টাঙ্গাইলের গোপালপুর উপজেলার হাদিরা ইউনিয়নে একটি আরসিসি ব্রিজ ও প্রায় এক কিলোমিটার পাকা সড়ক স্থানীয় বৈরাণ নদীর পেটে চলে যাচ্ছে। পাউবোর সুষ্ঠু পরিকল্পনা আর সংশ্লিষ্ট দফতরের সঙ্গে সমন্বয় না করে নদী খননের কারণে সরকারের প্রায় কোটি টাকার উন্নয়ন কাজ বৈরাণ নদী গিলে ফেলছে।
Advertisement
জানা যায়, প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার প্রকল্পের আওতায় টাঙ্গাইল পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) গোপালপুর উপজেলার ঐতিহ্যবাহী বৈরাণ নদী খনন করছে। বৈরাণ নদীর মোট ৩৭.৫ কিলোমিটার ২১ কোটি ১৭ লাখ টাকা ব্যয়ে তিন ফেজে খনন করা হচ্ছে। এরমধ্যে ধনবাড়ী উপজেলার মুশুদ্দী থেকে গোপালপুর উপজেলার হাটবৈরাণ পর্যন্ত প্রায় ১২ কোটি টাকা ব্যয়ে ২৬ কিলোমিটার নদী খনন ২০২০ সালের জুনে শেষ হয়েছে। চলতি অর্থবছরে চলছে বৈরাণ নদীর ভাটিতে আরও সাড়ে ১১ কিলোমিটার খননের কাজ।
সরেজমিনে ও স্থানীয়দের তথ্যে জানা গেছে, পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) কর্মকর্তারা নদী খননে পরিকল্পনাকালে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতর ও এলজিইডির সঙ্গে সমন্বয় না করার কারণে স্থানীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতরের ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৫৪ লাখ চার হাজার ৬৫১ টাকায় ৬০ ফুট দৈর্ঘ্যের একটি আরসিসি ব্রিজ ও বন্দহাদিরা গ্রামের অংশে এলজিইডির প্রায় ৮০ লাখ টাকায় নির্মিত এক কিলোমিটার পাকা সড়ক নদীগর্ভে চলে যাচ্ছে।
ইতোমধ্যে গত বর্ষায় পাকা সড়কের প্রায় এক কিলোমিটার নদীগর্ভে চলে গেছে। ফলে নগদাশিমলা বাজার থেকে হাদিরা হয়ে ধনবাড়ী উপজেলা সদরে সরাসরি যান চলাচল দীর্ঘদিন যাবত বন্ধ রয়েছে। শুষ্ক মৌসুমেও ওই অংশে পাকা সড়ক ভেঙে পড়ছে।
Advertisement
এতে উৎপাদিত কৃষিপণ্য ও মালামাল নিয়ে বিকল্প পথে যাতায়াত করায় মানুষের খরচ ও ভোগান্তি বেড়েছে। রাতে চলাচল করতে গিয়ে ইতোমধ্যে ১০-১২ জন আহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে কয়েকজন পঙ্গুত্বও বরণ করেছেন। শুষ্ক মৌসুমেই ভাঙন রোধে ব্যবস্থা না নিলে বন্দহাদিরা গ্রামের অনেক বাড়িঘর আগামী বর্ষায় নদীগর্ভে চলে যাবে।
অপরদিকে হাদিরা ইউনিয়নের ভাদুরীরচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পূর্বপাশে জনগুরুত্বপূর্ণ বিবেচনায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতর পূর্ব-পশ্চিমে ৬০ ফুট দীর্ঘ একটি আরসিসি ব্রিজ নির্মাণ করে। ব্রিজটি বৈরাণ নদীর পূর্ব ও পশ্চিম (ডান ও বামতীরে) পাশের ৮-১০টি গ্রামের সেতুবন্ধন। পাউবো বৈরাণ নদীর ওই অংশে খনন করতে গিয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতরের সঙ্গে সমন্বয় না করে নিজেদের প্রকল্পের স্বার্থে ব্রিজের অ্যাপ্রোচের মাটি কেটে তীরে জমা করে রেখেছে। অ্যাপ্রোচের মাটি কেটে ফেলায়, গত বর্ষায় ব্রিজের আরসিসি পিলারে ফাঁটল ধরে দেবে গেছে। শুষ্ক মৌসুমে ব্রিজের দুই পাশে বাঁশের সাঁকো লাগিয়ে স্থানীয়রা জরুরি প্রয়োজনে পায়ে হেঁটে চলাচল করছে। কোনো প্রকার ভ্যান-রিকশাসহ অন্যান্য যানচলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেছে।
বন্দহাদিরা গ্রামের ব্যবসায়ী আজহার আলী, হাদিরা গ্রামের বাসিন্দা মো. গোলাম ফারুখসহ অনেকেই জানান, পানি উন্নয়ন বোর্ডের ঠিকাদার গোয়ালবাড়ী ঘাট ব্রিজের উত্তরে এক প্রভাবশালীর জবরদখল করা জমি রক্ষার জন্য পূর্বদিকে ধনুকের মতো বাঁকিয়ে নদী খনন সম্পন্ন করেন। এতেই পাকা সড়ক ভেঙে নদীতে চলে যাচ্ছে।
