অবসান নয়। বিশ্ববাসীর ওপর করোনার অভিঘাত নানা কারণেই দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক তেদরোস আধানোম গেব্রেয়াসুস বছর খানেক আগেই বলেছেন, ‘আমরা কত দ্রুত ও কত কার্যকর এ ব্যবস্থা (টিকা বা ওষধ আবিষ্কার) করতে পারবো, সেটা বিষয় নয়, বিষয় হলো, কতটা সুষমভাবে আমরা তা বণ্টন করতে পারবো। আমরা কেউ এমন পৃথিবী মেনে নিতে পারি না, যেখানে কিছু মানুষ সুরক্ষিত, সবাই নয়। সবাই সুরক্ষিত না হলে কেউই নিরাপদ নয়’।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালকের এই বক্তব্য খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। বিশ্বনেতাদের সম্মিলিত শুভ বুদ্ধি এবং সংবেদনশীল মনোভাব ছাড়া করোনাযুদ্ধে সব মানুষের বিজয় অর্জন সম্ভব হবে না। করোনার ওষুধ নিয়ে শক্তিধর দেশগুলো ‘রাজনীতি' শুরু করলে ছোট বা অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল দেশগুলোর সামনে দেখা দেবে নতুন সংকট। করোনা বিশ্বনেতাদের জন্য কোন শিক্ষা রাখছে, তার ওপর নির্ভর করছে অনেক কিছু। করোনাকে কেন্দ্র করে বিশ্বের দুই পরামক্রমশীল রাষ্ট্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মধ্যে নতুন করে যে স্নায়ুযুদ্ধ শুরু হয়েছে, তা এক বড়ো সংকটেরই ইঙ্গিত দিচ্ছে।

চীনের হুবেই প্রদেশের রাজধানী উহান থেকে করোনাভাইরাসের উৎপত্তি। চীন দ্রুত এই ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হলেও ইউরোপ-আমেরিকাসহ বাকি বিশ্ব এখন ধুকছে, ভুগছে করোনায়। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এই ভাইরাসের জন্য চীনকে অভিযুক্ত করেছিলেন। এটা ‘চাইনিজ ভাইরাস' হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। মার্কিন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও বলেছেন, তাদের কাছে যথেষ্ট পরিমাণে তথ্য আছে যে এই ভাইরাস উহানের গবেষণাগারে তৈরি। চীন এসব অভিযোগ খারিজ করে উল্টো এই ভাইরাস উহানে ছড়ানোর জন্য মার্কিন সেনাবাহিনীকে দায়ী করেছে। দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনার পারদ সর্বোচ্চ সীমার দিকে ধাবিত হচ্ছে বলে অনেকেই মনে করছেন। হোয়াইট হাউসের বাণিজ্যবিষয়ক সাবেক মধ্যস্থতাকারী ক্লিট উইলিয়াম মনে করেন, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে উত্তেজনা সবচেয়ে বাজে অবস্থায় পৌঁছেছে।

Advertisement

উইলিয়াম বলেন, ‘আমি জানি এ ধরনের টার্ম মানুষকে অস্বস্তিতে ফেলে দিচ্ছে। কিন্তু আমি চিন্তা করি, আমাদের সৎ হতে হবে, এটা নিয়ে কথা বলতে হবে। এই দুই দেশের মধ্যে স্নায়ুযুদ্ধ শুরু হয়েছে। আমরা যদি সতর্ক না হই, এটা আরও বড়ো আকার ধারণ করবে এবং পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে'। বর্তমান অবস্থায় করোনার বিপদে বিশ্ববাসী যখন দিশেহারা চীন-আমেরিকার আধিপত্য প্রতিষ্ঠার লড়াই অন্য রকম বিপদ হিসেবেই সামনে আসছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক তেদরোস আধানোম বলেছেন, বিশ্বজুড়ে করোনা মহামারির অব্যাহত বিস্তার একটা জিনিসই দাবি করে, সেটা হলো এই গ্রহের প্রত্যেক মানুষকেই এই রোগ থেকে সুরক্ষিত হতে হবে। একক হুমকি মোকাবিলায় পুরো বিশ্বের একজোট হয়ে লড়াই করার এটাই সুযোগ। শুধু তাই নয় এই পরিস্থিতি সবার জন্য অভিন্ন এক ভবিষ্যতেরও হাতছানি দিচ্ছে, যেখানে সব মানুষই সর্বোচ্চ মানদণ্ডের স্বাস্থ্যসেবা পাবে।

তিনি এ কথাও বলেছেন, এই ভাইরাস আমাদের সঙ্গে দীর্ঘদিন থাকবে এবং একে পরাজিত করতে আমাদের একজোট হয়ে উপকরণ তৈরি ও বণ্টন করতে হবে।তার এই আশাবাদ যদি সত্য হয় তাহলে বিশ্ববাসীর জন্য তা হবে বড়ো আনন্দ সংবাদ।

