মতামত

নৌপথে প্রাণহানি বন্ধ হবে কবে?

 

ইমরান হুসাইন

Advertisement

"আমার ঘরে বাতি জ্বালানোর মতো কেউ রইল না। দুই ছেলে, স্ত্রী সবাই একা ফালাইয়া চইলা গেল। আমার সব শেষে হয়ে গেল। এই দুনিয়াতে আমার আপন বলতে আর কেউ থাকল না।" সোমবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে মুন্সিগঞ্জ সদর উপজেলার নতুনগাঁও কেন্দ্রীয় শ্মশানে স্ত্রী সুনীতা সাহার (৪০) লাশ দাহ করার সময়ে আহাজারি করছিলেন সাধন সাহা (৫০)। শীতলক্ষ্যায় লঞ্চডুবিতে অপেক্ষার পর রাত সাড়ে ৩টার দিকে স্ত্রীর লাশ বুঝে পেয়েছেন। এমন আরো অনেক সাধন সাহা, অনেক বাবা-মায়ের আহাজারি এই লঞ্চ দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে। অনেক বাবা-মা হারিয়েছেন তার সন্তানকে।

স্বজন হারানোর বেদনা যে কতটা বেদনাদায়ক তা শুধু যার হারায় সেই বুঝে। আমরা শুধু ওপর থেকে সেই ব্যক্তির কান্নাকাটি বা আহাজারিটুকুই দেখি তার ভিতরকার অবস্থা দেখতে পাই না।একটা দুর্ঘটনা ঘটার পর স্বজনদের কান্নাকাটিতে ওই এলাকার অাকাশ-বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। কেউ তার স্বজনকে পায় জীবিত অবস্থায় আবার কেউ মৃত। আবার কেউ পায়ই না। তাদের এই ব্যথাটা আমরা দূর থেকে কতটা অনুধাবন করতে পারি! আজ বড় বড় দায়িত্বে যারা আছে তাদের মধ্যে থেকে কোন আত্নীয় স্বজনদের যদি এরুপ অবস্থা হতো তাহলেই হয়তো তাদের টনক নড়তো।

রোববার সন্ধ্যায় নারায়ণগঞ্জের মদনগঞ্জ এলাকায় নির্মাণাধীন তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতুর সামনে কার্গোর ধাক্কায় ডুবে যায় লঞ্চটি। এমভি রাবিতা আল হাসান নামে লঞ্চটি নারায়ণগঞ্জ টার্মিনাল থেকে ৫টা ৫৬ মিনিটে মুন্সীগঞ্জের উদ্দেশে ছেড়ে যায়। ঘটনার সময় নদীর তীর থেকে ধারণ করা একটি ভিডিওতে দেখা যায়, এসকে-৩ নামে একটি কার্গো জাহাজ বেপরোয়া গতিতে লঞ্চের পেছন দিকে সজোরো ধাক্কা দিলে সেটি ডুবে যায়। ঘটনার পর লঞ্চে থাকা বেশ কিছু যাত্রী সাঁতরে তীরে উঠতে সক্ষম হন।

Advertisement

ওই সময় নদীর ঘাট থেকে বেশ কিছু নৌকা ও ট্রলার গিয়ে ২৫-৩০ জনকে উদ্ধার করে। দুর্ঘটনার পরপর ঝড় শুরু হওয়ায় তাৎক্ষণিক উদ্ধার কাজ শুরু করা সম্ভব হয়নি। পরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে সেখানে ফায়ার সার্ভিস উদ্ধার অভিযান শুরু করে। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী এখনও পর্যন্ত উদ্ধারকারী মৃত দেহ ৩৫টি।