হাদিরা ইউনিয়ন পরিষদের ৬নং ওয়ার্ড সদস্য মোজাম্মেল হোসেন জানান, পানি উন্নয়ন বোর্ডের ফিল্ড অফিসার এবং ঠিকাদারের প্রতিনিধিকে একাধিকবার বলেও নদীর স্বাভাবিক প্রবাহের চ্যানেলে খনন করানো যায়নি। ফলে বর্ষায় নদীর স্রোতে ওখানে বাঁক খেয়ে ঘূর্ণীবর্তের সৃষ্টি করায় নদীতীর ও এলজিইডির পাকা সড়কে ভাঙন দেখা দেয়। প্রায় এক কিলোমিটার পাকা সড়ক ইতোমধ্যে নদীগর্ভে চলে গেছে।
Advertisement
তিনি আরও জানান, ভাদুরীরচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পূর্বপাশে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতরের ৬০ ফুট দীর্ঘ ব্রিজটির অ্যাপ্রোচের মাটি না কেটে নদী খনন করার জন্য স্কুলের শিক্ষক-অভিভাবকসহ স্থানীয় লোকজন অনুরোধ করলেও ঠিকাদার ও পাউবোর ফিল্ড অফিসার কথা রাখেননি। এতে শুকনো মৌসুমেই ব্রিজটি চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। তিনি বিষয়টি উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তাকে মৌখিকভাবে জানিয়েছেন বলেও জানান।
হাদিরা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল কাদের তালুকদার জানান, বৈরাণ নদী খনন পাউবো একতরফাভাবে করেছে। এলজিইডি ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতরের সাথে তারা কোনো সমন্বয় করেনি। ফলে নির্মিত পাকা সড়ক ও ব্রিজের সুফল থেকে বঞ্চিত হচ্ছে স্থানীয় জনসাধারণ।
গোপালপুর উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মো. আল মাসুদ জানান, পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাথে তাদের কোনো কথাই হয়নি। পাউবোর ঠিকাদার স্থানীয় সমস্যা বিবেচনায় না নিয়ে কাজ শেষ করেছেন। এছাড়া জেলা নদী ব্যবস্থাপনা কমিটির সভায় তাদের ব্রিজটি সরিয়ে নেওয়ার কথা হয়েছিল কি না তা তিনি জানেন না। ব্রিজের ক্ষয়ক্ষতির দায়ভার অবশ্যই পানি উন্নয়ন বোর্ডের বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
গোপালপুর উপজেলা স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরের (এলজিইডি) প্রকৌশলী আবুল কালাম আজাদ জানান, পানি উন্নয়ন বোর্ডের ঠিকাদারের খামখেয়ালির কারণে এ সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। তারা এলজিইডির নগদাশিমলা-হাদিরাবাজার সড়কের ক্ষতিগ্রস্ত অংশ সংস্কারে হাত দিয়েছেন। কিন্তু বন্দহাদিরা এলাকায় নদীতীর না থাকায় সড়ক সংস্কার কাজ ব্যাহত হচ্ছে।
টাঙ্গাইল এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রফিকুল ইসলাম জানান, ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বর্ষা আসার আগেই কাজ শেষ করা হবে।
টাঙ্গাইল পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সিরাজুল ইসলাম জানান, ঐতিহ্যবাহী বৈরাণ নদী যথাযথভাবে খনন করা হচ্ছে। গত বর্ষায় বন্দহাদিরায় তীর ভেঙে যাওয়ায় এলজিইডির সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সড়কটি যেহেতু এলজিইডির সুতরাং সংস্কার বা মেরামতের দায়িত্বও তাদের। নদীতীর সুরক্ষায় বর্ষা মৌসুমে জরুরি ভিত্তিতে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়ে থাকে, তখন ওখানে কাজ করা সম্ভব।
তিনি আরও জানান, বৈরাণ নদী খননের প্রাক্কালে জেলা নদী ব্যবস্থাপনা কমিটির সভায় ভাদুরীর চরের ৬০ ফুট ব্রিজটি সরিয়ে নিয়ে নতুন ব্রিজ নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়েছিল। এখনও পর্যন্ত ব্রিজটি কেন সরানো হয়নি তা বোধগম্য নয়।
আরিফ উর রহমান টগর/এফএ/এমকেএইচ