রমজানের রোজা পালনের সবেচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুইটি অংশ রয়েছে। রোজা পালন করতে যার প্রয়োজনীয়তা সবচেয়ে বেশি। তার প্রথমটি হলো শেষ রাতের সাহরি। আর দ্বিতীয়টি হলো সন্ধ্যায় ইফতার। রোজা পালনে ইফতার ও সাহরির রয়েছে সুন্নাত পদ্ধতি।
Advertisement
সাহরি খাওয়ার মাধ্যমে রোজার সূচনা হয় আর ইফতার করার মাধ্যমে রোজা সম্পন্ন করা হয়। সুতরাং ইফতার ও সাহরি সুন্নাত পদ্ধতিতে করাই আবশ্যক।
কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত কিছু কিছু রুসুম-রেওয়াজ ও ভুল ধারণার কারণে সাহরি ও ইফতারের সুন্নাতগুলো যথাযথভাবে মেনে চলা হয় না। অথচ সুন্নাতের অনুসরণে সাহরি-ইফতার যেমন অনেক উপকারি তেমনি রোজাগুলোও হবে অনেক সুন্দর।
> সাহরি খাওয়াসাহরি খাওয়া সুন্নাত। হাদিসে পাকে সাহরি খাওয়ার নির্দেশ দিয়ে বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন-‘আমাদের ও অন্যান্য কিতাবের অধিকারী জাতির (ইয়াহুদি ও খ্রিস্টান) রোজার পার্থক্য সাহরি খাওয়া।’ (মুসলিম)অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরা সাহরি না খেয়ে রোজা পালন করে থাকে। এ জন্য রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন অল্প হলেও সাহরি খাওয়া সুন্নাত। সাহরি খাওয়ায় রয়েছে কল্যাণ।
Advertisement
> সাহরি খাওয়ার সময়রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রাতের শেষ মুহূর্তে সাহরি খাওয়ার কথা বলেছেন। রাতের মধ্য ভাগে কিংবা আজানের আগ মুহূর্তে সাহরি খাওয়া উভয়টিই সুন্নাতের পরিপন্থী।
হাদিসে এসেছে-রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘সাহরি বিলম্বে (রাতের শেষভাগে) গ্রহণ করো।’ (তিবরানি)
> সাহরি খাওয়ার উত্তম সময়আজানের কিছুক্ষণ আগেই সাহরি খাওয়া উত্তম এবং সুন্নাত। এ সম্পর্কে হাদিসে এসেছে-হজরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাহরি ও (ফজর) নামাজের মধ্যে পঞ্চাশ আয়াত তেলাওয়াত পরিমাণ সময় অবশিষ্ট থাকত।’ (বুখারি)আধুনিক যুগের ফকিহদের মতে, কুরআনুল কারিমের পঞ্চাশ আয়াত তারতিল সঙ্গে তথা যথানিয়মে ধীরস্থিরভাবে তেলাওয়াত করতে বিশ মিনিট সময় প্রয়োজন হয়। তাই আজানের ২০ মিনিট আগে সাহরি খাওয়া শেষ করা সুন্নাত।
> সাহরিতে খাবারের পরিমাণঘরে পর্যাপ্ত পরিমাণ খাবার থাকার পরও অনেকে সামান্য খাবার ও পানি দিয়ে নামমাত্র সাহরি করে থাকেন। এমনটি ঠিক নয়। কেননা সাহরি খাওয়ার মাধ্যমে রোজা শুরু করা সুন্নাত। সাহরিতে রয়েছে কল্যাণ। তাই খুব বেশি এবং একেবারে কম না খেয়ে পরিমিত পরিমাণ তথা সুন্নাত পদ্ধতিতে সাহরি খাওয়া উত্তম।
Advertisement
সাহরিতে অধিক খাবার খেলে বান্দা রোজার কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হয়। কেননা অতিরিক্ত খাবার শরীরে আলস্য তৈরি করে। ফলে মানুষ যেমন ইবাদতমুখী হতে পারে না আবর জৈবিক চাহিদা বৃদ্ধি পায়। বিশেষ করে অনাহারী ও ক্ষুধায় ক্লেষ্ট মানুষের কষ্ট অনুভব করা যায় না।
পক্ষান্তরে নাম মাত্র খাবার বা পানি গ্রহণ সাহরি করলে শারীরিক শক্তি একেবারেই নিঃশেষ হয়ে যায়। ফলে ইবাদত-বন্দেগি করাই দুষ্কর হয়ে পড়ে। সাহরির খাবারের পরিমাণ সম্পর্কে আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানি রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেছেন-‘মানুষ স্বাভাবিক ক্ষুধায় যতটুকু খাবার গ্রহণ করে, সাহরিতে সেই পরিমাণ খাওয়া মুস্তাহাব। অর্থাৎ খুব বেশি বা কম নয়; বরং মধ্যম পন্থা অবলম্বন করা।’ (মাজমাউল উলুমি ওয়াল হিকাম)
