অতিরিক্ত গরমে মানুষ যেমন হিটস্ট্রোক করে; তীব্র তাপদাহে ধানগাছও এমনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যেটাকে হিটশক বা হিট ইনজুরি বলে। গত রোববার (৪ এপ্রিল) দেশের বিভিন্ন জেলায় বোরো ধানের ক্ষতি হয়েছে এ হিটশকে। এটিকে কৃষিতে জলবায়ু পরিবর্তনের নতুন চ্যালেঞ্জ বলে দেখছেন ধান গবেষকরা।
Advertisement
জানা গেছে, নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জের হাওর এলাকা এবং গোপালগঞ্জ, কুষ্টিয়া, রাজশাহী ও ময়মনসিংহ জেলাসহ কিছু অঞ্চলে ৪ এপ্রিলের হিটশকে বোরো আবাদের ন্যূনতম ৫ শতাংশ (ধানগাছ) মরে গেছে। এ ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়তে পারে বলে প্রাথমিকভাবে আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর বলছে, পুরোপুরি ক্ষতির হিসাব নিরূপণ করা না গেলেও হিটশকে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোতে ৪৮ হাজার হেক্টর জমি বোরো ধান আক্রান্ত হয়েছে বলে এখন পর্যন্ত জানা গেছে। এরমধ্যে ২০ থেকে ২৫ শতাংশ আবাদের ক্ষতি হয়েছে। সে হিসাবে ১০ থেকে ১২ হাজার হেক্টর জমির ধান সম্পূর্ণ নষ্ট হতে পারে বলে প্রাথমিক আশঙ্কা করা হচ্ছে।
জানা গেছে, ৪ এপ্রিল সন্ধ্যার পর সারাদেশের মতো কালবৈশাখীর ঝড়ো বাতাস শুরু হয় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত জেলাগুলোতেও। তবে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোতে বাতাস ছিল অতিরিক্ত গরম। দেশের অধিকাংশ এলাকায় এরপর গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি নামে। তবে ক্ষতিগ্রস্ত সেসব এলাকায় বৃষ্টি হয়নি। পরদিন ৫ এপ্রিল সকালে ক্ষেতে গিয়ে মাথায় হাত পড়ে কৃষকের। সূর্যের প্রখরতা যত বেড়েছে, ততই বোরো ধানের শীষ মরতে শুরু করেছে। ক্ষতিগ্রস্ত সব এলাকায় একই ঘটনা ঘটেছে। বিষয়টি কী ঘটেছে তা পরিষ্কার ছিলেন না কৃষকরা।
Advertisement
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে এ ধরনের ঘটনা নতুন না হলেও সাধারণ মানুষের কাছে বেশি পরিচিত নয়। কৃষিতে জলবায়ু পরিবর্তনের এটি একটি নতুন চ্যালেঞ্জ।
গাজীপুর ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে বিজ্ঞানীরা সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত নেত্রকোনার তিনটি উপজেলা পরিদর্শন করেছেন গতকাল মঙ্গলবার (৬ এপ্রিল)। এই দলে রয়েছেন ইনস্টিটিউটের কীটতত্ত্ব বিভাগের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. নজমুল বারী, উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব বিভাগের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মোহাম্মদ আশিক ইকবাল খান এবং উদ্ভিদ শরীরতত্ত্ব বিভাগের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. সাজ্জাদুর রহমান।
নাজমুল বারী জাগো নিউজকে বলেন, ‘অতিরিক্ত তাপমাত্রা বাড়া অথবা কমা—দুই কারণে হিটশক বা হিট ইনজুরি হয়ে থাকে। ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসকে হিটশকের মাত্রা ধরা হয়। আক্রান্ত এলাকাগুলোতে মার্চের শেষ দিক থেকে তাপমাত্রা ক্রমাগত বাড়ছে।’
