জাতীয়

চিকিৎসক-পুষ্টিবিদ-বিশেষজ্ঞ খাদ্যপণ্যের বিজ্ঞাপন করতে পারবেন না

কোনো চিকিৎসক, পুষ্টিবিদ, খাদ্য সম্পর্কিত কোনো বিশেষজ্ঞ খাদ্যপণ্যের বিজ্ঞাপন করতে পারবেন না। এমন বিধান রেখে ‘নিরাপদ খাদ্য (বিজ্ঞাপন) প্রবিধানমালা, ২০২১’ এর খসড়া করেছে সরকার। বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ এই প্রবিধানমালার খসড়া করেছে।

Advertisement

খসড়া প্রবিধানমালা অনুযায়ী, বিজ্ঞাপনে প্রতিযোগী পণ্যের তুলনা বা নিন্দা করে শ্রেষ্ঠত্ব দাবি করা যাবে না। আমদানির পণ্য স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত পণ্যের চেয়ে উন্নতমানের- বিজ্ঞাপনে এমন প্রচারণাও চালানো যাবে না।

শিশুর স্বাভাবিক বিশ্বাস ও সরলতাকে প্রতারণাপূর্ণ ও চাতুর্যের সঙ্গে কাজে লাগিয়ে কোনো বিজ্ঞাপন প্রচার করা যাবে না বলেও প্রবিধানমালায় উল্লেখ করা হয়েছে।

খসড়াটি প্রকাশ করে এখন এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের মতামত নিচ্ছে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ। এরপর এটি চূড়ান্ত করা হবে।

Advertisement

খাদ্যপণ্যের বিজ্ঞাপনের সাধারণ শর্তাবলি

খসড়া প্রবিধানমালায় বলা হয়েছে, বিজ্ঞাপনের ভাষা, দৃশ্য, চিত্র, কিংবা নির্দেশনা ধর্মীয় অনুভূতি, অসাম্প্রদায়িক চেতনা, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ এবং রাজনৈতিক অনুভূতির প্রতি পীড়াদায়ক হতে পারবে না।

বিজ্ঞাপনের অডিও মানসম্মত এবং শ্রুতিমধুর হতে হবে এবং বিজ্ঞাপনে নোংরা ও অশ্লীল শব্দ, উক্তি, সংলাপ, জিংগেল ও গালিগালাজ ইত্যাদি পরিহার করতে হবে।

বিজ্ঞাপনে প্রতিযোগী পণ্যের তুলনা বা নিন্দা করে শ্রেষ্ঠত্ব দাবি করা যাবে না এবং এমন কোনো বর্ণনা বা দাবি প্রচার করা যাবে না যাতে জনগণ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রতারিত হতে পারে। শারীরিক ও মানসিক অক্ষমতা বা দৈহিক আকার ও বর্ণকে কেন্দ্র করে কোনো বিজ্ঞাপন প্রচার করা যাবে না।

Advertisement

বিজ্ঞাপনে শিশুদের পরনিন্দা, বিবাদ ও কলহের এবং ঝুঁকিপূর্ণ দৃশ্যে অংশগ্রহণ পরিহার করতে হবে এবং তাদের চরিত্র গঠনে সুশিক্ষা দেয়ার প্রতি বিশেষ লক্ষ্য রাখতে হবে; অর্থাৎ এমন কোনো বিজ্ঞাপন প্রদর্শন করা যাবে না যেখানে শিশুদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

শিশুর নৈতিক, মানসিক বা শারীরিক ক্ষতি করতে পারে এমন বিষয় বিজ্ঞাপনে অন্তর্ভুক্ত করা যাবে না এবং শিশুর স্বাভাবিক বিশ্বাস ও সরলতাকে প্রতারণাপূর্ণ ও চাতুর্যের সঙ্গে কাজে লাগিয়ে কোনো বিজ্ঞাপন প্রচার করা যাবে না বলে প্রবিধানমালায় উল্লেখ করা হয়েছে।

যেকোনো খাদ্য বা পানীয়ের বিজ্ঞাপনে স্বাস্থ্যগত বিরূপ প্রভাব সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করতে হবে এবং সুপার ইম্পোজ করে স্পষ্টাক্ষরে দেখাতে হবে।