লঞ্চ দুর্ঘটনা আমাদের কাছে নতুন কোন বিষয় নয়। এইতো সেদিনের কথা, গতবছরের ২৬ নভেম্বর রাজধানীর শ্যামবাজার এলাকা সংলগ্ন বুড়িগঙ্গা নদীতে ৫০ যাত্রী নিয়ে লঞ্চ ডুবির ঘটনা ঘটেছিলো। জানা যায়, ঢাকা-চাঁদপুর রুটের ময়ূর-২ নামের একটি লঞ্চের ধাক্কায় কমপক্ষে ৫০ যাত্রী নিয়ে ঢাকা-মুন্সিগঞ্জ রুটের মর্নিং বার্ড লঞ্চটি ডুবে যায়। লঞ্চটি থেকে কয়েকজন যাত্রী সাঁতরে পাড়ে উঠলেও মারা গেছিলো অনেকেই।ঠিক এমন ঘটনা প্রতিনিয়তই ঘটছে আমাদের মাঝে। কিন্তু এই নিয়মিত দুর্ঘটনা ঘটার পিছনে মূল কারণ আমাদের চিহ্নিত করতে হবে এবং তার সমাধানে সম্মিলিত প্রচেষ্টা চালাতে হবে।

একটি প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত বছর পিনাক-৬ দুর্ঘটনার পর তদন্ত কমিটি দুর্ঘটনার পাঁচটি মূল কারণ চিহ্নিত করে। কারণগুলো হলো- লঞ্চের কাঠামোগত ও কারিগরি ত্রুটি, সামর্থ্যের অতিরিক্ত যাত্রী ও মালামাল বহন, লঞ্চের নকশায় অনুমোদনহীন পরিবর্তন, চালকের দায়িত্বহীনতা ও আবহাওয়া বিভাগের পূর্বাভাস এড়িয়ে যাওয়া।বিশেষজ্ঞদের মতে, লঞ্চ মালিকরা নিজেদের খেয়ালখুশিমতো লঞ্চের ভেতরের নকশা পাল্টে নিলেও, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতির কারণে চলাচলের সনদ পেয়ে যান।

আবার আরেকটি পরিসংখ্যান দেখা যাক, দেশ স্বাধীনের পর থেকে এ যাবৎ ২০ হাজার দুর্ঘটনায় ১০ হাজারের বেশি মৃত্যু ঘটেছে অথচ একচুল অগ্রগতি নেই নৌ-নিরাপত্তায়! দেশের নদীপথ কর্তৃপক্ষ বিআইডব্লিউটিএর জরিপ প্রতিবেদনে দেখা যায়, '১৯৭২ সাল থেকে নৌপথে ২০ হাজার দুর্ঘটনায় ১০ হাজার ৪৩৬ জনের মৃত্যু হলেও, নৌযানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কোনো সুপারিশই আজ পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়নি। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, নদীপথে দুর্ঘটনা কমানোর জন্য সরকার থেকে তদন্ত কমিটি গঠনের কথা থাকলেও তা হয়নি। নৌ মন্ত্রণালয় অন্তত ৫০০ দুর্ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করলেও মাত্র ৫টি কমিটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। তবে সেই সুপারিশগুলোও বাস্তবায়িত হয়নি।

Advertisement

অথচ সামান্য কিছু টাকা খরচ করে লঞ্চ দুর্ঘটনা এড়ানো না গেলেও প্রাণহানি এড়ানো যায় ঝড় উঠলে, ঢেউ বা স্রোতের মধ্যে ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে গেলে, তলা ফুটো হলে কিংবা অন্য কোনো বড় লঞ্চ বা জাহাজ ধাক্কা দিলে লঞ্চ ডুববে । কিছু কিছু ক্ষেত্রে আইন কঠোর করলে হয়তো ডোবার হার কমে যাবে, কিন্তু তার পরও কিছু কিছু লঞ্চ ডুবে যাবে। মানুষের প্রাণ বাঁচানো যাবে। সে ক্ষেত্রে কয়েকটি পদক্ষেপ নিতে হবে কঠোরভাবে-১. প্রত্যেক লঞ্চযাত্রীর একটি করে লাইফ জ্যাকেট থাকতে হবে। কোনো লঞ্চের ধারণক্ষমতা ২০০ হলে নিশ্চিতভাবে ৩০০ লাইফ জ্যাকেট থাকা বাধ্যতামূলক করতে হবে। যাত্রীরা লঞ্চে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে লাইফ জ্যাকেট পরা বাধ্যতামূলক করতে হবে।