তিনি বলেন, ধানের ফ্লাওয়ারিং স্টেজে (ফলনের প্রাথমিক পর্যায়) এটা ক্ষতি খুব বেশি করে। এ সময়কে সবচেয়ে ভার্নারেবল অবস্থা ধরি আমরা। আর এ দফায় গরম বাতাস এমন সময় হয়েছে, যখন ওইসব এলাকায় ফ্লাওয়ারিং স্টেজ চলছিল। তাই ওইসব ধানের শীষ থেকে পানি বেরিয়ে গেছে। শুকিয়ে নষ্ট হয়ে গেছে।
Advertisement
নাজমুল বারী বলেন, কৃষিতে জলবায়ু পরিবর্তনের এটি একটি নতুন চ্যালেঞ্জ। এ ঘটনা আগেও হয়েছে। তবে এতো বিস্তর এলাকায় ক্ষতি হয়নি।
এদিকে ওই সময় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় তাপমাত্রা বেশি থাকার কথা জানিয়ে আবহাওয়াবিদ আবুল কালাম মল্লিক জাগো নিউজকে বলেন, ‘রেকর্ড অনুযায়ী হাওর এলাকায় দু-একদিন আগে তাপপ্রবাহ ছিল। তাপমাত্রা বেশি ছিল। ৩৫ থেকে ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মতো ছিল।’
তিনি বলেন, ‘হাওর এলাকায় পানি থাকলে এবং সূর্যের তাপ থাকলে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ অনেক বেড়ে যায়। জলীয় বাষ্প বেশি থাকলে এবং বাতাসের গতি না থাকলে আমরা হয়তো ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করলাম, কিন্তু তাপমাত্রার অনুভব ৪০ ডিগ্রি সেলিসয়াসের বেশিও হতে পারে।’
‘বাতাসে যদি জলীয় বাষ্পের পরিমাণ ৭০ শতাংশের বেশি থাকে এবং বাতাসের গতি ঘণ্টায় পাঁচ কিলোমিটারের কম থাকে, তখন আমরা যে তাপমাত্রা পরিমাপ করি না কেন, এর চেয়ে অনুভব তাপমাত্রা অনেক বেশি হবে। তখন মনে হয় গায়ে লু-হাওয়া বয়ে যাচ্ছে। হাওর এলাকায় সেটা হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ পরিস্থিতি ফসলের জন্য ক্ষতিকর’—বলেন আবুল কালাম মল্লিক।
আবহাওয়া অধিদফতরের সাবেক মহাপরিচালক মো. শাহ আলম বলেন, ‘ওখানে (হাওর এলাকায়) মনে হচ্ছে তাপমাত্রাটা অনেক বেশি হয়ে গিয়েছিল। ধান ফুল থেকে পুষ্ট হওয়ার প্রক্রিয়ায় যে তাপমাত্রার দরকার ছিল, তার চেয়ে সেখানে বেশি ছিল বলে মনে হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের এটি একটি প্রভাব।’
হিটশক দেশে নতুন নয় উল্লেখ করে গাজীপুর ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের উদ্ভিদ শরীরতত্ত্ব বিভাগের সাজ্জাদুর রহমান বলেন, ‘২০১২ সাল থেকে আমরা হিটশকের তথ্য রেখেছি। এ পর্যন্ত যশোর সদর, সিরাজগঞ্জের তাড়াশ, গাজীপুরের কালিয়াকৈর এবং ময়মনসিংহের শম্ভুগঞ্জে এর আগে হিটশক হয়েছে। তবে কখনো গ্রামের এক-দুইটি মাঠে বা কোনো একটি এলাকার ক্ষেতে হয়েছে। এতো বড় হিটশক এটাই প্রথম।’
তিনি বলেন, ‘এ বছর কালবৈশাখীর সঙ্গে বৃষ্টি না থাকায় ক্ষতি হয়েছে বেশি। সাধারণত কালবৈশাখীর পরে বৃষ্টি হয়। তাই তাপমাত্রা কমে যায়; এমন হয় না। ৪ এপ্রিল যেখানে যেখানে বৃষ্টি হয়েছে, সেখানে ক্ষতি হয়নি।’
অতিরিক্ত গরম হাওয়া পুড়িয়ে দিয়েছে হাজার হাজার হেক্টর জমির বোরো ধান