এতে আরও বলা হয়, কোনো ডাক্তার, পুষ্টিবিদ বা খাদ্য সম্পর্কিত কোনো বিশেষজ্ঞ খাদ্য বিষয়ক কোনো বিজ্ঞাপনে উপস্থিত থাকতে পারবে না।

মোড়কাবদ্ধ খাদ্যের বিজ্ঞাপন প্রচারের শর্তাবলি

দেশে প্রস্তুতকৃত মোড়কবদ্ধ খাদ্যের সংশ্লিষ্ট তথ্য বাংলা ভাষায় লিপিবদ্ধ করতে হবে, তবে প্রয়োজনে বাংলার পাশাপাশি এক বা একাধিক বিদেশি ভাষাও ব্যবহার করা যাবে। আমদানিকৃত মোড়কাবদ্ধ খাদ্য দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে বিক্রির ক্ষেত্রে বিজ্ঞাপন বিদেশি ভাষায় হলে, বাংলা ভাষাতেও বিজ্ঞাপন সংযুক্ত করতে হবে।

ভোক্তার জন্য যথাসম্ভব সহজবোধ্যভাবে খাদ্যের নাম ও উপকরণের তালিকা বা বিবরণ বিজ্ঞাপনে স্পষ্টাক্ষরে উল্লেখ করতে হবে। বিজ্ঞাপন অনাবৃত, সহজে দৃশ্যমান ও সহজপাঠ্য হতে হবে। কোনো বিজ্ঞাপনে ফল ভিত্তিক পানীয় হিসেবে বর্ণিত হবে না, যতক্ষণ না এ ক্ষেত্রে বর্ণিত পরিমাণ এই জাতীয় ফলের রস থাকে, অন্যথায় এটিকে কৃত্রিম সিরাপ বা কৃত্রিম পানীয় হিসেবে বর্ণনা করতে হবে। তবে এক্ষেত্রে বিএসটিআই’র নির্ধারিত মান অনুসরণ করতে।

মিষ্টান্ন, চকলেট, বিস্কুট বা কৃত্রিম পানীয় এবং ফলমূল ভিত্তিক পানীয়ের মিশ্রণ এবং এসব পানীয় প্রস্তুতির ক্ষেত্রে কোনো অনুরূপ পণ্য নেই, সেখানে বিজ্ঞাপনে কোনো ফলের নাম বা ফলের চিত্রের উপস্থাপনা তৈরি করা যেতে পারে।

যেসব খাদ্যের জন্য একটি স্ট্যান্ডার্ড নির্দিষ্ট করা হয়েছে, এই জাতীয় খাদ্যের ক্ষেত্রে বিজ্ঞাপনে বা ঘোষণার সঙ্গে বা এর বাইরে অন্য যেকোনো উপাদানগুলোর সংযোজন বা সংমিশ্রণ নিষিদ্ধ করা হবে। ‘চিকিৎসা বা পুষ্টি বা স্বাস্থ্য পেশাদারদের দ্বারা প্রস্তাবিত’ বা কোনো শব্দ যা খাবারকে সুপারিশ করে, নির্ধারিত করে বা চিকিৎসার দ্বার অনুমোদিত বলে প্রস্তাবিত বা এমন কোনো শব্দ যা বিজ্ঞাপনে উপস্থিত থাকতে পারবে না।

কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়া খাদ্যের বিশেষ স্বাস্থ্য সম্পর্কিত গুণগত মান রয়েছে এমন কোনো তথ্য কোনো খাদ্যের বিজ্ঞাপনে প্রচার করা যাবে না।

কোনো খাদ্যপণ্যের বিজ্ঞাপনে ‘প্রাকৃতিক’ শব্দটি রাখা যাবে না যতক্ষণ পর্যন্ত এই জাতীয় খাদ্য বা খাদ্য পণ্যটি কোনো মিশ্রণবিহীন, অপ্রক্রিয়াজাত বা অন্যকোনো খাদ্যের সঙ্গে মিশ্রিত না হয়।