> আজান চলাকালীন সাহরি খাওয়ারোজা ফরজ ইবাদত। অনেক সময় দেখা যায়, সাহরি খাওয়া অবস্থায় আজান শুরু হয়ে যায়। এমনটি কোনোভাবে কাম্য নয়। ফরজ রোজা পালনের জন্য সাহরির সময়ের প্রতি সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি। সুতরাং কারো সাহরির সময় যদি আজান হয়ে যায়; তবে সঙ্গে সঙ্গে খাবার পরিহার করতে হবে।
> সাহরি খাওয়ার পর না শোয়াসাহরি খেয়ে সঙ্গে সঙ্গে শুয়ে পড়া সুন্নাতের পরিপন্থী কাজ। শারীরিকভাবেও তা ক্ষতিকর। সাহরি খেয়ে জামাআতে নামাজের প্রস্তুতি নিয়ে মসজিদে উপস্থিত হওয়া উত্তম। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমজান মাসে ফজরের নামাজ আদায় করে মসজিদে ইবাদত করতেন, সাহাবিদের দ্বীনের শিক্ষা দিতেন। সূর্যোদয়ের পর ইশরাকের নামাজ আদায় করে ঘরে ফিরতেন।
ইফতারের সুন্নাত পদ্ধতিযথাসময়ে ইফতার করাও সুন্নাত। ইফতারের ক্ষেত্রেও রয়েছে কিছু করণীয় এবং দিকনির্দেশনা। যা পালন করা সুন্নাত ও উত্তম। তাহলো-
> দ্রুত ইফতার করাইফতারের সময় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইফতার করা সুন্নাত। এ সময় সাংসারিক কাজ বা অন্য কোনো কাজে ব্যস্ত থাকা সুন্নাত পরিপন্থী কাজ। হাদিসে এসেছে-‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, (দেরি না করে) দ্রুত ইফতারকারী কল্যাণ লাভ করতে থাকে।’ (বুখারি ও মুসলিম)
> আজানের সঙ্গে সঙ্গে ইফতারমাগরিবের আজানের সঙ্গে সঙ্গে ইফতার করা। ইফতার করার জন্য আজান শেষ হওয়ার অপেক্ষা করা ঠিক নয়। আর আজান শেষ হওয়ার জন্য অপেক্ষার কথাও কোথাও বলা হয়নি। বরং আল্লাহ তাআলা বান্দার জন্য রমজানের রোজায় কল্যাণকর বিষয়গুলো সহজ করতে চান। আল্লাহ বলেন-‘আল্লাহ তোমাদের জন্য সহজ করতে চান। কঠোরতা চান না।’ (সুরা বাকারা : আয়াত ১৮৫)
> আজানের উত্তর দেয়াইফতারের সময় রোজাদারের জন্য আজানের উত্তর দেয়া আবশ্যক নয়। বরং হাদিসের নির্দেশনা হলো- রোজাদার ও রোজা নয় এমন সব ব্যক্তির প্রতি নির্দেশনা হলো-‘তোমরা যখন আজান শুনবে, মুয়াজ্জিন যেমন বলে তেমন বলবে।’ (মুসলিম)
> ইফতারে বেশি সময় ব্যয় না করাইফতারের জন্য বেশি সময় ব্যয় করা, নামাজ আদায়ে দেরি করা কিংবা জামাআতে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকা মারাত্মক নিন্দনীয় কাজ। হাদিসে এসেছে-হজরত ইবনে আতিয়্যা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, ‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সামান্য ইফতার গ্রহণ করে দ্রুত নামাজ আদায় করে নিতেন।’
> ইফতারের সময় দোয়া করাদোয়া কবুলের মুহূর্তগুলোর মধ্যে ইফতারের সময়ও একটি। অনেকেই গল্প-গুজবের মধ্য দিয়ে ইফতার করে থাকেন। তাই এ সময় গল্প না করে দোয়া করার মাধ্যমে সুন্নাতের আমল করা। আবার ঘরের নারীরা এ সময় বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত থাকেন। তাদের উচিত, এ সময় দোয়া করা। হাদিসে এসেছে-‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘তিন ব্যক্তির দোয়া ফিরিয়ে দেওয়া হয় না। পিতামাতার দোয়া, রোজাদারের দোয়া ও মুসাফিরের দোয়া।’ (মুসনাদে আহমদ)
> ইফতার অপচয় না করাঅপচয় সুন্নাত পরিপন্থী কাজ। চাই তা ইফতার হোক কিংবা অন্য খাবার। আর সংযমের মাসে ইফতারের বাড়াবাড়ি ও জৌলুস করাও ঠিক নয়। কেননা আল্লাহ তাআলা বলেছেন-‘তোমরা খাও ও পান করো। অপচয় কোরো না।’ (সুরা আরাফ : আয়াত : ৩১)
সুতরাং মুমিন মুসলমানের উচিত সাহরি ও ইফতারে সুন্নাত বিষয়গুলো মেনে চলা। হাদিসের ওপর আমল করা। সাহরি ইফতারের কুসংস্কার ও মন্দ বিষয়গুলো থেকে বিরত থাকা।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে সাহরি ও ইফতারের সুন্নাতের ওপর যথাযথ আমল করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
এমএমএস/এমএস