এ বিষয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মহাপরিচালক মো. আসাদুল্লাহ বলেন, ‘কৃষি সচিবসহ আমরা কাল (বুধবার) ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শনে যাচ্ছি। এটা একটি নতুন সমস্যা। তবে আগেও হয়েছে। কিন্তু বড় ক্ষতি আগে হয়নি।’
তিনি এও বলেন, ‘দেশে এ বছর প্রচুর বোরো ধান হয়েছে। এ ক্ষতি সার্বিক উৎপাদনে কোনো প্রভাব পড়বে না।’
ঝড়ো হাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত বোরো ধানের ক্ষেত
সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা নেত্রকোনার স্থানীয় কৃষক ও প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, এবার এক লাখ ৮৪ হাজার ৯৮৩ হেক্টর জমিতে বোরোর আবাদ হয়েছে। ৪ এপ্রিল সন্ধ্যায় হঠাৎ গরম বাতাস শুরু হয়। যেসব এলাকা দিয়ে ওই বাতাস প্রবাহিত হয়েছে, সেসব এলাকার বোরো ধানের ক্ষেতের শীষ মরে গেছে।
নেত্রকোনার খালিয়াজুরী উপজেলা সদরের কৃষক শফিকুল ইসলাম তালুকদার, এরশাদ মিয়া, মনির হোসেন ও রঞ্জিত সরকার বলেন, ‘(৪ এপ্রিল) সন্ধ্যা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত শুধু গরম বাতাস ছিল। কোনো রকম ঝড়-বৃষ্টি ছিল না। বাতাসটা অসহ্য মনে হচ্ছিল। ৫ এপ্রিল সকালে রোদ ওঠার পর হাওরে গিয়ে দেখি থোড় আসা ধান মরে শুকিয়ে যাচ্ছে। ধান মরে গেছে।’
অতিরিক্ত গরম হাওয়া পুড়িয়ে দিয়েছে হাজার হাজার হেক্টর জমির বোরো ধান
নেত্রকোনা জেলা কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, জেলার হাওরাঞ্চলে মোট ৪০ হাজার ৯৬০ হেক্টর জমিতে বোরোর আবাদ করা হয়। এরমধ্যে হাইব্রিড (হীরা) জাতের ধান ও বিআর ২৯ জাতের ধানে ক্ষতি বেশি হয়েছে। হাওরাঞ্চলে হাইব্রিড (হীরা) জাতের ধান মোট ১০ হাজার ৩৩০ হেক্টর এবং বিআর ২৯ জাতের ধান প্রায় সাত হাজার ৮০০ হেক্টর জমিতে রোপণ করা হয়েছিল।
ওই এলাকার মদন, খালিয়াজুরী, মোহনগঞ্জ উপজেলায় বেশি ক্ষতি হয়েছে ধানের। এছাড়া বারহাট্টা, দুর্গাপুর, কলমাকান্দাসহ সব উপজেলা থেকে ধানের ক্ষতির খবর আসছে বলে জানিয়েছে জেলা কৃষি অফিস। তবে ক্ষতির সঠিক তথ্য এখনো দিতে পারছে না জেলা কৃষি অধিদফতর।
ঝড়ো হাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত বোরো ধানের ক্ষেত
এদিকে কিশোরগঞ্জের ইটনা, মিঠামইন, অষ্টগ্রামের হাওরাঞ্চলসহ জেলার বিভিন্ন এলাকায় গরম বাতাসের প্রভাবে ২৫ হাজার হেক্টর জমির ধান নষ্ট হয়েছে। ৫ এপ্রিল জেলার করিমগঞ্জের উরদিঘী, ইটনার রায়টুটি, মিঠামইনের বড় হাওরসহ কয়েকটি হাওরে গিয়ে ধানের শীষ শুকিয়ে যাওয়ার প্রমাণ মেলে।
জেলা কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, কিশোরগঞ্জে এ বছর মোট এক লাখ ৬৬ হাজার ৯৫০ হেক্টর জমিতে বোরোর আবাদ হয়েছে। এর মধ্যে জেলার হাওরাঞ্চলসহ কয়েকটি অঞ্চলের মোট ২৫ হাজার হেক্টর জমির ধান এভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে সর্বশেষ জরিপ শেষে প্রকৃত পরিমাণ নির্ধারণ করা যাবে।
এনএইচ/এইচএ/জেআইএম