যেখানে ‘প্রাকৃতিক’, ‘তাজা’, ‘খাঁটি’, ‘আসল’, ‘প্রচলিত’, ‘ঐতিহ্যবাহী’, ‘ঘরের তৈরি’, ‘বাড়িতে রান্না করা’, ‘জেনুইন’ ইত্যাদির মতো বিশেষণ যুক্ত ট্রেড মার্ক, ব্র্যান্ড নাম বা অভিনব নামের অর্থ কোনো খাবারে উপস্থাপনা বা বিজ্ঞাপনে এমনভাবে উপস্থাপিত করা যাবে না, যা খাবারের প্রকৃতি সম্পর্কে ভোক্তাকে বিভ্রান্ত করার সম্ভাবনা রয়েছে, এক্ষেত্রে এই ধরণের বিজ্ঞাপন প্রচার করা যাবে না।

আমদানি করা খাদ্য বা খাদ্যপণ্যের বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রে প্রস্তুতকারকের নাম ও পূর্ণ ঠিকানা ছাড়াও আমদানিকারকসহ প্রযোজ্য ক্ষেত্রে পুনঃমোড়কজাতকারক, পুনঃবোতলজাতকারক, পুনঃটিনজাতকারক, বিতরণকারী এবং এজেন্টের নাম ও পূর্ণ ঠিকানা উল্লেখ করতে হবে। তবে বিজ্ঞাপনে এমন কোনো শব্দ বা অভিব্যক্তি প্রকাশ বা ঘোষণা করা যাবে না, যাতে ধারণা হয় যে, আমদানির পণ্য স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত পণ্যের চেয়ে উন্নতমানের।

বিজ্ঞাপনে চিকিৎসক, বিশেষজ্ঞ বা সমতুল্য কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সুপারিশকৃত, এই ধরনের অভিব্যক্তি প্রকাশ বা ঘোষণা করা যাবে না, যার মাধ্যমে ক্রেতা বিভ্রান্ত হতে পারে।

খাদ্য বা খাদ্যপণ্যের গুরুত্ব বৃদ্ধি করতে এর পরিমাণ ও পুষ্টিগুণের বিষয়ে বিজ্ঞাপনে কোনো মিথ্যা দাবি বা অপকৌশল অথবা ‘রোগ নিরাময়কারী’ ইত্যাদি ধরণের কোনো বিভ্রান্তিকর তথ্য বা দাবি এবং উৎসস্থল সম্পর্কে কোনো বিভ্রান্তিকর বক্তব্য প্রচার করা যাবে না। তবে সরকার বা নির্ধারিত কোনো কর্তৃপক্ষের অনুমোদন সাপেক্ষে গুণগতমানের নিশ্চয়তা বিধান সম্বলিত সিল দেয়া যাবে।

মাতৃদুগ্ধ বিকল্প, শিশু খাদ্য, ইত্যাদির বিষয়ে বিজ্ঞাপন প্রচারে বিধি-নিষেধ

কোনো ব্যক্তি মাতৃদুগ্ধ, শিশু খাদ্য, বাণিজ্যিকভাবে প্রস্তুতকৃত শিশুর বাড়তি খাদ্য বা এর ব্যবহারের সরঞ্জামাদির আমদানি, স্থানীয়ভাবে উৎপাদন, বিপণন, বিক্রি বা বিতরণের উদ্দেশ্যে কোনো বিজ্ঞাপন মুদ্রণ, প্রদর্শন, প্রচার বা প্রকাশ করতে পারবেন না।

মোড়কাবদ্ধ শিশুখাদ্য বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রে বিশেষ শর্তাবলিতে বলা হয়েছে, কোনো খাদ্য বা খাদ্যপণ্য শিশুখাদ্য বা শিশুখাদ্যের পরিপূরক হিসেবে ব্যবহারের যোগ্য বলে ঘোষিত হলে, বিজ্ঞাপনে উত্তম ভোগের সর্বোচ্চ তারিখ উল্লেখসহ ‘মাতৃদুগ্ধ বিকল্প, শিশু খাদ্য, বাণিজ্যিকভাবে প্রস্তুতকৃত শিশুর বাড়তি খাদ্য ও উহা ব্যবহারের সরঞ্জামাদি (বিপণন নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০১৩’ এর বিধান বাধ্যতামূলকভাবে প্রতিপালন করতে হবে বলে খসড়া প্রবিধানমালায় উল্লেখ করা হয়েছে।