২. লঞ্চে অবস্থিত বয়া এবং লাইফ বোট পর্যাপ্ত থাকে না। ২০০ যাত্রী ধারণের লঞ্চে বড়জোর ২০-২৫টা থাকে। এটা যাত্রী সংখ্যার সমানুপাত করতে হবে। অধিকাংশ লঞ্চের বয়া এমনভাবে বাঁধা থাকে যা বিপদকালে তো নয়ই, স্বাভাবিক সময়েও খোলা যায় না। ৩. লঞ্চগুলো গতিবেগের জন্য লম্বাটে করে বানানো হয়। কিন্তু যদি সি-ট্রাকের মতো লম্বা-চওড়া সমানুপাতে করা হতো, তাহলে হয়তো গতি কমে যেত এবং সহজে ডুবার ভয় থাকতো না।

সম্প্রতি সোসাইটি অব মাস্টার মেরিনার্স বাংলাদেশের নৌ-দুর্ঘটনার কারণগুলো নিয়ে কাজ করছে । এবং লঞ্চ দুর্ঘটনার ১০টি কারণ চিহ্নিত করেছে। এগুলো হলো—

লঞ্চ দুর্ঘটনা ঘটে অতিরিক্ত যাত্রী বহন মাস্টার-চালকের গাফিলতি, মাস্টারবিহীন চালনা, চরায় আটকানো ও প্রবল স্রোতের কারণ, চরে ওঠা, বিরূপ আবহাওয়া, নির্মাণজনিত ত্রুটি। আগুন লাগা ও নিবারণের পর্যাপ্ত সরঞ্জামাদি না থাকা, এবং দুটি লঞ্চে সংঘর্ষ।দুর্ঘটনা জনিত বিষয়গুলো লঞ্চ চালক ও যাত্রীদের ভালো মতো অবগত করতে হবে।

লঞ্চ দুর্ঘটনায় প্রত্যেক নিহতের পরিবারকে সৎকারের জন্য ২৫ হাজার টাকা করে দেয়া হবে বলে জানিয়েছেন নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) মোহাম্মদ জায়েদুল আলম। আসলে এই ২৫ হাজার টাকায় নিয়ে কি নিহতের পরিবার শান্তি পাবে? তারা যে আপনজন হারালো তা কি পূরণ করা সম্ভব কখনও? না সম্ভব না।মৃতের সৎকারের জন্য এই টাকাটা ব্যাবহারে বাজেট না রেখে যাতে এরুপ ঘটনা পরবর্তীতে না ঘটে। বা দুর্ঘটনা এড়াতে সরঞ্জমাদি ব্যবহার নিশ্চিত করুন। যেনো দুর্ঘটনায় পড়লেও সেখান থেকে বের হয়ে আসতে পারে ভালোভাবে। এমন কোন ঘটনা ঘটলেই আমরা আগে টাকার প্রশ্ন তুলি, যে মৃতদের এত পরিমাণ টাকা দেওয়া হবে আসলে টাকা দিয়ে কি সেই মানুষটাকে পাওয়া যায়!

আরেকটা বিষয় আমাদের ভালোভাবে লক্ষ্য করতে হবে যে, এ ধরনের দুর্ঘটনা বা হত্যাযজ্ঞের সাথে যারা জড়িত তাদেরকে কতটুকু আইনের আওতায় আনা হয়েছে? অপরাধীরা কতটুকু শাস্তি পেয়েছে এ বিষয়টা নিশ্চিত হতে হবে।অপরাধীরা যদি তাদের অপরাধের শাস্তি না পায় তাহলে এরুপ ঘটনা নৈমিত্তিক চলতেই থাকবে। আর অপরাধীদের যদি দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হয় তাহলে এক জনের সাজায় একশত জন সতর্ক হবেন তাহলেই আমরা দেখতে পাবো যে দুর্ঘটনার হার কমে গেছে।

নেই উপযুক্ত শাস্তি, নেই যথাযথ নিয়মকানুন। এভাবেই আমরা চলছি। কিন্তু এভাবে আর কতদিন! এরুপ দুর্ঘটনায় আর কত মায়ের কোল খালি হবে! আর কত প্রাণ গেলে এই সমস্ত সমস্যাগুলোর সমাধান হবে?

লেখক : শিক্ষার্থী জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।imranhossain64.bd@gmail.com

এইচআর/এমএস