দিন কয়েক ঘর হতে বের হইনি। লকডাউন বা নিষেধাজ্ঞার প্রতি সম্মান দেখিয়েছি। বিশেষ ছাড় দেওয়া লকডাউন উদযাপনের খবরাখবর পাচ্ছিলাম ঘরে বসেই। আসলে চাবি হারিয়ে ফেলে মনে হয় দরজায় তালা ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছিল লক না করে। তাই দূরপাল্লার রুটের বাস, অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট চলাচল, রাইড শেয়ারিং বন্ধ হওয়া ছাড়া সকলে বিশেষ ছাড়ের লকডাউন উপভোগ করেছেন। রাজধানীসহ সারাদেশেই।
Advertisement
লকডাউন নিয়ে ঠাট্টা তামাশা এবং সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার ঊর্ধ্ব থাকায়, সরকারকে লকডাউন দীর্ঘায়িত করার সিদ্ধান্ত নিতে হয়। তবে মাঝে বিরতি দিয়ে। দুই লকডাউনের মাঝে একটা হানিমুন অধ্যায় রাখা হলো। সেই হানিমুনে যোগ দেওয়ার ঢল দেখে এলাম পথে। কিছু মানুষ অতি প্রয়োজনে পথে নেমেছেন , স্বীকার করতেই হবে। তবে খুব সহজ ভাবেই বোঝা গেছে বেশির ভাগ প্রয়োজন ছাড়া ঘুরতে বেরিয়েছে। আত্মীয়ের বাসায়, বিনোদন কেন্দ্রে আজ না গেলেও হতো কেনাকাটাতেও সংযম রাখা যেত। কিন্তু দেশের কোথাও জনতা এ সংযম দেখায়নি। বরং ঈদের চাঁদ রাতের কেনাকাটার মতো ভীড় বিপণী বিতানের সামনে। অথচ স্বাস্থ্য বিভাগের জরিপ বলছে করোনা সংক্রমণের বড় উৎসস্থল বাজার। বাজার থেকে করোনা নিয়ে লক ডাউনে দিয়েই কি লাভ? সাতদিন পর এর ‘ পজিটিভ’ পরিসংখ্যানই পাওয়া যাবে ।
বাইরে বের হওয়া মানে একটি হাসপাতালে গিয়েছিলাম। পরিচিত ডাক্তার, নার্সদের সঙ্গে কথা হলো। তারা ২০২০ থেকে করোনা শনাক্ত ও চিকিৎসা সেবার সঙ্গে যুক্ত আছেন। তাদের মতে সাধারণভাবে করোনা নিয়ে আতঙ্কিত হবার কারণ নেই। ১৪-২১ দিনের মধ্যে সুস্থ হয়ে উঠছেন আক্রান্তরা। তবে যাদের দূরারোগ্য ও জটিল রোগ আছে তারা সংকটে পড়ছেন। মৃত্যু ঝুঁকিতে পড়ছেন তারাই। তবে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো আতঙ্ক। আতঙ্ক ছড়ানো ও আতঙ্কিত হয়ে চিকিৎসা সেবাকে বিপর্যস্ত করা হচ্ছে বেশি। যার হাসপাতালে ভর্তি না হলেও চলে, তেমন রোগীও শয্যা দখল করে আছেন। এই রোগীদের বেশির ভাগেরই আছে নানা প্রভাব। ফলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাদের সরাতে পারছেন না। ডাক্তাররাই বললেন, চিকিৎসকদেরও কেউ কেউ রোগীদের অযথাই নার্ভাস করে ফেলেন। এবং অযথা ওষুধ ও পরীক্ষা দিয়ে চাপের মধ্যে ফেলে দিচ্ছেন। করোনা নিয়ে মন গড়া বিশ্লেষণও আক্রান্তদের বিভ্রান্তির মধ্যে ফেলছে।
তবে চিকিৎসক ও নার্সদের ভয় সরকারি ভাষায় যে কঠোর লকডাউন দেওয়া হচ্ছে, তার আগে পথের জনস্রোত, সমাবেশ তো করোনা বিস্তারের ক্ষেত্রকে আরো সম্প্রসারিত করলো। ঢাকায় যেমন বাড়বে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা, তেমনি বাড়বে জেলা পর্যায়েও।
Advertisement
লকডাউন এলেই প্রসঙ্গ আসে জীবন ও জীবিকার। যাদের আয় ও রোজগার মাস শেষে নিশ্চিত, সেই কয়টা মানুষ ছাড়া লকডাউন কঠোর ও দীর্ঘায়িত হলে মানুষের বিপন্নতা বেড়ে যায়। এবারও যাবে। টাকা যে সময়টায় সবচেয়ে বেশি হাত ঘুরে, সেই উৎসবের সময়টাতেই লকডাউন দিতে বাধ্য হচ্ছে সরকার। দায়ী আমরাই। করোনায় স্বজন হারানোর শোক আমরা সইয়ে নিয়েছিলাম, ভুলে গেছিলাম। ফলে অদৃশ্য অণুজীবকে পাত্তা দেইনি। ফলে এখন বাধ্য হয়ে, নতজানু হয়ে তাকে সমিহ দেখাতে হচ্ছে।
করোনা নিয়ে রাজনীতি, ব্যবসানীতি হচ্ছে। অদৃশ্য অণুজীবটি আমাদের শরীরে তার ভিত ভালো ভাবেই পুঁতে নিয়েছে। তার পূর্বসূরিদের মতোই স্থায়ী হবে পৃথিবীতে। আমাদের কাজ হবে নিজেদের সংযম ও শৃঙ্খলিত জীবনযাপন দিয়ে তাকে বশে আনা বা প্রতিরোধ করা। একাজটি পৃথিবীর সকল দেশকে করতে হবে। বিপুল জনসংখ্যা, জনসংখ্যার ঘনত্ব, প্রকৃত গড় আয় বিবেচনায় বাংলাদেশকে করোনার বিরুদ্ধে দীর্ঘ লড়াই করে যেতে হবে। এর বাইরে কোন ত্বরিৎ ও তাৎক্ষণিক সমাধান নেই।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট।
এইচআর/এমএস
Advertisement