মোড়কবদ্ধ প্রক্রিয়াজাত দুধের বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রে বিশেষ শর্তাবলি

প্রক্রিয়াজাত দুগ্ধের ক্ষেত্রে ‘ননীমুক্ত দুগ্ধ’ বা ‘পাস্তুরিত দুগ্ধ’ বা অন্য কোনো প্রক্রিয়াজাত দুধের ক্ষেত্রে পাত্রের গায়ে ‘ননীমুক্ত দুগ্ধ’ বা ‘পাস্তুরিত দুগ্ধ’ কথাটি স্পষ্টাক্ষরে উল্লেখ করা ছাড়াও, ননীর পরিমাণ, নেট দুগ্ধের পরিমাণ ও ব্যবহৃত উপকরণের তালিকা বিজ্ঞাপনে স্পষ্টাক্ষরে উল্লেখ করতে হবে।

ঘনীভূত দুগ্ধ, মিষ্ট বা অমিষ্ট পূর্ণ ননীযুক্ত বা অর্ধ ননীযুক্ত অথবা ননীমুক্ত যে অবস্থায়ই হোক না কেন, প্রতিটি পাত্রের গাত্রে ‘শিশুদের উপযোগী নহে’ কথাটি স্পষ্টভাবে লিখতে হবে। পূর্ণ ননীযুক্ত এবং ননীমুক্ত উভয় প্রকারের শুকনা গুড়া দুগ্ধের ক্ষেত্রে প্রতিটি পাত্রের গায়ে উৎপাদন পদ্ধতি (স্প্রে, রোলার বা ফ্রিজ ড্রাইং) স্পষ্টাক্ষরে লিখতে হবে এবং মিষ্ট বা অমিষ্ট ননীমুক্ত শুকনা দুগ্ধের ক্ষেত্রে ‘শিশুদের উপযোগী নয়’ কথাটি স্পষ্টভাবে লিখতে হবে।

মোড়কাবদ্ধ খাদ্যের নেট ওজন এবং পরিমাণ বিজ্ঞাপনে উল্লেখ করতে হবে। মোড়কাবদ্ধ খাদ্যের বিজ্ঞাপনে বাধ্যতামূলকভাবে পুষ্টি সংক্রান্ত নিম্নোক্ত তথ্যাদি থাকতে হবে- শক্তি মান, এবং চর্বি, স্যাচুরেটস, শর্করা, চিনি, আমিষ ও লবণের পরিমাণ। কেবল প্রাকৃতিক কারণে কোনো খাদ্য বা খাদ্য পণ্যে লবণের উপস্থিতি থাকলে পুষ্টি ষোষণার পাশাপাশি এ বিষয়ে একটি বিবৃতি দেয়া যাবে।

এই প্রবিধানমালার কোনো বিধানের ব্যত্যয় ঘটিয়ে বিজ্ঞাপনে বিভ্রান্তিকর, অসত্য বা মিথ্যা তথ্য সন্নিবেশ করা যাবে না এবং ওই তথ্য ব্যবহার করে কোনো বিজ্ঞাপন প্রস্তুত, মুদ্রণ বা প্রচার করা যাবে না।

এটা কেউ করলে ‘নিরাপদ খাদ্য আইন ২০১৩’ এর ৪১ ও ৪২ ধারা লঙ্ঘন বলে বিবেচনা করা হবে এবং সে অনুযায়ী শাস্তির আওতায় আনা হবে বলে প্রবিধানমালায় উল্লেখ করা হয়েছে।

৪১ ও ৪২ ধারা লঙ্ঘণের শাস্তি ছয় মাস থেকে এক বছরের কারাদণ্ড বা এক থেকে দুই লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড। দ্বিতীয়বার একই অপরাধ কমপক্ষে এক বছরের কারাদণ্ড বা চার লাখ টাকা জরিামানা বা উভয়দণ্ড পেতে হবে।

আরএমএম/ইএ/জিকেএস