আন্তর্জাতিক

করোনার ছোবল আর ক্ষুধার থাবায় পিষ্ট ব্রাজিলবাসী

একদিকে করোনাভাইরাসের ঊর্ধ্বমুখী সংক্রমণ, অন্যদিকে খাদ্যাভাব, বেকারত্ব, মন্দায় নাকাল ব্রাজিলবাসী। করোনাভাইরাস সৃষ্ট মহামারিতে গত বছর ব্রাজিলের অসংখ্য মানুষকে খাদ্যাভাবে ভুগতে হয়েছে। করোনা পরিস্থিতি ক্রমেই খারাপের দিকে যাওয়ায় এবছরও ব্রাজিলের লাখ লাখ মানুষকে ক্ষুধায় কষ্ট করতে হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। সম্প্রতি এক গবেষণাতেও খাদ্য অনিশ্চয়তার বিষয়টি উঠে এসছে।

Advertisement

আল জাজিরা জানিয়েছে, সাও পাওলোর পূর্বাঞ্চলীয় জারদিম কেরালাক্সের বাসিন্দা আনা মারিয়া নগুইরা। প্রতিবন্ধী স্বামী এরালদোকে নিয়ে বসবাস তার। চুলায় কিছু একটা তুলে দিয়ে অপেক্ষা করছেন। বলেন, ‘এ বছরও আমাদের খাবারের কষ্ট করতে হবে।’

আনা এবং এরালদো এক কোটি ৯০ লাখ বাসিন্দার একজন যারা করোনা মহামারিতে খাবারের কষ্ট করেছেন। গত ডিসেম্বরে পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, মহামারিতে প্রায় ১১ কোটি ৭০ লাখ মানুষ অর্থাৎ দেশটির অর্ধেকের বেশি জনগোষ্ঠী খাদ্যের অনিশ্চয়তায় ভুগেছেন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট অধিক মাত্রার বেকারত্ব, সামাজিক অনুষ্ঠানাদি কমে যাওয়া এবং খাবারের দাম বৃদ্ধি এই সমস্যার কারণ।

Advertisement

গবেষণার সমন্বয়কারী ব্রাজিলের পুষ্টি সুরক্ষা গবেষণা নেটওয়ার্কের প্রেসিডেন্ট রেনাতো মালুফ বলেন, ‘এটি দুঃখজনক ঘটনা, যা অনুমিতই ছিল। পরিস্থিতি আরও খারাপ হচ্ছে।’

গত কয়েক বছরে ব্রাজিল বেশ ভালো অবস্থানের মধ্য দিয়ে গেলেও করোনা মহামারিতে পরিস্থিতি খারাপ হয়ে পড়েছে। দেশটির অর্থনীতিবিদ মার্সেলো নেরি বলেন, ‘অবশ্যই ২০২১ সালে ব্রাজিলে খাদ্য অনিশ্চয়তা বেড়েছে।’

কংগ্রেসম্যান এবং সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী আলেসান্দ্রো পাদিলহা বলেন, ‘করোনাকালে ক্রমবর্ধমান ক্ষুধা ও খাদ্য অনিশ্চয়তা বেশ উদ্বেগজনক। এই অবস্থায় কাজের সন্ধানে যেতে বাধ্য হওয়ায় মানুষ সংক্রমণের ঝুঁকিতে পড়ছেন।’

তিনি বলেন, ‘এসব মানুষ পর্যাপ্ত খাবার না পাওয়ায় তাদের প্রতিরোধ ক্ষমতা কম এবং তারাই করোনার বেশি ঝুঁকিতে রয়েছেন। একদিকে ক্ষুধা, অন্যদিকে করোনাভাইরাস, এটি একটি করুণ সমন্বয় যা ব্রাজিলকে ইতিহাসে সবচেয়ে খারাপ মানবিক বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এটি আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।’

Advertisement

ব্রাজিল হলো অন্যতম খাদ্য রফতানিকারক দেশ এবং সাও পাওলো দক্ষিণ আমেরিকার অন্যতম সম্পদশালী শহর। তবে এখানকার দরিদ্র অঞ্চল যেমন জারদিম কেরালাক্সের বাসিন্দাদের তিনবেলা পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার খাওয়াই এখন বিলাসিতায় পরিণত হচ্ছে।

প্রত্যন্ত অঞ্চলে এই অবস্থা আরও খারাপ। রেনাতো মালুফ বলেন, ‘শহরের একজন দরিদ্র মানুষ চাইলেই রাস্তায় যেতে পারেন এবং খাবার চাইতে পারেন, কিন্তু প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ তা পারেন না।’

এর মধ্যে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি শহরের বাসিন্দাদের ভোগান্তি বাড়িয়েছে কয়েকগুণ। মহামারিতে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়েছে রকেটের গতিতে। এতে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ত্রাহীদশা। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, এক বছরে ব্রাজিলে চালের দাম কেজিপ্রতি বেড়েছে প্রায় ৭০ শতাংশ। যেখানে ব্ল্যাক বিন, আলু, মাংস, দুধ এবং সয়াবিন তেলের দাম বড়েছে যথাক্রমে ৫১, ৪৭, ৩০, ২০ এবং ৮৭ শতাংশ। এছাড়া ব্রাজিলে বহুল ব্যবহৃত বোতলের গ্যাসের দাম বেড়েছে ২০ শতাংশ।

এ অবস্থায় দরিদ্রদের সংকট আরও ঘনীভূত হচ্ছে। অর্থনীতিবিদ নেরি বলেন, ‘দরিদ্ররা সহায়তার জন্য বন্ধু-স্বজনদের দারস্থ হচ্ছেন। সবকিছু তাদের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে।’

এ অবস্থায় অসংখ্য মানুষকে সরকারি ও বিত্তশালী প্রতিবেশীদের সহায়তায় চলতে হচ্ছে। দ্রব্যমূল্যের দাম বাড়তে থাকায় অনেককেই সহায়তার আশ্রয় নিতে হচ্ছে। নানা সমস্যায় জর্জরিত নাগরিকদের অনকেকে শুধুমাত্র সহায়তার ওপর নির্ভর করে চলতে হচ্ছে। এ অবস্থায় কতদিন চলতে হবে সেই আশঙ্কাও ভর করছে তাদের মধ্যে।

এদিকে করোনা সংক্রমণের দিক দিয়ে ব্রাজিল তালিকায় তৃতীয় স্থানে নেমে গেলেও মৃত্যুর দিক থেকে এখনও দুইয়ে রয়েছে। লাতিন আমেরিকার এই দেশটিতে এখন পর্যন্ত করোনা আক্রান্ত হয়েছেন ১ কোটি ৩৪ লাখ ৮২ হাজার ৫২৩ জন। তাদের মধ্যে মারা গেছেন ৩ লাখ ৫৩ হাজার ২৯৩ জন। আর সুস্থ হয়েছেন ১ কোটি ১৮ লাখ ৮০ হাজার ৮০৩ জন। প্রতিনিয়তই খারাপ হচ্ছে ব্রাজিলের করনো পরিস্থিতি।

ইএ/জেআইএম