দুই.করোনাভাইরাস নিয়ে বাংলাদেশ এক জটিল অবস্থার মধ্যে আছে। করোনা প্রতিরোধের জন্য যা যা করণীয় তার সবগুলো যথাযথভাবে পালন না করায় আমরা একটি ভয়াবহ অবস্থার মুখোমুখি হতে চলেছি বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। অবশ্য সরকারের পক্ষ থেকে দেশের মানুষকে আশা জুগিয়ে যাওয়া হচ্ছে।

Advertisement

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক বলেছেন, ‘কোনো কোনো দেশ এখন তথাকথিত লকডাউন ও ঘরে থাকার নির্দেশ শিথিল করতে শুরু করেছে। কিন্তু আমাদের মূল যে পদক্ষেপগুলো, যেমন হাত ধোয়া, সামাজিক (শারীরিক) দূরত্বের নিয়মকানুন মেনে চলা- এসব শিথিল করা যাবে না। মহামারির পরিপ্রেক্ষিতে গৃহীত পদক্ষেপও (রোগীর সন্ধান, পৃথককরণ, পরীক্ষা ও সব রোগীর চিকিৎসা) শিথিল করা যাবে না'।

বাংলাদেশে এসব ব্যবস্থা কঠোভাবে কার্যকর করা সম্ভব হয়নি শুরু থেকেই। কিছু মানুষ বিধিবিধান উপেক্ষা করে আসছে সব সময়। ঘরে থাকতে অনেকেরই চরম অনীহা। তাদের ধারণা, বাংলাদেশে করোনায় ব্যাপক প্রাণহানির ঘটনা ঘটবে না। বরং অর্থনৈতিক কার্যক্রম সচল রাখলে মানুষ হয়তো না খেয়ে মারা যাবে না। সরকারও নিয়ন্ত্রণ শিথিলের পক্ষে অবস্থান নিয়ে পোশাক কারখানা, দোকানপাট, মার্কেট, শপিং মল, গণপরিবহন সব খুলে দেয় পর্যায়ক্রমে। স্বাস্থ্যবিধি না মেনে মানুষের চলাচল স্বাভাবিক হওয়ায় এখন আবার আমরা বেসামাল অবস্থার দিকে যাত্রা শুরে করেছি।

করোনা নিয়ে শুরু থেকে দেশে রাজনীতিও আছে। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির পাল্টাপাল্টি বক্তব্য দেওয়া বন্ধ হয়নি। সরকার এবং আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ওবায়দুল কাদের ও ড. হাছান মাহমুদ বিএনপির বিরুদ্ধে কথা বলা অব্যাহত রেখেছন। অন্যদিকে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ বিএনপি নেতারা বলছেন, করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকার কোথাও নেই, আছে শুধু টেলিভিশনে।

সরকার কোথাও নেই বলে অভিযোগ তুলে বিএনপি খুব সুবিধা করতে পারবে বলে মনে হয় না। কারণ সমন্বয়ের সমস্যা, ত্রাণ বিতরণে কিছু অনিয়মের অভিযোগ থাকলেও মানুষের পাশে সরকারই আছে। সরকার মানে তো শুধু মন্ত্রী-এমপি নয়। প্রশাসন, পুলিশ, সেনাবাহিনীসহ সব ‘অ্যাপারেটাস' মিলিয়েই সরকার। সরকারকে দেখা যাচ্ছে বরং বিএনপিকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না।

বিএনপির মতো একটি বড়ো দলের নিষ্ক্রিয়তা সবার চোখে পড়ছে। দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া গত বছর ২৫ মার্চ জামিনে মুক্তি পেয়েছেন। প্রথমে ৬ মাসের জন্য তার দণ্ড স্থগিত করা হলেও পরে দফায় দফায় তা বাড়ানো হচ্ছে। এক বছরের বেশি সময় ধরে তিনি তার বাসায় চুপচাপ রয়েছেন। রাজনীতি বা অন্য কিছু নিয়ে একেবারেই মুখ খুলছেন না। এরমধ্যে গত ১১ এপ্রিল জানা গেছে বেগম খালেদা জিয়া করোনা আক্রান্ত হয়েছেন । এক বছর ‘বেখবর' থেকে তিনি খবর হলেন এবং এই খবরে তার সমর্থক এবং অন্যদের মধ্যে উদ্বেগ বাড়বে।

এমনিতেই তিনি শারীরিকভাবে অসুস্থ। করোনাভাইরাস সংক্রমণে সরকার ১৪ এপ্রিল থেকে সাত দিনের সর্বাত্মক লকডাউনের কথা ভাবছে। এই অবস্থায় কেবল সরকারের ব্যর্থতার কথা না বলে বিএনপির উচিত ইতিবাচক কিছু করে খবর তৈরি করা। সরকার এবং আওয়ামী লীগের ভালো-খারাপ মানুষ দেখতে পারছে। বিএনপি যে দিন দিন অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে ! করোনা একদিন থাকবে না। কিন্তু রাজনীতি থাকবে। ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে পায়ের চিহ্ন রাখতে হলে বিএনপিকে মানুষের পাশে থাকতে হবে।

লেখক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।

এইচআর/জেআইএম